ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

ভাইয়েরা আমার

প্রকাশিত: ০৫:৫৫, ৩০ ডিসেম্বর ২০১৭

ভাইয়েরা আমার

আমাদের ঘরে একটি রেডিও আছে। মারফি। নামী কোম্পানির রেডিওটা নিয়ে আমরা খুব গর্ব করি। সবাই একসঙ্গে গোল হয়ে বসে শুনি। বিশেষ করে অনুরোধের আসর। কারা কার কোন্ গানের অনুরোধ করল তাদের নামও ইথারে ভেসে আসে। প্রতিদিন সকাল ৭টায় বাবা বড় করে রেডিও ছেড়ে দেন। সংবাদ শোনেন। একজন যা লোক কণ্ঠকে বিভিন্ন ওঠানামায় খবর পড়েন। খবর পড়ছি-সরকার কবীর উদ্দিন। গলাটা আমার খুব পছন্দের। মার্চের শুরু থেকেই পরিবেশটা কেমন যেন বদলে যেতে থাকল। গানটান কেউ শোনে না। বাবা-বড় ভাইয়েরা শুধু আলাপ করে। কিছু বুঝি কিছু বুঝি না। এতক্ষণ যার কথা বলছিলাম তার নাম মানিক। মানিক ক্লাস সেভেনে পড়ে। পড়ালেখা বাদে খেলাধুলা আর রেডিও শোনা তার নেশা। কিন্তু এখন রেডিওতে খবর শোনা ছাড়া কেউ কিছু শোনে না। বড়দের কথায়ও সে অংশ নিতে পারে না। তবে একটা কথা সে বোঝে দেশে একটা কিছু হতে যাচ্ছে। শেখ মুজিব দেশের জন্য লড়াই করছে। এদিকে বড় আপু আছে আরেক টেনশনে। কামাল ভাই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। মিছিলে যায় কামাল ভাই মানিকদের পাশের বাসায় থাকে। বড় ভাই কলেজে। তবে সম্পর্কটা শুধু বন্ধুত্ব নয় মানিক সেটা বুঝতে পারে। কামাল ভাইয়ের মিছিলে যাওয়া বড় আপু পছন্দ করে না। এ জন্য ঝগড়া হয়েছে। গত কয়েকদিন ধরে কথা বলে না। কামাল ভাই বেপরোয়া। ওসব পাত্তা দেয় না। শিষ দিয়ে জয় বাংলা বাংলার জয় গান গায়। মানিককে দেখা হলেই বলে ‘জয় বাংলা’ বল। একদিন এই দেশটা জয় বাংলা হবে। এলো ৬ তারিখ। চারদিকে খবর একটাই ৭ মার্চ রেসকোর্সে বঙ্গবন্ধু ভাষণ দেবেন। স্বাধীনতা ঘোষণা করবেন। চট্টগ্রাম থেকে কিছু মানুষ ঢাকা গিয়েছে। যারা যেতে পারেনি তারা শোনার অপেক্ষায় আছে। কেননা রেডিওতে রেসকোর্স থেকে ভাষণটি সরাসরি প্রচার করা হবে। সবার মনে আগ্রহ-উৎকণ্ঠা। অন্যদিকে মুক্তির আনন্দে উদ্বেল। মানিক মার্চের ৭ তারিখ স্কুলে গেল না। বাবাও তেমন কিছু বলল না। শুধু বলল ‘ঘরে থাকিস।’ ওই দিন সকাল থেকেই বাসার রেডিও বড় করে বেজে চলেছে। বাবার নির্দেশ রেডিও বন্ধ করা যাবে না। এদিকে আম্মা বাবাকে দোকান থেকে ডিম আনতে পাঠিয়েছে। বাবা ডিম না এনে ৮টি চান্দা ব্যাটারি নিয়ে এসেছে। যদি ব্যাটারি শেষ হয়ে যায় তাহলে তো রেডিও বন্ধ হয়ে যাবে। পরে মা যখন রেগে আগুন বাবা আবার দোকানে গিয়ে ডিম নিয়ে আসলেন। মানিক বাবার অবস্থা দেখে হেসে কুটি কুটি। তা দেখে বাবা দিলেন ধমক। বললেন, ‘তোকে স্কুলে পাঠানোই উচিত ছিল।’ সবাই দুপুরের ভাত তাড়াতাড়ি খেয়ে ফেলল। ভাষণ শুনতে হবে। গান বাজছে। হঠাৎ শোঁ শোঁ করে রেডিও বন্ধ হয়ে গেল। বাবা রেডিও হাতে নিয়ে এদিক করেন ওদিক করেন। রেডিও বাজে না। পরে ব্যাটারি বদলিয়ে নতুন ব্যাটারিগুলো লাগালে তাও চলে না। দুপুর গড়িয়ে যায়, বিকেল নামে। রেডিও নিথর। বাবা ফুফুদের বাসায় গিয়ে কাকে কাকে যেন ফোন করলেন। ফিরে এসে জানালেন বঙ্গবন্ধুর ভাষণ পাকিস্তানীরা প্রচার করতে না দেয়ায় পূর্ব পাকিস্তানের সব রেডিও কর্মকর্তা-কর্মচারী মিছিলে গেছে বলে রেডিও বন্ধ। সন্ধ্যা হতেই চারদিকে নানা কথা। মানিকের বাবার বন্ধুরা বাসায় এলেন। তারা বলাবলি করছেন তারা নাকি শুনেছেন বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ডাক দিয়েছেন। দেশের অবস্থা ভাল নয়। তাই বাবার বন্ধুরা চা খেয়ে তাড়াতাড়ি চলে গেলেন। সকালে স্কুলে যেতে হবে। মায়ের তাড়ায় মানিক ও ঘুমুতে চলে গেল। পরের দিন সকালে বাসায় হৈচৈ শুনে মানিকের ঘুম ভেঙ্গে গেল। সবাই বেশ খোশ মেজাজে। ব্যাপার কি? বাবা সকাল ৭টায় অভ্যাসবশত রেডিও খুলেই শুনলেন, ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’ গান চলছে। তারপর ঘোষণা, কিছুক্ষণের মধ্যেই রেডিওতে ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর দেয়া ভাষণের রেকর্ড প্রচার করা হবে। চন্দনপুরার পাড়ায় উল্লাস। রেডিও কর্মচারীদের দাবির মুখে অবশেষে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শোনা যাবে। কিছুক্ষণ পরেই বেজে উঠল ‘ভাইয়েরা আমার... এরপর প্রতিটি দিন ছিল মিছিলে স্লোগানে মুখরিত। মানিক স্কুলে যায় না। অসহযোগ আন্দোলনের কারণে ক্লাস হয় না। বাবা-ভাইদের চোখেমুখে চিন্তার ছাপ। কি হবে। যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে হবে। ফুফুদের বাসা থেকে বাবা মাঝে মাঝে ঢাকায় টেলিফোন করেন। খবর নেন। বড় ভাই সারাদিন বাইরে মিটিং-মিছিল নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। মিছিল-মিটিং শেষ করে ঘরে ফিরতে রাত হয়ে যায়। সময় এগিয়ে যায়। ২৫ মার্চ দুপুর থেকে চারদিকে কেমন আতঙ্ক, কানাঘুষো। ষোলশহরের দিকে জনৈক বাঙালী সামরিক অফিসারকে বন্দরের দিকে যাওয়ার পথে ছাত্রজনতা আটকে দেয়। তিনি নাকি পাকিস্তানী অফিসারের নির্দেশ পালন করতে সোয়াত জাহাজ থেকে অস্ত্র খালাস করতে যাচ্ছিলেন। ২৫ মার্চ রাতে চারদিকে গুলির শব্দ। মানিকদের বাসা মুসলিম লীগ নেতার বাড়ি গুডস হিলের পাশে। সবাই ভয়ে অস্থির। আসে ছাব্বিশ মার্চের রাঙা প্রভাত। সবার মুখে মুখে একটিই কথা বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। বেতার বন্ধ। শুরু হয়ে গেছে মুক্তির যুদ্ধ। বিকেলে বা দুপুরে ঠিক মনে নেয় মানিক বাসার রেডিওতে শুনতে পায় হান্নান নামের একজনের কণ্ঠে ঘোষণা করা হচ্ছে ‘বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা’ করেছেন। মানিকের ভয় লাগে। যুদ্ধ সে কোনদিন দেখেনি। খারাপ লাগে স্কুলে যেতে পারবে না। খেলতে পারবে না। বাবার মুখে শুনে ২৫ মার্চ রাতে ঢাকায় পাকিস্তানী মিলিটারিরা অনেক মানুষ মেরে ফেলেছে বিনা কারণে। দেশজুড়ে প্রতিরোধ চলছে। চট্টগ্রামের রাস্তায় ইপিআর বাহিনীর ট্রাক মাঝে মাঝে জয় বাংলা ধ্বনি দিয়ে যাচ্ছে। বঙ্গবন্ধু যে ডাক দিয়েছিলেন সে ডাকে সারাদেশ প্রতিরোধ, প্রতিশোধে প্রস্তুত। বাবা বার বার ঢাকায় ফুফুর বাসা থেকে চাচার সঙ্গে যোগাযোগ করতে চাচ্ছেন। ফোন বিকল। ছোট্ট মানিক ও বুঝতে পারে স্বাধীনতা শব্দটির মানে। মানে মুক্তি। মার্চের শেষ দিকে মানিকরা গ্রামের বাড়ি চলে যায়। অনেক কষ্ট ও বেদনার দিনগুলো। মিলিটারি আসছে শুনলেই সবাই এই গ্রাম থেকে সেই গ্রামে ছুটে বেড়ায়। যেন বাঘ আসছে। এরই মধ্যে খবর আসতে থাকে স্বাধীন হয়ে যাবে দেশ। বাবা খুশিতে ঠিকমতো ভাত খায় না। ‘জয় বাংলা’ ধ্বনির দীপ্ত স্লোগানে মুখরিত হয়ে আসে ১৬ ডিসেম্বর। বিজয়ের দিন। সবার মুখে হাসি। বাবা বাড়ির বড় মোরগটা জবাই করে দিলেন। মায়ের শখের ছিল মোরগটি। বাবা মাকে কথা দিলেন আরেকটি কিনে দেবেন। বাবা-বড় ভাই আলাপ করতে থাকেন বঙ্গবন্ধু মুক্তি পাচ্ছেন। স্বাধীন দেশে শুনবেন ভাইয়েরা আমার... অলঙ্করণ : প্রসূন হালদার
×