ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

প্রত্যাবাসন ॥ প্রথম দফায় এক লাখ রোহিঙ্গার তালিকা

প্রকাশিত: ০৪:৫৯, ৩০ ডিসেম্বর ২০১৭

প্রত্যাবাসন ॥ প্রথম দফায় এক লাখ রোহিঙ্গার তালিকা

হাসান নাসির/এইচএম এরশাদ ॥ যথাযথ নিরাপত্তা নিশ্চিত করেই রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতে চায় বাংলাদেশ। বছরের প্রথম মাস জানুয়ারিতে শুরু হচ্ছে প্রত্যাবাসনের কাজ। এ লক্ষ্যে দুদেশের মধ্যে সমঝোতা চুক্তির আলোকে প্রস্তুতি অনেক দূর এগিয়েছে। প্রথম দফায় ফেরত যাবে ১ লাখ রোহিঙ্গা, যাদের তালিকাও প্রস্তুত। এদিকে, প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া এগিয়ে যাওয়ায় মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে রোহিঙ্গা শিবিরে। বিশেষ করে রাখাইন প্রদেশে যাদের কিছু ধন-সম্পদ এবং ভাল অবস্থা রয়েছে তারা উৎসাহী হলেও সহায় সম্পদহীন রোহিঙ্গাদের অনাগ্রহ বেশ পরিষ্কার। তাছাড়া নানা দাবি তুলে তাদের নিরুৎসাহিত করার তৎপরতাও রয়েছে। এমতাবস্থায় প্রত্যাবাসনের পরিবেশ সৃষ্টির পাশাপাশি তাদের ফিরে যাওয়ার মানসিকতা তৈরির কাজটিও অত্যন্ত জরুরী বলে মনে করছে রোহিঙ্গা ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন সংস্থা এবং স্থানীয় অধিবাসীরা। সহিংসতার মুখে মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশ থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের নিজ আবাস ভূমিতে ফেরত পাঠাবার ক্ষেত্র অনেকটাই প্রস্তুত হয়েছে জাতিসংঘসহ বিভিন্ন সংস্থা এবং দেশী-বিদেশী চাপ ও কূটনৈতিক তৎপরতার কারণে। জনসংখ্যার বাড়তি এই চাপ দুর্ভোগে পরিণত হতে পারে আগামী বর্ষা মওসুমে। সে কারণে বর্ষার আগেই একটি বড় অংশকে রাখাইন প্রদেশে ফেরত পাঠাবার প্রক্রিয়া চলছে। রাখাইন প্রদেশে এখন নির্যাতন বন্ধ হওয়াকে প্রত্যাবাসনে মিয়ানমার সরকারের ইচ্ছা হিসেবে দেখা হচ্ছে। যদিও যাচাই বাছাইসহ বিভিন্ন শর্তে প্রক্রিয়া দীর্ঘায়িত হওয়ার আলামতও রয়েছে। বাংলাদেশ এবং মিয়ানমারের মধ্যে সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর ও যৌথ ওয়ার্কিং কমিটি গঠনের পর রোহিঙ্গা শিবিরে উচ্ছ্বাস এবং শঙ্কা দুটোই রয়েছে। যারা ফিরে যেতে চায় তারা আনন্দিত হলেও অনাগ্রহীদের মধ্যে দেখা যাচ্ছে নানা অজুহাতও। বিশেষ করে নাগরিকত্ব, সমাজ মর্যাদাসহ বেশ কিছু দাবি তারা তুলে ধরছে ফিরে যাবার শর্ত হিসেবে। আর এক্ষেত্রে ইন্ধনদাতা ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর সংখ্যাও কম নয়। যে সকল রোহিঙ্গার রাখাইন প্রদেশে তেমন কোন জীবিকার অবলম্বন নেই, তারা বাংলাদেশকেই বসবাসের জন্য অনুকূল ভাবছে। শেষ পর্যন্ত মিয়ানমার সম্মত হলেও কত সংখ্যক রোহিঙ্গা ফিরতে রাজি হবে তা নিয়েও সংশয় রয়েছে। প্রসঙ্গত, ১৯৭৮ সালে আসা রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের কাজ যখন শুরু হয় ১৯৭৯ সালে তখনও একপর্যায়ে রোহিঙ্গারা বেঁকে বসেছিল। হঠাৎ করে তারা বাংলাদেশের একটি পুলিশ ক্যাম্প দখল ও রিফিউজি অফিসারসহ সরকারী কর্মকর্তাদের জিম্মি করে ফেলেছিল। শুধু তাই নয়, অস্ত্র লুটের ঘটনাও ঘটিয়েছিল। ওই অবস্থায় বাংলাদেশকে অতিরিক্ত ফোর্স মোতায়েন করতে হয়। পরিস্থিতি সামাল দেয়ার চেষ্টায় কয়েক রোহিঙ্গার প্রাণহানিও ঘটে সে সময়। সর্বশেষ গত আগস্ট থেকে দু’মাসে নতুন করে রোহিঙ্গা এসেছে আরও ৬ লক্ষাধিক। কক্সবাজারের শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনের (আরআরআরসি) প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশে নতুন অনুপ্রবেশকারী মিয়ানমার নাগরিকের সংখ্যা ৬ লাখ ৭২ হাজার ৭০ জন। তবে টেকনাফ ও উখিয়ার ক্যাম্পগুলোতে আশ্রিত এ পর্যন্ত ৯ লাখ ৬ হাজার রোহিঙ্গার বায়োমেট্রিক নিবন্ধন করা হয়েছে। অনুপ্রবেশ অব্যাহত থাকায় এ সংখ্যা বাড়ছে। মিয়ানমারের সমাজকল্যাণ ও ত্রাণমন্ত্রী ড. উইন মিয়াত আইয়ি-এর মধ্যেই জানিয়েছেন যে, বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করা রাখাইনের অধিবাসীদের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু হবে ২২ জানুয়ারি। মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় সংবাদ মাধ্যম গ্লোবাল নিউ লাইট অব মিয়ানমার গত বৃহস্পতিবার সে দেশের মন্ত্রীর এ বক্তব্য ছেপেছে। এতে করে ধারণা করা হচ্ছে যে, সুচি সরকার এখন অনেকটাই আন্তরিক। রোহিঙ্গা ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংস্থা এবং বাড়তি এ জনগোষ্ঠীর কারণে ভুক্তভোগী স্থানীয় বাসিন্দারা মনে করছেন, প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া সফল করতে হলে বাংলাদেশ সরকারের কূটনৈতিক তৎপরতার পাশাপাশি রোহিঙ্গাদেরও মানসিকভাবে প্রস্তুত করা জরুরী। তাদের বোঝাতে হবে যে, বাংলাদেশ তাদের দেশ নয়। তাদের ফিরতেই হবে নিজ দেশ মিয়ানমারে। সেখানে যথাযথ নিরাপত্তা নিশ্চিত করেই যে ফেরত পাঠানো হচ্ছে, সে প্রচারটিও চালাতে হবে। তা না হলে মিয়ানমার সরকারের সম্মতি থাকলেও প্রক্রিয়াটি ভেস্তে যেতে পারে। এদিকে, রোহিঙ্গাদের আগমনকে কেন্দ্র করে ওই এলাকার অনেকের ব্যবসা বাণিজ্য ফুলেফেঁপে উঠেছে। কিছু এনজিও রয়েছে, যারা রোহিঙ্গাদের নিয়ে কাজ করছে। এছাড়া রয়েছে রাজনৈতিক মদদপুষ্ট বিভিন্ন গ্রুপ ও সংস্থা। রোহিঙ্গাদের রেখে দিলে অনেকেরই সুবিধে। এসব বিবেচনায় তারা নানাভাবে নিরুৎসাহিত করছে বলে তথ্য রয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে। সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে ইতোমধ্যে কক্সবাজারের টেকনাফ-উখিয়ায় কয়েকটি এনজিও’র কার্যক্রম নিষিদ্ধ করেছে সরকার। রোহিঙ্গাদের মধ্যেই যেন প্রত্যাবাসনবিরোধী মনোভাব সৃষ্টি না হয় সেদিকেও বিশেষ নজর দেয়া প্রয়োজন। মিয়ানমারের সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি এবং ৩০ সদস্যের যৌথ ওয়ার্কিং কমিটি গঠনের ধারাবাহিকতায় প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় গতি এসেছে। আগামী ১৫ জানুয়ারি এই ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠক বসছে মিয়ানমারে। সবকিছু ঠিকঠাক মত হলে ২২ জানুয়ারি শুরু হবে প্রত্যাবাসন কাজ। এ সময়টিকে দেখা হচ্ছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে। কেননা, অভিজ্ঞতার আলোকে এর মধ্যে অনাকাক্সিক্ষত কিছু ঘটার শঙ্কাও উড়িয়ে দিচ্ছেন না অভিজ্ঞ মহল। অনভিপ্রেত ঘটনা উগ্রবাদী কোন রোহিঙ্গা সংগঠনের মাধ্যমে রাখাইনে যেমন হতে পারে, তেমনিভাবে ঘটতে পারে কক্সবাজারের উখিয়া এবং টেকনাফের রোহিঙ্গা শিবিরেও। প্রথম দফায় প্রত্যাবাসনে ১ লাখ রোহিঙ্গার তালিকা ॥ প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় প্রথম দফায় ১ লাখ রোহিঙ্গার তালিকা ইতোমধ্যেই প্রস্তুত হয়ে গেছে। শুক্রবারই এই তালিকা পৌঁছে গেছে মিয়ানমারের কাছে। সে দেশে অনুষ্ঠিত যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপের বৈঠকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে পাঠানো এ তালিকার ব্যাপারে আলোচনা ও সিদ্ধান্ত হবে। সেই বৈঠকে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপ আসবে বলে আশা করছে বাংলাদেশ সরকার। সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের শুক্রবার উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন এবং শীতবস্ত্র ও ওষুধ বিতরণকালে সাংবাদিকদের জানান, প্রথম দফায় ১ লাখ রোহিঙ্গা হস্তাস্তরের প্রস্তুতি চলছে। রোহিঙ্গাদের যথাযথ নিরাপত্তা ও সম্মান নিশ্চিত করেই স্বদেশে প্রত্যাবাসনের পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার। গত বৃহস্পতিবার ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয়েছে দুদেশের পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের প্রথম বৈঠক। বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বাংলাদেশের পক্ষ থেকে প্রস্তুত করা ১ লাখ রোহিঙ্গার তালিকা মিয়ানমারকে দেয়া হচ্ছে। তবে মিয়ানমারের পক্ষ থেকে প্রস্তুত করা নামের তালিকা অনুমোদনের পরই রোহিঙ্গা পাঠানো শুরু হবে। সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে যুদ্ধ করে টিকে থাকা বাঙালী জাতি মানবতাবাদী। এ কারণে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত দশ লক্ষাধিক রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়েছি আমরা। প্রত্যাবাসন শেষ না হওয়া পর্যন্ত আশ্রিত রোহিঙ্গাদের সব ধরনের সহযোগিতা দেবে সরকার। এ সময় উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশের সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ বড়ুয়া, আওয়ামী লীগের উপ দফতর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়া, স্থানীয় সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদি, আশেক উল্লাহ রফিক, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সিরাজুল মোস্তফা ও সাধারণ সম্পাদক মুজিবুর রহমান প্রমুখ। সাংবাদিকদের অপর এক প্রশ্নের জবাবে ওবায়দুল কাদের বলেন, সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন যথাসময়ে অনুষ্ঠিত হয়ে যাবে। সময় এবং স্রোত যেমন কারও জন্য অপেক্ষা করে না তেমনিভাবে নির্বাচনও কারও জন্য অপেক্ষা করবে না। বিএনপি আসুক বা না-ই আসুক নির্বাচন হয়ে যাবে। নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষা করতে চাইলে নির্বাচনে আসার বিকল্প নেই বিএনপির। উন্নয়নের ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে জনগণ আওয়ামী লীগকে ভোট দেবে। তাই আগামী নির্বাচনেও আওয়ামী লীগ জয় পাবে বলে আমরা শতভাগ আশাবাদী। রোহিঙ্গাদের হামলায় গ্রামবাসী আহত ॥ মিয়ানমারে ফেরত বিষয়ে স্থানীয়দের সঙ্গে রোহিঙ্গাদের মতবিরোধ তুঙ্গে উঠতে শুরু করেছে। স্থানীয়রা চাইছে যত দ্রুত সম্ভব রোহিঙ্গারা স্বদেশে ফিরে যাক। অপরদিকে রোহিঙ্গাদের ভাষ্য হচ্ছে, নাগরিকত্ব না দেয়া পর্যন্ত তারা বাংলাদেশে থাকবে। স্থানীয়রা বলছেন, মানবতার খাতিরে তাদের আশ্রয় দেয়া হয়েছে। সরকারের সিদ্ধান্ত মেনে রোহিঙ্গাদের ফেরত যেতে হবে। রোহিঙ্গাদের স্বদেশে ফেরত পাঠাবার আলোচনা উঠলেই মাথা গরম হয়ে উঠে রোহিঙ্গাদের। বিভিন্ন গণমাধ্যমে জেনে স্থানীয় কয়েক ব্যক্তি বালুখালী ক্যাম্পের পাশে আগামী ২২ জানুয়ারি রোহিঙ্গাদের স্বদেশে ফেরত যেতে হবে বলে আলোচনা করছিল। এ খবর জেনে দু’জন রোহিঙ্গা মুঠোফোনে খবর দেয় তাদের স্বজনকে। তারা ক্যাম্প থেকে এসে গ্রামবাসী ৩ ব্যক্তির উপর অহেতুক হামলা চালায়। শুক্রবার সকালে উখিয়ার বালুখালী ক্যাম্পে এ ঘটনা ঘটে। রোহিঙ্গাদের হামলায় শুক্কুর নামের এক কিশোরের মাথা ফেটে যায়। স্থানীয়রা তাকে উদ্ধার করে উখিয়া হাসপাতালে ভর্তি করে। সে ওই এলাকার ভুট্টো ওরফে বালু ভুট্টোর পুত্র। প্যানেল চেয়ারম্যান নুরুল আবছার চৌধুরী বলেন, রোহিঙ্গাদের কারণে স্থানীয় গ্রামবাসী এখন আর মোটেও নিরাপদ নয়। যত দ্রুত সম্ভব তাদের প্রত্যাবাসন নতুবা অন্যত্র সরিয়ে নেয়া দরকার হয়ে পড়েছে।
×