ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

দায়িত্ব নেয়ার ১১ মাসে সব নির্বাচন অনুষ্ঠানে উতরেছে ইসি

প্রকাশিত: ০৪:৫৪, ৩০ ডিসেম্বর ২০১৭

দায়িত্ব নেয়ার ১১ মাসে সব নির্বাচন অনুষ্ঠানে উতরেছে ইসি

শাহীন রহমান ॥ দায়িত্ব নিয়ে প্রায় ১১ মাস আস্থার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন কে এম নুরুল হুদার নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন। এই সময়ের মধ্যে দুটি সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনসহ কয়েকশ’ নির্বাচন এই ইসির অধীনে সম্পন্ন হয়েছে। এখন পর্যন্ত সবগুলো নির্বাচনেই আস্থার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে ইসি। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন আগামী বছরই হবে ইসির আসল পরীক্ষা। কারণ বছরের শুরু থেকেই তাদের ছয়টি সিটি করপোরেশন নির্বাচন পরিচালনা করতে হবে। এর মধ্যে ঢাকার উত্তর সিটিতেও তাদের নির্বাচন করতে হবে। জাতীয় নির্বাচনের আগে এসব নির্বাচন ইসির জন্য বড় ধরনের অগ্নিপরীক্ষা। আগামী বছরের শেষ নাগাদ অনুষ্ঠিত হবে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। জাতীয় নির্বাচন এই ইসির অধীনে কতটা গ্রহণযোগ্য হবে তাও নির্ভর করবে সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন পরিচালনার ওপর। বিশেষজ্ঞরা বলছেন সব ধরনের প্রভাবের উর্ধে থেকে আস্থার সঙ্গে সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন সম্পন্ন করতে পারলেই কেবল জনগণের কাছে তাদের আস্থা বৃদ্ধি পাবে। এছাড়া রাজনৈতিক দলের কাছেও গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পাবে বলে উল্লেখ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। এ বছর ফেব্রুয়ারিতে আনুষ্ঠানিক দায়িত্ব পালন শুরু করেন কেএম নুরুল হুদা নেতৃত্বাধীন বর্তমান নির্বাচন কমিশনের সদস্যরা। এর আগে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক গঠিত বাছাই কমিটির মাধ্যমে বাছাই করেই নিয়োগ দেয়া হয় প্রধান নির্বাচন কমিশনার কেএম নুরুল হুদা, অপর চার কমিশনার মাহবুব তালুকদার, শাহাদত হোসেন, রফিকুল ইসলাম ও কবিতা খানমকে। এর মধ্যে মাহবুব তালুকদার প্রশাসনে অতিরিক্ত সচিব, রফিকুল ইসলাম সচিব এবং কবিতা খানম জেলা ও দায়রা জজ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। শাহাদত হোসেন চৌধুরী ছিলেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল পদের অবসরপ্রাপ্ত সামরিক অফিসার। অপরদিকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কেএম নুরুল হুদা ছিলেন ১৯৭৩ ব্যাচের সরকারী কর্মকর্তা। দীর্ঘদিন ওএসডি থাকার পর ২০০৬ সালে সচিব হিসেবে অবসরে যান। নুরুল হুদার বাড়ি পটুয়াখালীতে। ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী এবং পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় এবং সংসদ সচিবালয় যুগ্মসচিব ও অতিরিক্ত সচিবের দায়িত্ব পালন করার অভিজ্ঞতা রয়েছে তার। রাষ্ট্রপতি গঠিত বাছাই কমিটি রাজনৈতিক দলের কাছ থেকে পাওয়া নামগুলো পর্যালোচনা করে কমিশনের দায়িত্ব পালনের জন্য ১০ জনের নাম সুপারিশ করে বাছাই কমিটি। এর মধ্যে গত ৬ ফেব্রুয়ারি একজনকে প্রধান করে মোট ৫ সদস্যের নির্বাচন কমিশন গঠন করেন রাষ্ট্রপতি। গত ১৫ ফেব্রুয়ারি তারা আনুষ্ঠানিক দায়িত্ব গ্রহণ করেন। দায়িত্ব পাওয়ার প্রথম থেকে জনগণের কাছে প্রশ্ন ছিল কতটা আস্থার সঙ্গে তারা দায়িত্ব পালন করতে পারবে এই ইসি। এই কমিশনের অধীনে আগামী নির্বাচন কতটা গ্রহণযোগ্য হবে। তবে আগামী জাতীয় নির্বাচন এখনো প্রায় এক বছর বাকি থাকলেও এখন পর্যন্ত এই কমিশনের অধীনে অনুষ্ঠিত সব নির্বাচনই সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়েছে। কোন রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে এসব নির্বাচনের গ্রহণযোগত্যা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়নি। দায়িত্ব নিয়েই এ কমিশনের অধীনে বড় নির্বাচন ছিল কুমিল্লা সিটি কপোরেশন নির্বাচন। সব জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে তারা সুষ্ঠুভাবেই ওই নির্বাচন সম্পন্ন করে। নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থী জয়লাভ করে। এ নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যা নিয়েও কোন পক্ষ থেকে প্রশ্ন তোলা হয়নি। কুমিল্লার পর গত ২১ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হয়েছে রংপুর সিটি নির্বাচন। এই নির্বাচনকে স্থানীয় সরকার পরিষদ নির্বাচনের ইতিহাসে সেরা বলে মন্তব্য করেছে ইলেকশন ওয়ার্কিং গ্রুপ নামে একটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠান (ইডব্লিউজি)। নির্বাচনের পর এক সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনের পক্ষ থেকে দাবি করা হয় সামগ্রিকভাবে এই নির্বাচন যেমন শান্তিপূর্ণ ও বিশ্বাসযোগ্য, তেমনি নির্বাচন কমিশনের ভূমিকাও প্রশংসার। নির্বাচন প্রশাসনকে নিরপেক্ষতা বজায় রেখে যথাযথ দক্ষতা ও পেশাদারিত্বের সঙ্গে ভোটগ্রহণ কার্যক্রম পরিচালনা করতে দেখা গেছে উল্লেখ করা হয়। প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক ড. আব্দুল আলীম বলেন, রংপুর সিটি নির্বাচন ছিল সামগ্রিকভাবে শান্তিপূর্ণ ও বিশ্বাসযোগ্য। ভোটাররাও ভয়ভীতির উর্ধে থেকে সুশৃঙ্খলভাবে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পেরেছেন। এই নির্বাচনকে আমরা সেরা স্থানীয় নির্বাচন বলতে পারি। দুটি সিটি কপোরেশনে নির্বাচন ছাড়াও এই ইসির অধীনে এ পর্যন্ত কয়েকশ’ নির্বাচন পরিচালনা করা হয়েছে। এসব নির্বাচনে বিচ্ছিন্ন দুয়েকটি ঘটনা বাদ দিলে অবাধ সুষ্ঠুভাবেই সম্পন্ন হয়েছে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন আগামী বছরে শেষ দিকে অনুষ্ঠিত হবে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। তার আগে আরও ছয়টি সিটি নির্বাচন এই অধীনেই সম্পন্ন করতে হবে। সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের ওপর নির্ভর করছে আগামী জাতীয় নির্বাচন কতটা সুষ্ঠুভাবে তারা সম্পন্ন করতে পারবে। দায়িত্ব নিয়েই জাতীয় নির্বাচনের প্রাথমিক প্রস্তুতি শুরু করে নির্বাচন কমিশন। এরই অংশ হিসেবে গত ১৬ জুলাই তারা জাতীয় নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করে। এতে নির্বাচনের আগের সাতটি গুরুত্বপুর্ণ বিষয় প্রাধান্য দিয়ে করণীয় নির্ধারণ করা হয়। সাতটি বিষয়ের মধ্যে রয়েছে নির্বাচন কমিশনের আইনী কাঠামোসমূহ পর্যালোচনা ও সংস্কার। নির্বাচন প্রক্রিয়া সহজ ও যুগোপযোগী করতে সংশ্লিষ্ট সবার পরামর্শ গ্রহণ, সংসদীয় এলাকার নির্বাচনী সীমানা পুনর্নির্ধারণ, নির্ভুল ভোটার তালিকা প্রণয়ন ও সরবরাহ, বিধি অনুসারে ভোটকেন্দ্র স্থাপন এবং নতুন রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন এবং নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের নিরীক্ষা। এছাড়াও সুষ্ঠু নির্বাচনে সংশ্লিষ্ট সবার সক্ষমতা বৃদ্ধির কার্যক্রম গ্রহণ করা। ওই অনুষ্ঠানে প্রধান নির্বাচন কমিশনার নুরুল হুদা বলেন, আগামী নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক এবং প্রভাবমুক্ত করার লক্ষ্যে নিয়ে এই কর্মপরিকল্পনা প্রকাশ করা হয়েছে। যে কোন প্রভাবের উর্ধে থেকে নিরপেক্ষভাবে নির্বাচন সম্পন্ন করতে নির্বাচনী কর্মপরিকল্পনা সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। রোডম্যাপের অংশ হিসেবে গত ৩১ জুলাই থেকে আইন বিধি সংশোধন এবং নির্বাচন সুষ্ঠু করার প্রয়োজনীয় পরামর্শের জন্য শুরু হয় সংলাপ। নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজ, গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব এবং অংশীজনদের সঙ্গে এই সংলাপ সম্পন্ন করেছে ইসি। সংলাপে অংশ নিয়ে প্রায় সব মহল থেকেই রাজনৈতিক দলের আস্থা অর্জনের পরামর্শ দেয়া হয়েছে। এছাড়াও সব ধরনের প্রভাবের উর্ধে থেকে নির্বাচন পরিচালনা করার আহ্বান জানানো হয়। সংলাপ শেষে এক অনুষ্ঠানে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেন, দায়িত্ব পালনকালে কোন মহল থেকে এখন পর্যন্ত কোন চাপ আসেনি। সুষ্ঠুভাবে তারা দায়িত্ব তারা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আগামী নির্বাচনে সব ধরনের প্রভাবের উর্ধে থেকে পরিচালনা করার আশাবাদ ব্যক্ত করেন। ইতোমধ্যে ঢাকা উত্তর সিটি মেয়র আনিসুল হকের মৃত্যুতে এই সিটির উপনির্বাচনের প্রস্তুতি শুরু করেছে ইসি। আইন অনুযায়ী ফেব্রুয়ারি মাসের ২৮ তারিখের মধ্যেই নির্বাচন সম্পন্ন করতে হবে। এই নির্বাচন নিয়ে আইনী জটিলতা থাকলেও জানুয়ারি প্রথম সপ্তাহেই উত্তর সিটির উপনির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হবে বলে জানিয়েছেন ইসির ভারপ্রাপ্ত সচিব হেলাল উদ্দিন আহমেদ। ফেব্রুয়ারি ২৪ অথবা ২৫ তারিখের মধ্যে নির্বাচনের প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে বলে জানা গেছে। এর পরে রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল, সিলেট এবং গাজীপুর সিটি নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরু হবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন জাতীয় নির্বাচন আগে এসব নির্বাচন ইসির জন্য অগ্নিপরীক্ষা। এখন দেখার বিষয় কতটা আস্থার সঙ্গে তারা এসব নির্বাচন পরিচালনা করতে সক্ষম হন। তবে প্রথম বছরের অগ্নিপরীক্ষায় তারা সফলতার সঙ্গে উতরে গেছেন। বিশেষজ্ঞদের মতে বাকিটা নির্ভর করছে ভবিষ্যত কর্মকা-ের ওপর।
×