ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

নড়াইলে জমে উঠেছে সুলতান মেলা ॥ চলছে নৃত্য ও সঙ্গীত

প্রকাশিত: ০৪:১৬, ৩০ ডিসেম্বর ২০১৭

নড়াইলে জমে উঠেছে সুলতান মেলা ॥ চলছে নৃত্য ও সঙ্গীত

রিফাত-বিন-ত্বহা, নড়াইল থেকে ॥ মা, মাটি ও মানুষের শিল্পী সুলতান স্মরণে নড়াইলে ১০ দিনব্যাপী ‘সুলতান মেলা’-২০১৮ জমে উঠেছে। শুক্রবার ছুটির দিনে মেলা প্রাঙ্গণে দর্শনার্থীর ভিড় জমে যায়। প্রতিদিন সন্ধ্যায় মেলায় ৩৪ সাংস্কৃতিক সংগঠনের শিল্পীরা সঙ্গীত, নৃত্যসহ মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশন করছেন। শীতের সন্ধ্যায় সুলতান মঞ্চে শিল্পীদের সুরের স্রোতধারায় শহরে প্রাণের স্পন্দন ফিরে এসেছে। নানা বয়সীর সঙ্গে শিশু-কিশোরের উপস্থিতি ছিল লক্ষণীয়। মেলা প্রাঙ্গণে শিশুদের বিনোদনের জন্য নাগরদোলাসহ বিভিন্ন বিনোদনের ব্যবস্থা রয়েছে। এ ছাড়া প্রতিদিন থাকছে চিত্র প্রদর্শনী ও গ্রামীণ ক্রীড়া উৎসব। মেলায় শতাধিক দোকানি বিভিন্ন পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসেছে। শিশু থেকে শুরু করে সব বয়সী-নারী পুরুষের জন্য কসমেটিক, হস্তশিল্প, কুঠিরশিল্পসহ নানা ধরনের পণ্য রয়েছে এসব দোকানে। এদিকে,সুলতানের ৯৩তম জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে আয়োজিত ‘সুলতান মেলা’ সমাপনী দিন আগামী ৪ জানুয়ারি ‘সুলতান পদক’ প্রদান করা হবে। এ বছর সুলতান পদক পাচ্ছেন শিল্পী ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী। ১০ আগস্ট ছিল বিশ্ববরেণ্য চিত্রশিল্পী এসএম সুলতানের ৯৩তম জন্মজয়ন্তী। কিন্তু শোকের মাসের কারণে প্রতিবছরের মতো এবার অনুষ্ঠান পিছিয়ে ২৬ ডিসেম্বর করা হয়। সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় এসএম সুলতান ফাউন্ডেশন ও জেলা প্রশাসনের আয়োজনে গত মঙ্গলবার থেকে নড়াইলের ভিক্টোরিয়া কলেজ মাঠের সুলতান মঞ্চে ১০ দিনব্যাপী ‘সুলতান মেলা’ উদ্বোধন করা হয়। এবারের মেলায় মূর্চ্ছনা সঙ্গীত নিকেতন, গ্রেভ শিল্পীগোষ্ঠী,মৃত্তিকা শিল্পচর্চা কেন্দ্র, লাল বাউল সম্প্রদায়, নাচের সংগঠন নৃত্যায়নসহ ৩৪ সাংস্কৃতিক সংগঠনের শিল্পীরা সঙ্গীত, নৃত্যসহ মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশন করবেন। এ ছাড়া প্রতিদিন থাকছে গ্রামীণ ক্রীড়া উৎসব ও চিত্র প্রদর্শনী। এবারের মেলায় ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার ৬৯ চিত্রশিল্পী এবং নড়াইলের ৩৯ খুদে শিল্পীর চিত্রকর্ম প্রদর্শনীতে স্থান পেয়েছে। মেলা প্রাঙ্গণে শিশুদের বিনোদনের জন্য নাগরদোলাসহ বিভিন্ন বিনোদনের ব্যবস্থা রয়েছে। মেলায় শতাধিক দোকানি বিভিন্ন পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসেছে। শিশু থেকে শুরু করে সব বয়সী নারী-পুরুষের জন্য কসমেটিক, হস্তশিল্প, কুঠিরশিল্পসহ নানা ধরনের পণ্য রয়েছে এসব দোকানে। সমাপনী দিন আগামী ৪ জানুয়ারি সুলতান পদক প্রদান ও সমাপনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি থাকবেন যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী ড. বীরেন শিকদার। শিল্পী সুলতানের গায়ের রং সাদা-লালচে ছিল বিধায় বাবা তার নাম রেখেছিলেন লাল মিঞা। শিল্পীর জন্মের কয়েক বছরের মধ্যেই শিল্পী সুলতান মা হারা হবার কারণে প্রায় সময় বাবার কাছে কাছে থাকতেন। রাজমিস্ত্রি বাবার সঙ্গে বাড়ির পাশের জমিদারবাড়িতে যেতেন। বাবার সুনিপুণ হাতে গড়া জমিদারবাড়ির কারুকার্যখচিত বিরাট দালান, সুউচ্চ মিনার, নক্সা, সিংহদ্বারে অঙ্কিত নানান চিত্র, মূর্তি দেখে বিস্ময়ের সঙ্গে তাকিয়ে থাকতেন লাল মিঞা। মনের অজান্তে মাটির ওপর আঁচড় টেনে সুন্দর সুন্দর ছবি আঁকতেন। শিশু, বৃক্ষ, মানুষ, প্রকৃতি সবকিছুর প্রতিই তার অফুরন্ত ভালবাসা। শুধু রং-তুলির স্পর্শে এরমধ্যে তিনি সৌন্দর্য অন্বেষণ করেননি, বাস্তবেও প্রমাণ দিয়েছেন ভালবাসার। তাই ঢাকার ফুটপাথ থেকে দুর্লভ নাগলিঙ্গম বৃক্ষ নিধন হতে দেখে তার চোখ প্ল­াবিত হয়েছিল। বলতেন, এ তো একটি বৃক্ষের নিঃশেষ নয়, গোটা জীবনের পরিসমাপ্তি। সারা জীবনের সমস্ত সঞ্চয় তিনি ব্যয় করেন শিশুদের কল্যাণে নির্দ্বিধায়। সেই মহান মানুষটি হলেন বিশ্ববরেণ্য চিত্রশিল্পী এসএম সুলতান। শিল্পী জন্মেছিলেন সবুজ স্নিগ্ধতায় ছাওয়া নড়াইলের উপকণ্ঠে। ১৯২৩ সালের ১০ আগস্ট। সহজ, সরল, অনাড়ম্বর জীবনের আবহ তাই শিল্পী পেয়েছিলেন শৈশবেই। স্কুলে পড়ার সময় ড. শ্যামা প্রসাদের বক্তৃতাদানরত ছবি একে প্রশংসা পেয়েছিলেন। ’৪১ সালে ভর্তি হন কলকাতা আর্ট স্কুলে। চার শ’ প্রতিযোগীর মধ্যে ভর্তি পরীক্ষায় অঙ্কনে প্রথম স্থান অধিকার করেন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বাঁধাধরা গ-ি তার কাছে ছিল আকর্ষণহীন। ’৪৩-এ সেখান থেকে পলায়ন। সারা ভারত পরিভ্রমণ। আর এ সময় অজস্র ছবি আঁকার কাজও চলে। ’৪৪-এ সিমলায় একক চিত্র প্রদর্শনী। দ্বিতীয় একক চিত্র প্রদর্শনীও এখানে ’৪৬ সালে। লাহোর ও করাচিতে একক চিত্র প্রদর্শনী ’৪৭, ৪৮ ও ৪৯ সালে। করাচিতে ‘ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল এডুকেশন’ আয়োজিত (৪৯) ৪৫ দেশের শিল্পীরা চিত্র প্রদর্শনীতে অংশ নেন। এরমধ্যে শিল্পী সুলতানের ছবি শ্রেষ্ঠ হিসেবে পুরস্কৃত। কিন্তু একদিন সেখানে ৪শ’ ছবি রেখে আবার পৃথিবীর পথে বেরিয়ে পড়া। ১৯৫০ সালে লন্ডন যান। সেখানে ৪টি একক চিত্র প্রদর্শনীর ব্যবস্থা। এশিয়ার একমাত্র ‘কনটেম্পোরারি মাস্টার’ উপাধিতে ভূষিত হন আর্ট গ্যালারি এ্যাসোসিয়েশন কর্তৃক। পরের বছর নিউওয়র্কে পাবলো পিকাসো, সালভাদর দালি, র্যা বেথ ক্লি প্রমুখ শ্রেষ্ঠ শিল্পীর চিত্রকর্মের সঙ্গে সুলতানের চিত্রকর্ম প্রদর্শনী। দেশে আসেন ১৯৫৩ সালে। নড়াইলে পরের বছর নন্দনকানন আর্ট স্কুলের প্রতিষ্ঠা। ১৯৬৯ এ প্রতিষ্ঠা চারুকলা ইনস্টিটিউটের। যশোরে একাডেমি অব ফাইন আর্টস প্রতিষ্ঠা ১৯৭৩ সালে। বর্তমানে যা চারুপীঠ। বাংলাদেশে ১৯৭৬ সালে ঢাকার শিল্পকলা একাডেমিতে শিল্পী সুলতানের একক চিত্র প্রদর্শনী। ১৯৮১ সালে শিল্পকলা একাডেমির আবাসিক আর্টিস্ট হিসেবে মনোনয়ন। ঢাকাতে দ্বিতীয় একক চিত্র প্রদর্শনী ১৯৮২ সালে। ওই বছরই নড়াইলে শিশু স্বর্গর উদ্বোধন। ১৯৮৩ সালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত ইন্টারন্যাশনাল বায়োগ্রাফিক্যাল সেন্টার ওই বছরের বিশ্বের সেরা কৃতী মানব হিসেবে আখ্যা দেয় তাকে। ঢাকার জার্মান কালচারাল ইনস্টিটিউটে তৃতীয় একক চিত্র প্রদর্শনী হয় ১৯৮৭ সালে। ১৯৮৮ সালে তিনি পান একুশে পদক। ১৯৯৩ সালে ঢাকায় আর্ট খ্যাতনামা শিল্পীর পাশাপাশি সুলতানের চিত্রকর্মও প্রদর্শিত হয়। চির কুমার শিল্পী ছবি এঁকেছেন দু’হাতে।
×