ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

রায়হান আহমেদ তপাদার

বই বিতরণের প্রত্যাশা হোক মানসম্পন্ন শিক্ষা

প্রকাশিত: ০৩:৩০, ৩০ ডিসেম্বর ২০১৭

বই বিতরণের প্রত্যাশা হোক মানসম্পন্ন শিক্ষা

কথায় আছে- জ্ঞানের কোন সীমা নেই, চৌহদ্দি নেই। জ্ঞান অসীম, অফুরন্ত, যা কোন পাঠে বা দানে হ্রাস পায় না; বরং যত জ্ঞান লাভ করা যায় ততই মনের শ্রীবৃদ্ধি ঘটে। একটু নিরীক্ষণ করলেই আমরা দেখতে পাই- কোন যুগেই বই পাঠের বিকল্প ছিল না, ভবিষ্যতেও থাকবে না। উন্নত দেশের অভিজ্ঞতার আলোকে বলা যায়- শিক্ষা ও মানবসম্পদ উন্নয়নে বিনিয়োগ কখনও বিফলে যায় না; বরং এটি দেশের অমূল্য সম্পদ হিসেবে ফিরে আসে। বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও জ্ঞানে উৎকর্ষ অর্জন বড় মাপের উন্নয়নের পক্ষে সবচেয়ে টেকসই ভিত হিসেবে কাজ করে। ১৯৯০ সালের পর সামরিক শাসন-উত্তর যে সকল সরকার ক্ষমতায় এসেছে সবাই মানবসম্পদ উন্নয়নে গভীর মনোযোগ দেয়ার জন্য ধন্যবাদ পেতে পারে। এ সময় প্রশংসনীয় যে উদ্যোগগুলো নেয়া হয় তার মধ্যে আছে ২০২০ সালের মধ্যে সবার জন্য শিক্ষা, প্রাথমিক ও জুনিয়র স্তরে বিনা বেতনে পড়ার সুযোগ, মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত বিনামূল্যে বই সরবরাহ ও মেয়েদের জন্য উপবৃত্তির ব্যবস্থা। আর মাত্র কয়েকদিন। তারপরই ফুরাবে শিশুদের অপেক্ষার পালা। আগামী ১ জানুয়ারি নতুন শিক্ষাবর্ষের প্রথম দিনে বিদ্যালয়ে গিয়ে কোমলমতি শিক্ষার্থীরা হাতে পাবে ঝকঝকে নতুন পাঠ্যবই। নতুন বইয়ের সোঁদা গন্ধে মাতোয়ারা হবে শিশুরা। বই হাতে উল্লাস করতে করতে বাড়ি ফিরবে কোমলমতি শিক্ষার্থীরা। তাদের জন্য ৩৫ কোটি পাঠ্যবই ছাপার কাজ প্রায় শেষ করে এনেছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড। এরই মধ্যে তা জেলা ও উপজেলা হয়ে পৌঁছে গেছে স্কুলে স্কুলে। অতি সামান্য কিছু বই ছাপার কাজ বাকি। প্রতি বছর জানুয়ারির প্রথম দিন প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন বই তুলে দিয়ে বই উৎসব উদযাপিত হয়। নতুন বছরের প্রথম দিন ছাত্রছাত্রীরা হাতে নতুন বই পেলে আনন্দে উদ্বেলিত হয়। তাতে পড়াশোনার প্রতি আরও বেশি আগ্রহ জন্মে। সেজন্যই বই উৎসব শিক্ষার্থী, শিক্ষক, অভিভাবকসহ সংশ্লিষ্ট সবার মধ্যে ব্যাপক আগ্রহের সৃষ্টি করে। এ বছরও পহেলা জানুয়ারি বই উৎসব পালন করা হবে। সেই লক্ষ্যে প্রস্তুতিও শুরু করেছে সরকার। মানবকণ্ঠের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ বছর প্রথমবারের মতো ঢাকার ছাপাখানা থেকে সরাসরি বই পৌঁছে দেয়া হচ্ছে প্রাইমারি স্কুলগুলোতে। এ কারণে শিক্ষকদের বই নিয়ে বাড়তি ঝামেলায় পড়তে হচ্ছে না। ইতোমধ্যে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের স্কুলগুলোতে বই পৌঁছতে শুরু করেছে। যার ফলে বছরের প্রথম দিন আবারও শিশুরা নতুন বই হাতে মেতে উঠতে পারবে বই উৎসবে। আরও এক প্রতিবেদনে বরিশাল বিভাগের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে বই পৌঁছানোর কথা উল্লেখ করে বলা হয়েছে- এবারে বরিশাল বিভাগের ৬ জেলায় ৬ হাজার ৬৭৩টি স্কুলের বিপরীতে চাহিদা রয়েছে ৫৬ লাখ ৪৮ হাজার ২৯১টি বই। যার মধ্যে শতকরা ৯৬ ভাগ বই ইতোমধ্যে পৌঁছে গেছে। উল্লেখ্য, বরিশাল বিভাগের মতো সারাদেশের সবখানেই যথাসময়ে বই পৌঁছে গেলে সার্থক হবে বই উৎসব। এ জন্য সবখানে সময়মতো বই পৌঁছানোর ব্যাপারেও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। কোথাও কোথাও যদি বছরের প্রথম দিন বই পৌঁছানো না-ও যায় তাহলে যথাসম্ভব দ্রুত তা যেন পৌঁছে সেই ব্যবস্থা করতে হবে। সেইসঙ্গে শুধু বই পৌঁছে দেয়া বা বই উৎসবই নয়, সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যেন ক্লাস ও পরীক্ষা ঠিকমতো অনুষ্ঠিত হয়, প্রশ্ন ফাঁসের কলঙ্ক যেন কোথাও ছাপ না ফেলে তা নিশ্চিত করতে হবে। আরও একটি দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, নিম্নমানের এবং পুনর্প্রক্রিয়াকৃত কাগজে তৈরি পাঠ্যপুস্তক উষ্ণ ও আর্দ্র আবহাওয়ার পক্ষে অতি সংবেদনশীল এবং এ ধরনের আবহাওয়াই বাংলাদেশে সাধারণত বিরাজমান। উষ্ণ ও শুষ্ক আবহাওয়ায় পাঠ্যবইয়ের পাতার বহির্ভাগ শক্ত হয়ে আটকে যায় এবং আপনা-আপনি খুলে আসে অথবা হলদে বা বিবর্ণ হয়ে যায়। আর আর্দ্র আবহাওয়ায় বইয়ের পাতা সিক্ত হয়ে ওঠে এবং আলতো স্পর্শেই আলগা হয়ে যায়। এর ফলে বইটি একেবারে নষ্ট না হয়ে গেলেও এর ব্যবহারের সুযোগ বহুলাংশে কমে যায়। যেহেতু এসব পাঠ্যপুস্তকের ব্যবহারকারীরা প্রত্যন্ত ও গ্রামাঞ্চলে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকে এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তারা প্রয়োজনীয় যত্ন নিতে পারে না বা বাজারে গিয়ে নতুন বই কেনার সুযোগ থাকে না। যার ফলে পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে গিয়ে তারা সমস্যায় পড়ে। এর ফলে বিনামূল্যে বই বিতরণের সরকারী উদ্যোগটি আসলেই অর্থহীন হয়ে যায়। দেখতে ভাল, দীর্ঘস্থায়ী, পড়ায় আরামদায়ক- এমন বই সহজে স্থানীয়ভাবেই তৈরি করা গেলে ভাল হয়। যদি প্রকাশনা ও বিতরণের দায়িত্বে থাকা সরকারের সংস্থাগুলো এ বিষয়ে সচেষ্ট থাকে এবং তাদের প্রয়োজনীয় সহায়তা দেয়া হয় তবে ভাল মানের বই সরবরাহ করা সম্ভব হয়, যা শিশু শিক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা যায়। দেখা যায় কিছু প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান শুধু বাণিজ্যের জন্য এনসিটিবির এ কাজের দিকে তাকিয়ে থাকে এবং কাগজের নির্ধারিত মান, উন্নত মুদ্রণ এবং বইয়ের সময়োচিত সরবরাহের দিকে তাদের কোন ধরনের মনোযোগ থাকে না। আধুনিক সভ্যতা শুরুর অনেক আগে থেকেই মানুষ বই পড়ে। বই সর্বাবস্থায়ই আমাদের সহায়ক শক্তি। বই জীবনকে আলোকিত করে, বিকশিত ও পরিপূর্ণ করে। বই থেকে আমরা যা গ্রহণ করি তা জ্ঞান, প্রজ্ঞা কিংবা বিদ্যা। বই ছাড়া এর কোনটাই সম্ভব নয়। যদি প্রশ্ন করা হয়, কেন বই পড়ব? জবাবে বলব, বই পড়ব জ্ঞান বিকাশ, জ্ঞানপিপাসা ও জ্ঞানজিজ্ঞাসা মেটানোর জন্য। বই পড়ব ভদ্র, শালীন, মার্জিত ও সংস্কৃতিবান হওয়ার জন্য। সর্বোপরি বই পড়ব পরিপূর্ণ মানুষ হওয়ার জন্য। কোমলমতি শিশুদের শৈশবকে রঙিন করছে পাঠ্যবই। নতুন বইয়ের ঘ্রাণ চিনতে এখন আর ভুল হয় না শিক্ষার্থীদের। বছরের শুরুর দিনে সরকার বিনামূল্যে বই দেবে এ সহজ হিসাবও তাদের মুখস্থ। কারণ সরকার বই দেয়ার বিষয়টিকে এখন রেওয়াজে পরিণত করেছে। আজ সন্তানের হাতে নতুন বই দেখে খুশি হচ্ছেন মা-বাবা। আগে নতুন বছরে এসে মার্চ-এপ্রিল নাগাদ নতুন বই পাওয়া যেত, তাও টাকা দিয়ে কিনতে হতো। কিন্তু এখন দিন বদল হয়েছে। আর এ পরিবর্তনের দিশারী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। যার দূরদর্শী চিন্তার কারণে বছরের শুরুর দিনে নগর থেকে গ্রাম সর্বত্রই বই উৎসবের আমেজ। এ দৃশ্য ভাল লাগার, এ দৃশ্য ভালবাসার। বিনামূল্যে পাঠ্যবই বিতরণের আট বছরে সরকারের অর্জন অনেক। যার স্বপ্ন দেখেছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এবার সাড়ে চার কোটি শিশুর হাতে তুলে দেয়া হচ্ছে ৩৬ কোটিরও বেশি বই। যাদের হাতে বই তুলে দেয়া হচ্ছে এই শিশুরাই তো বাংলাদেশের ভবিষ্যত। তাদের জনসম্পদে পরিণত করছে সরকার। একযুগ আগেও বিনামূল্যে পাঠ্যবই বিতরণ ছিল কল্পনাতীত। কিন্তু সেই অসাধ্য সাধন করেছে শেখ হাসিনার সরকার। বই উৎসবের মতোই রঙিন হয়ে উঠুক প্রতিটি শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবন। বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণের একটি সামগ্রিক ইতিবাচক প্রভাব শিক্ষা ব্যবস্থায় পড়ুক, উন্নত হোক শিক্ষাব্যবস্থা, উন্নত হোক দেশ। লেখক : প্রবাসী [email protected]
×