ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

স. ম. শামসুল আলম

কাব্যনাট্য কারিগর সৈয়দ শামসুল হক

প্রকাশিত: ০৬:২৬, ২৯ ডিসেম্বর ২০১৭

কাব্যনাট্য কারিগর সৈয়দ শামসুল হক

(পূর্ব প্রকাশের পর) চম্পা ঠিকই গয়ার সাপে কাটা হাত চুষে চুষে গয়াকে বাঁচায় এবং নিজে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। সবশেষে বর্ণনা গীত হয়। পঙ্খী উইড়া গেছে পঙ্খী আসমান দিয়া যায়। আসমান দিয়া যায় রে পঙ্খী নীল নিলক্ষায়। ‘মরা ময়ূর’ কাব্যনাটকটি কেন যেন আমার কাছে অতটা ভালো লাগেনি। অবশ্য আমার ভালো লাগা-না লাগায় কিছু এসে যায় না। সৈয়দ হকের কাব্য নৈপুণ্য সবসময় তাঁর প্রবল ইচ্ছেশক্তির মতোই শক্তিশালী। রাস্তায় একটা মরা ময়ূর পড়ে থাকাকে কেন্দ্র করে নাটকটি এগোলেও এর মধ্যে রাজনীতি, সমাজ, দেশ সবই বিধৃত হয়েছে। নাটকের লোক চরিত্রের স্ত্রী (নারী চরিত্রটি) নোংরা বলেই হয়তো তাকে ময়লার গাড়িতে নিয়ে গেল সর্দার ও লোকটি। হয়তো বুঝানো হচ্ছে নোংরা সবকিছু আঁস্তাকুড়েয় যাক। খুব সংক্ষিপ্ত কাব্যনাট্য ‘মরা ময়ূর’ আলো-আঁধারের ভোরের মতোই স্বল্প-উজ্জ্বল। সৈয়দ হকের ‘অপেক্ষমাণ’ কাব্যনাট্যে সমাজের অনেকগুলো দিক উন্মোচিত হয়েছে। প্রেম, বিচ্ছেদ, রাজনীতি, হতাশা, ঈর্ষা, ক্রোধ ইত্যাদি। হেনরিক ইবসেন ও সৈয়দ হককে একাকার করে কোরাস দিয়ে শুরু হয় আবার একইভাবে কোরাস দিয়ে শেষ হয় নাটকটি। শেষ দৃৃশ্যে দেখা যায় ইবসেন ও সৈয়দ হক পরস্পরের উল্টো দিক দিয়ে বেরিয়ে যান। পূর্বেই উল্লেখ করেছি সৈয়দ হক বিদেশী নাটককে আমাদের দেশীয় ভঙ্গিমায় অত্যন্ত কৌশলে বিনির্মাণ করেছেন। ডাক্তারের একটি সংলাপে সত্যকে এভাবে ধারণ করেছেন মুকুট নয়! বলো, সত্যের ভেতরে দাঁড়িয়ে আছি। সত্য কাউকে মুকুট পরায় না। সত্য মানুষকে বিকশিত করে। সত্য মানুষকে মুক্ত বায়ুতে নিশ্বাস নিতে দেয়। রেল স্টেশনের প্ল্যাটফরমে দাঁড়িয়ে অপেক্ষমাণ-এর পুরো ঘটনা বর্ণিত হয়। একই কুশীলব দিয়ে বিভিন্ন চরিত্রে রূপদান বিষয়টি লেখক নিজেই স্পষ্ট করেছেন। যা হোক, কিছু সংলাপ ‘ঈর্ষা’ কাব্যনাট্য থেকে হুবহু নেয়া হয়েছে যা দেখে প্রথমে একটু ভাবনায় পড়েছি; পরে ভেবেছি এটা হয়তো নাটকটিকে পূর্ণতা দিতেই ব্যবহার করা হয়েছে এবং এমনটি হতেই পারে যেহেতু ঈর্ষা অপেক্ষমাণের দেড় যুগ আগে রচিত। তেমন একটি কমন সংলাপ দুজনের মাঝখানে একটি যুবক আজ? প্রতিদ্বন্দ্বী এখন যুবক আমারই একজন ছাত্র? যাকে আমি নিজ হাতে ব্রাশ ধরে টান-টোন শিখিয়েছি? সে তোমাকে নগ্ন করে দেখেছে কি? এরই মধ্যে শোয়া হয়ে গেছে? তারপরও ব্যতিক্রম। এই ব্যতিক্রম কিছু করা সৈয়দ হকের পক্ষেই সম্ভব। মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে রচিত ‘উত্তরবংশ’ কাব্যনাট্যে হত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতনের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে তিনটি প্রধান চরিত্রের মাধ্যমে। চরিত্র তিনটি হলো নাট্যকার, নেতা ও নাট্যকারের মেয়ে। নাটকের শেষ দিকে এসে আন্দোলনের প্রশ্ন ওঠে অর্থাৎ সেই একাত্তরের ঘটনার জন্য অপরাধীদের বিচারের দাবি জোরালো হয়। নাট্যকারের স্ত্রীকে ধরে নিয়ে মিলিটারিরা বাংকারে রেখে ধর্ষণ করে এবং তাঁর স্ত্রী কখনও স্বাভাবিক হয়নি। ১৯৮০ সালে মেয়েকে জন্ম দিলেও এর তিন বছর পর আত্মহত্যা করে। মেয়ে এই আত্মহত্যার কারণ জানতে চায় পিতার কাছে কিন্তু নানা অজুহাতে নাট্যকার এড়িয়ে যান এবং বলেন যে তিনি নিজেই দায়ী। নেতার সঙ্গে তাঁর আলাপকালে ঘটনাটা মেয়ে জেনে যায়। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ক্ষমতাসীনরা ইতিহাস লেখার জন্য নেতা নাট্যকারকে তাগাদা দেন। নাট্যকার চেষ্টাও করেন। যেমন শুরু করেন এই বলে শীতের নিষ্ঠুর থাবা হিম নীল বরফের দাঁত মৃতপ্রায় পাখিরা উড়াল দিয়ে যাত্রা করেছিলোদূর দক্ষিণের দিকে যেখানে সবুজ ঘাস, বসন্তের দিন দুগ্ধবতী নদীর নিকটে তারা পৌঁছে প্রায় গিয়েছিলো অতি অকস্মাৎ হঠাৎ আছড়ে পড়ে গুলিবিদ্ধ বুকে। এমন কাব্যিক রচনা সৈয়দ হকের কলমে উদ্ভাসিত হয় নানা আঙ্গিকে, নানা বর্ণনায়, নানা ব্যঞ্জনায়। উত্তরবংশ নাটকে নাট্যকারের মেয়ে ঠিকই গর্জে উঠেছে কিসের আপনার বেঁচে থাকা? আপনিও তো মৃত আপনার আদর্শ আজ ধর্ষিত চেতনার জানু বেয়ে রক্ত ঝরছে আমরা আর সময়কে পার হয়ে যেতে দেবো না। যে-বিচার আপনারা করতে পারেননি, আমরাই করবো। সৈয়দ শামসুল হক রচিত যে দশটি কাব্যনাট্য নিয়ে এখানে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হলো সেই নাটকগুলো নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার সুযোগ রয়েছে। এই রচনাটিকে অবশ্য আলোচনা না বলে কাব্যনাট্য-পরিচিতি বলাই ভালো। পাঠক এক দৃষ্টিতেই সৈয়দ হকের কাব্যনাট্য সম্পর্কে সম্যক ধারণা পাবেন। (শেষ)
×