ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সারা কানাডার ওপর দিয়ে উড়ে বেড়িয়ে সত্যি বিস্মিত হলাম -ড. চিত্তরঞ্জন দাশ

বাল্টিক সাগর থেকে রকি মাউন্টেন

প্রকাশিত: ০৬:০৮, ২৯ ডিসেম্বর ২০১৭

বাল্টিক সাগর থেকে রকি মাউন্টেন

(পূর্ব প্রকাশের পর) ভ্যানকুভার হারবার বিনোদনের একটা চমৎকার যায়গা তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ থাকার কোন অবকাশ নেই। সেই হারবার ধরে হাঠতে গিয়ে সাগরের মোহনা, বড় বড় ক্রুসশিপ, বাহারী নক্সার আকাশচুম্বী দালান কোঠা ও দূরের পাহাড় গুলি দেখে ভাল লাগবে না এমন মানুষ কমই পাওয়া যায়। সামনে তাকাচ্ছি আর হাঠছি, হঠাৎ চোখের সামনে নেমে পড়ল একটা সি প্লেন জলের উপর। সাধারণত দুই থেকে চার সিটের এই প্লেন কানাডায় বেশ চোখে পড়ল। হোয়েটহর্সের লেকগুলোতে যেমন ভাসতে দেখেছিলাম এখানেও তেমনটি দেখলাম। অনুমান করা যায় ধনী ব্যক্তিদের সংখ্যা নিতান্ত কম নয়। এই হারবারের স্মৃতি ধরে রাখতে দুই একটা ছবি না তুলে কি পারা যায়। কিন্তু এখনও সারপ্রাইজ হওয়ার মতো কিছুই তো চোখে পড়ছে না। অবশ্য বেশি সময় অপেক্ষার প্রহর গুণতে হলো না। চোখে পড়ল ফ্লাইওভার কানাডা। সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে দীর্ঘ লাইনটাকে দীর্ঘতর করে তাপোস দাঁড়িয়ে গেল। আমরা ওকে অনুসরণ করতে গেলে বলল-তার প্রয়োজন হবে না, আপনারা দাঁড়ান ওদিকে গিয়ে। ওর অনেক খরচ হয়ে যাচ্ছে কিন্তু কিছুতেই বিরত রাখা গেল না। সেই কফি থেকে শুরু করে সবটাই সে অভিভাবকের শাসনের শুরে করে চলেছে। সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ হলো এবার ভিতরে প্রবেশের অপেক্ষা মাত্র। অনেক লম্বা লাইন দেখে বুঝতে পারলাম আসলেই ফ্লাইওভার কানাডা ভ্যানকুভারের বাসিন্দা এবং পর্যটকদের কাছেও বিশেষ আকর্ষণের একটা বিষয়। যাহোক সকলের সঙ্গে আমাদেরও যাত্রা শুরু হলো আর এক তলা উপরে তুলে একটা অডিও ভিসওয়াল শোর মাধ্যমে। এটাই নাকি ফ্লাইটে চড়ার পূর্ব প্রস্তুতি। সকলকে শারীরিক ও মানষিকভাবে তৈরি হওয়ার স্থান। গোলাকার ফ্লোরের কোথায়ও বসার কোন ব্যবস্থা নেই। সকলেই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চতুরদিকের দেয়ালে প্রদর্শিত কানাডার বিষ্ময়কর প্রাকৃতিক, ওয়াল্ড লাইফ, ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক, ধারাবাহিক উন্নয়নের এবং আবিষ্কারের ডকুমেন্টারির ভিডিও চিত্র দেখতে দেখতে অনেকটা সময় পেরিয়ে গেল। এরপর ডাক পড়ল বোডিং জোনে যাওয়ার। লাইন দিয়ে চলে গেলাম বোডিং জোনে। অর্ধ বৃত্তাকারে একটার সঙ্গে আর একটা লাগানো চেয়ার। সামনে তিন চার ফুট উঁচু স্টিলের একটা দেওয়াল। দেওয়ালের পিছনে গাড় অন্ধকার কিছুই দেখার উপায় নেই। একজন মহিলা গাইড এসে দেখে গেলেন সিট বেল্ট যথাযথভাবে বাঁধা হয়েছে কিনা। আগে থেকেই সকলকে সতর্ক করা হয়েছে যাদের ¯স্নায়ু দুর্বল, ব্লাড প্রেসারের সমস্যা আছে তাদের এই ফ্লাইটে না চড়তে। হঠাৎ মহিলা ঘোষণা দিলেন ফ্লাইট ইজ এবাইট টু টেক অফ, এনজয় দি জারনি। সামনের স্টিলের দেওয়ালটা সরে গেল। গাড় অন্ধকার, সামনে মহা সমুদ্র। এক ধাক্কায় কোথায় যে উড়ে গেলাম, কিছুই বুঝতে পারলাম না। সামনে বিশাল আকৃতির পর্দায় ভেসে আসল প্রকা- এক পাহাড়। পাহাড় ছুটে আসছে প্রচ- গতিতে, এই বুঝি পাহাড়ে ধাক্কা খেলাম। না মুহূর্তেই কোথায় হারিয়ে গেল। চলে আসল সিএন টাওয়ার, এই ধাক্কা খেলাম বলে। শ্বাসরুদ্ধকর একটা পরিবেশের মধ্যে বিপদের আশঙ্কা প্রতি মুহূর্তেই যেন তাড়া করে ফিরছে। ঝড়ের বেগে কানাডার এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত উড়ে যাচ্ছি আর পাখির চোখে দেখছি একটার পর একটা শহর, বন্দর, ল্যা-স্কেপ, পাহাড় পর্বত, বন্য পশু, পাখি, জীব জন্তুু সবই। এমন পরিবেশ তৈরি করা হয়েছে যেন মনে হবে সত্যিই আমরা আকাশে উড়ে বেড়াচ্ছি। কখনও কুয়াশার মধ্যে ডুবে যাচ্ছি, বাতাসে জামা কাপড় উড়ে যাওয়ার উপক্রম, কখনও জলের ঝাপটা এসে চোখ মুখ ভিজিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। এর সঙ্গে বসে থাকা চেয়ারটাও তাল মিলিয়ে এমন করে মুভ করছে যে বোঝার কোন উপায় নেই যে আমরা উড়ছি না। এমনি করে আট মিনিটের একটা শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থার মধ্যে দিয়ে যে দৃশ্য প্রত্যক্ষ করলাম তাতে বিস্ময় প্রকাশ না করে পারা গেল না। তাপোস আমরা সত্যি সারপ্রাইজড। আধুনিক প্রযুক্তির যুগে মানুষের চিত্ত বিনোদনের কত রকমের পন্থা যে আবিস্কৃত হয়েছে তারই অন্যতম নিদর্শন এই ফ্লাইওভার কানাডা। টরোন্টোতে ইতি হলো টানা ভিক্টোরিয়া থেকে নায়াগ্রা ভ্রমণ কাহিনীর যবনিকা টানা হয়েছিল এই টরোন্টো এসে। ঘটনাক্রমে ব্যালটিক সাগর থেকে রকি মাউনন্টেইন এর সমাপ্তি টানতে হচ্ছে সেই টরোন্টোতেই। বিষয়টা কেমন যেন কাকতালিও মনে হলেও, পরিকল্পনা করে এই কাজটি করা হয়নি। সস্তার তিন অবস্থা অর্থাৎ কম পয়সার টিকিট কাটতে গিয়ে কত বিড়ম্বনা যে পোহাতে হলো। তারই সর্বশেষ বিড়ম্বনা পুনরায় এখানে পর্দাপণ, ও পনেরো ঘণ্টার যাত্রা বিরতি। যাই হোক এটাকে আর বিড়ম্বনা না বলে, বলি সুযোগ। যে সুযোগের বদৌলতে সেবার যে কাজটি করতে পারিনি এবার সে কাজটি করা গেল। অর্থাৎ গতবার নায়াগ্রা ফলস্ দেখতে এসে মাত্র কয়েক ঘণ্টার জন্য টরোন্টো এসেছিলাম। সেবার আমাদের অতি আদরের ছোট বোন শংঙ্করী অনিমেশ এবং অতিপ্রিয় হুমায়ন কবির ভাই এর সঙ্গে কয়েক মিনিটের জন্য দেখা হয়েছিল বেশি কথা বলার অবকাশ পাইনি। এবার সেটা কিছুটা পুষিয়ে নেওয়া গেল। কবির ভাই এর সাথে পরিচয় সেই তানজানিয়ায় ২০০৩ খ্রিস্টাব্দে যখন আমি জাতিসংঘে চাকরি করতাম। কবির ভাই ছিলেন রেডক্রসে। তারপর দীর্ঘদিন আর দেখা সাক্ষাৎ হয় না, কথা হয়। এবার দেখা সাক্ষাৎ কথা বার্তা সবই হলো। কবির ভাই এর সুরম্য অট্টালিকা দেখে অনেক খুশি হলাম। এবার কোথায়ও বেড়াতে যায়নি। শুধু দুই পরিবারের সঙ্গেই সময় কাটিয়ে পাড়ি জমালাম ল-নে। (সমাপ্ত)
×