ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

দশ লাখ জাল ভারতীয় রুপী ও সরঞ্জামসহ আটক ২

দেশে অর্ধ শতাধিক জালনোট চক্র সক্রিয়

প্রকাশিত: ০৫:৩৯, ২৯ ডিসেম্বর ২০১৭

দেশে অর্ধ শতাধিক জালনোট চক্র সক্রিয়

শংকর কুমার দে ॥ বাংলাদেশ ও ভারত- দুই দেশের অর্থনৈতিক মেরুদন্ড- ভেঙ্গে দিচ্ছে জাল টাকা ও জাল রুপী। বাংলাদেশ ও ভারত জালনোট ঠেকাতে যৌথ টাস্কফোর্স গঠন করে একাধিক বৈঠকে নানা ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। এমনকি ভারতীয় জাল নোটের ব্যাপকতায় আসল নোট পর্যন্ত বাতিল করতে বাধ্য হয়েছে ভারত সরকার। বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জাল নোট প্রস্তুতকারী চক্রের বিরুদ্ধে ব্যাপক অভিযান পরিচালনা করছে। কিন্তু তারপরেও জাল নোট ও জাল রুপী তৈরি বন্ধ করা যায়নি। দেশের অভ্যন্তরে অন্তত অর্ধ-শতাধিক জাল নোট তৈরির চক্র আছে বলে গোয়েন্দা সংস্থার দাবি। গত কয়েক বছরে দেশে পাঁচ-শতাধিক জাল নোট তৈরির মামলা দায়ের করা হয়েছে। কিন্তু জাল নোট প্রস্তুতকারী চক্রের সদস্যরা গ্রেফতার হলেও আইনের ফাঁকফোকরে জামিনে বের হয়ে এসে আবারও একই কাজে সক্রিয় হচ্ছে। এ পর্যন্ত জাল নোট তৈরি চক্রের কারও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়েছে এমন নজির জানাতে পারেনি আইন পুলিশ, র‌্যাব, ডিবি ও গোয়েন্দা সংস্থা। বুধবার রাতে ঢাকার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জে ভারতীয় মুদ্রা জালিয়াতির একটি ‘কারখানার’ সন্ধান পেয়েছে র‌্যাব। ওই কারখানা থেকে ১০ লাখ ভারতীয় রুপীর জাল নোট ও জালিয়াতির সরঞ্জামসহ লিয়াকত আলী (৩৫) ও তার সহযোগী জাহাঙ্গীর আলম (৪০) নামের দুই জনকে গ্রেফতার করার পর জিজ্ঞাসাবাদ করছে র‌্যাব। জাল নোট ও জাল রুপি মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ খবর জানা গেছে। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানান, বাংলাদেশ ও ভারতের সীমান্ত এলাকায় ভারতীয় রুপী আইএস রুপীও নামে পরিচিত। এটা পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই এর তৈরি। বাংলাদেশী জাল টাকাও তৈরি করে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই। তারা সরকারী টাকশালে এই টাকা ও রুপী ছাপিয়ে সীমান্ত জেলাগুলোর তাদের এজেন্টদের কাছে এগুলো বিক্রি করে। এভাবেই দেশের অভ্যন্তরে গড়ে উঠেছে জাল নোট তৈরির চক্র। পাকিস্তানীরা একাধারে ভারতীয় ও বাংলাদেশী জাল টাকা বানায়। এজেন্টরা বাংলাদেশী টাকায়ও নেয়, ইন্ডিয়ান রুপীও নেয়। সীমান্ত এলাকায় আগে জাল নোট ও জাল রুপীর ব্যাপক বাজার এখন দেশের অভ্যন্তরের রাজধানী ঢাকাসহ সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জাল নোট প্রস্তুতকারী চক্রের কাছ থেকে উদ্ধার করছে জাল নোট তৈরির সরঞ্জামাদির মধ্যে জাল টাকা ও জাল রুপী তৈরির বিভিন্ন সরঞ্জামাদি, ট্রেসিং কাগজ, স্কিন ডাইস, স্কিন প্রিন্ট, লেমিনেটিং, প্রিন্টার মেশিন, কোটি কোটি টাকার জাল নোট ও জাল রুপী। জাল নোট চক্রের সঙ্গে জড়িত পুরুষের সঙ্গে গ্রেফতার হচ্ছে মহিলারাও। জিজ্ঞাসাবাদ করে তাদের কাছে থেকে জাল নোট তৈরির প্রস্তুতপ্রণালী সম্পর্কে জানতে পেরেছে র‌্যাব, পুলিশ, ডিবি ও গোয়েন্দা সংস্থা। যেভাবে জাল নোট তৈরি হচ্ছে ॥ বিভিন্ন নিরাপত্তা বৈশিষ্ট্যসহ জাল টাকার ডিজাইন ও তৈরির ক্ষেত্রে এতদিন অপরাধী চক্রের প্রধান বাধা ছিল টাকা ছাপানোর বিশেষ ধরনের কাগজ। এতদিন অপরাধী চক্র নরমাল কাগজ, ট্রেসিং পেপার ও আঠা প্রসেসিংয়ের মাধ্যমে জাল বা নকল টাকা ছাপাত। কিন্তু এতে জাল নোটের ‘টেম্পার’ দ্রুত শেষ হয়ে যায়। ফলে দুই থেকে তিন হাত বদল হতেই টাকার নকল রূপ বেরিয়ে আসে। কিন্তু দীর্ঘদিনের প্রধান বাধা টাকা ছাপানোর কাগজের প্রতিবন্ধকতা দূর করেছে অপরাধী চক্র। ‘নোট জালকারী চক্রে’র হাতে এখন রয়েছে টাকা তৈরির ‘আসল কাগজ’। পাকিস্তান থেকে আসা সেই ‘আসল কাগজে’ ছাপা বেশকিছু নোট ইতিমধ্যে বাজারে ছড়িয়ে দিয়েছে অপরাধী চক্র। এমন কয়েকটি নোট বাংলাদেশের গোয়েন্দাদের হাতেও পড়েছে। এসব জাল নোট চেকিং মেশিন বা কোনো বিশেষজ্ঞ দিয়ে পরীক্ষা করেও ধরার উপায় নেই। এভাবে জাল টাকার বিস্তার দেশের অর্থনীতির জন্য বিরাট অশনিসংকেত বলে মনে করছেন অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞরা। শুধু তাই নয়, ওই অর্থ দিয়ে দেশের ভেতর সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালিত হবে বলেও তাদের ধারণা। কিন্তু এখন সেই বাধাও দূর করেছে অপরাধী চক্র। এমনকি জঙ্গী গোষ্ঠীও জাল নোট ও জাল রুপী ব্যাবহার করছে বলে গোয়েন্দা সংস্থার দাবি। গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, দেশের শপিংমল, খুচরা বাজার এমনকি ব্যাংকে জাল টাকার ফাঁদে পড়ে প্রতারিত হওয়ার অভিজ্ঞতা অনেকের। কিন্তু জাল টাকা বানানোর কারিগরদের কাছে এটা খুবই সহজ কাজ। অল্প পুঁজি আর লাভও বেশি! ঈদের আগে এই জাল টাকা ছড়িয়ে পড়ে তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি। জাল নোট তৈরির এক কারিগরের জবানবন্দী ॥ গোয়েন্দা পুলিশের হাতে গ্রেফতার হওয়া জাল নোট তৈরির গ্রেফতার হওয়া কারিগরদের মধ্যে অন্যতম জামান বিশ্বাস। তিনিসহ তার সহযোগী কারিগররা তাদের দেয়া জবানবন্দীতে বলেছে, ‘স্যার জাল টাকা বানাতে আমার কোনো ওস্তাদ লাগে নাই। এমনিতেই শিখে ফেলেছি। আর এইটা বানানো তো খুব সোজা কাজ, স্যার। জাল নোট তৈরির কারিগর জামান বিশ্বাস গ্রেফতার হওয়ার পর জাল টাকা কীভাবে বানানো হয় আর তা এত সহজে কীভাবে ছড়িয়ে পড়ে এসব প্রশ্নের উত্তর দেন জিজ্ঞাসাবাদে। গত বছর গ্রেফতার হয় ৫০ বছর বয়সী জামান বিশ্বাস। তিনি জানান, ১৪ বছর ধরে জাল টাকা প্রস্তুত করার সঙ্গে জড়িত তিনি। ১৯৯৮ সালে প্রথম একটি ১০০ টাকার নোট ফটোকপি করার পর থেকেই জাল টাকার চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে, আর শুরু হয় টাকা জাল করার ফন্দি। এর আগে তিনি সাইনবোর্ড তৈরির দোকান ছাড়াও প্রিন্টার ও ফটোকপির দোকানে কাজ করেছেন। এই কাজে কী সফটওয়্যার লাগে- এমন প্রশ্নের উত্তরে জামান জানান, ‘না স্যার। টাকা স্ক্যানিং করে কালার ঠিকমত মেলানোর পর প্রিন্ট করলেই অবিকল টাকা পাওয়া যায়। প্রথমে কালার ফটোকপি দিয়ে নোটের দুই দিক ফটোকপি করার পর স্ক্রিনপ্রিন্টের মাধ্যমে তাতে বাঘের মাথার জলছাপ দেয়া হয়। এরপর বিশেষ কাগজে তাপ দিয়ে নিরাপত্তা সুতা তৈরি করা হয়।’ কাগজ কোথা থেকে সংগ্রহ করতেন তাও জানিয়েছেন জামান। এক লাখ জাল টাকা তৈরি করতে দেড় থেকে দুই হাজার টাকা খরচ হয় জানিয়ে তিনি বলেন, এক লাখ টাকার জাল নোট ৮-১০ হাজার টাকায় বিক্রি করা যায়। এই জাল টাকার নোটের ব্যবসা করেই জাল নোটের কারিগর জামান কুষ্টিয়ায় বাড়ি করেছেন। গ্রেফতারের ভয়ে ফরিদপুর ও কুষ্টিয়ায় থেকে সারাবছর জাল টাকার ব্যবসা করলেও গত বছর ঈদকে সামনে রেখে তিনি কামরাঙ্গীরচর এসে টাকা বানাতে গিয়ে ধরা পড়েন। তার সঙ্গে আরও গ্রেফতার হয়েছেন শান্তা ওরফে শাবানা নামে এক নারী। তিনি নিরাপত্তা সুতা তৈরির কাজ করতেন বলে অভিযোগ আছে। জিজ্ঞাসাবাদে জামান জানান, শুধু টাকাই নয়; জামান শেখ ভারতীয় রুপীও জাল করার পদ্ধতি রপ্ত করেন। ভারতীয় রুপী কেন জাল করা শুরু করলেন- জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘উত্তম নামে একজন মালদাহ থেকে এসে ভারতীয় ওই রুপী নিয়ে যেতেন। গত ১৪ বছরে উত্তম ১০-১২ বার জাল রুপী নিয়ে গেছে। টাকার সেই রঙিন ফটোকপির পর জাল টাকা বানানোর ফন্দিতে নিজ এলাকা চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে ঢাকায় এসে প্রথমে ৮০ হাজার টাকা দিয়ে একটি রঙিন ফটোকপি মেশিন কেনেন। সঙ্গে কিনে ফেলেন অন্যান্য সরঞ্জামও। এরপর শুরু করেন জাল টাকা বানানো। আর শুরুটা ছিল জিগাতলার বাসায়। এরপর কত বাসা যে পরিবর্তন করেছেন তা গুনেও শেষ করতে পারেন না জাল টাকা-রুপীর নোট বানানোর এই কারিগর। কারিগর জামান জানান, ১৯৯৯ সালে হেলাল নামে এক শিষ্যের বোকামির কারণে গোয়েন্দা পুলিশের হাতে ধরা পড়ে ২১ মাস জেল খেটেছিলেন। এরপর জামিনে বের হয়ে এ ব্যবসা আবার পুরোদমে শুরু করেন। কেরানীগঞ্জে জাল নোট তৈরির কারখানার সন্ধান লাভ ॥ ঢাকার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জে ভারতীয় মুদ্রা জালিয়াতির একটি ‘কারখানার’ সন্ধান পেয়েছে র‌্যাব। এ সময় ওই কারখানা থেকে ১০ লাখ ভারতীয় রুপীর জাল নোট ও জালিয়াতির সরঞ্জামসহ দুইজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। গ্রেফতারকৃতরা হচ্ছে- লিয়াকত আলী (৩৫) ও তার সহযোগী জাহাঙ্গীর আলম (৪০)। বৃহস্পতিবার দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে বাহিনীর মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে র‌্যাব-৩ এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল এমরানুল হাসান জানান, দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের শুভাড্যা উত্তরপাড়ার একটি বাড়ির তৃতীয় তলায় ওই কারখানা গড়ে তোলা হয়েছিল। বুধবার রাতে র‌্যাব-৩ এর একটি দল সেখানে অভিযান চালিয়ে ওই দু’জনকে আটক করে। এ সময় তাদের কাছ থেকে ভারতীয় ১০ লাখ টাকার জাল রুপী উদ্ধার করা হয়। এছাড়াও জাল রুপী তৈরির কাজে ব্যবহৃত একটি ল্যাপটপ, মুদ্রা তৈরিতে ব্যবহৃত স্কিন ডাইস ছয়টি, ডাইস প্লেট দুটি, স্ক্যানার কাম প্রিন্টার দুটি, প্রিন্টার চারটি, ভারতীয় জাল রুপীর নিরাপত্তা সুতা সাত বান্ডেল, ফয়েল মেশিন একটি, জাল রুপী কাটার কাজে ব্যবহৃত কাটার মেশিন চারটি, কাটার ব্লেড সাত বক্স, জাল রুপী ছাপানোর কাজে ব্যবহৃত স্কিন রাবার পাঁচটি, জাল রুপী ছাপানোর কাজে ব্যবহৃত বিদেশী উন্নতমানের রঙিন কালি ১২০টি ইত্যাদি উদ্ধার করা হয়। দীর্ঘদিন ধরে গ্রেফতারকৃতরা জাল নোট তৈরির সঙ্গে জড়িত। এই বাসায় তারা ভাড়া থাকত। এর আগে কয়েকবার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরা পড়লেও পরে জামিনে বেরিয়ে যায়। লেফটেন্যান্ট কর্নেল এমরানুল হাসান জানান, বাংলাদেশী জাল মুদ্রা তৈরি এবং বাজারজাত করা ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় ভারতীয় জাল মুদ্রা তৈরিতে ঝুঁকে পড়েন লিয়াকত আলী। প্রতিমাসে মাসে ৫০ থেকে ৬০ লাখ জাল রুপী তৈরি করে সরবরাহ করতেন তিনি। এতে তার মাসিক আয় হত দেড় থেকে দুই লাখ টাকা। তিনি জানান, জাল মুদ্রা তৈরির মূলহোতা ছগির মাস্টার শেয়ারবাজারে ধসের পর জাল মুদ্রা তৈরির সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন। ছগির মাস্টারের সহযোগী হিসেবে তখন থেকে লিয়াকত এই চক্রের সঙ্গে কাজ শুরু করে। লেফটেন্যান্ট কর্নেল এমরানুল হাসান জানান, ১৯৯৬ সালে ছিলেন জাল মুদ্রা তৈরির মাস্টারমাইন্ড ছগির মাস্টারের সহযোগী। ২০০৭ সাল থেকে নিজেই হন জাল মুদ্রা তৈরির মাস্টারমাইন্ড। বানান নিজেরও সহযোগী ও সিন্ডিকেট। যাদের মাধ্যমে সারাদেশে ছড়িয়ে দিতেন জাল মুদ্রা। তার সহযোগীর জাহাঙ্গীর আলম। সে সময় থেকে কেরানীগঞ্জে নিজের ভাড়া বাসাতেই জাল মুদ্রা তৈরির কারখানা গড়ে তোলে লিয়াকত। সে নিজেই গড়ে তোলে একটি সিন্ডিকেট। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে লিয়াকত জানান, সে তার স্থানীয় দালালদের মাধ্যমে রাজধানীর বিভিন্ন মানি এক্সচেঞ্জ এবং সীমান্ত এলাকায় জাল রুপী সরবরাহ করত। প্রতি লাখ জাল ভারতীয় মুদ্রা ১২ হাজার টাকায় বিক্রি করত। অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল এমরানুল হাসান জানান, ভারতীয় ৫০০ ও এক হাজার রুপীর নোট তৈরি সহজ হওয়ায় লিয়াকত এসব নোটই তৈরি করত। লিয়াকত ‘কাটআউট’ পদ্ধতিতে জাল রুপী সরবরাহ করত। এটা একটা চেইন। লিয়াকত কার কাছে জাল রুপীগুলো সরবরাহ করত। তা অনেক ক্ষেত্রে নিজেই জানত না। সে ছিল জাল রুপীর পাইকারি বিক্রেতা। এছাড়াও আমরা কিছু নাম পেয়েছি। তদন্তে বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া যাবে। লিয়াকত যেসব মানি এক্সচেঞ্জে জাল রুপী সরবরাহ করত সেগুলোর কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। র‌্যাব এই কর্মকর্তা জানান, লিয়াকত এর আগে কয়েকবার গ্রেফতার হয়েছিলেন। তার বিরুদ্ধে রাজধানীর বিভিন্ন থানায় পাঁচটি মামলা রয়েছে বলেও জানান তিনি। জাল নোট তৈরির তিন ধাপ ॥ ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা সংস্থার তদন্ত সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা জানান, জাল নোট তৈরির চক্রের গ্রেফতারকৃত সদস্যদের দেয়া জবানবন্দী অনুযায়ী বাংলাদেশে তিন ধাপে তৈরি হয় জাল টাকা। যে কাগজে জাল টাকা ছাপানো হয় তাকে জাল নোট চক্রের ভাষায় ‘কাপড়’ বলা হয়। বাজার থেকে নরমাল কাগজ, ট্রেসিং পেপার ও আঠা দিয়ে প্রসেসিংয়ের মাধ্যমে এই ‘কাপড়’ তৈরি করা হয়। ‘কাপড়’ তৈরির জন্য রয়েছে পৃথক গ্রুপ যারা ‘জাল টাকা তৈরি চক্রে’র কাছে তা বিক্রি করে। এক বান্ডিল ‘কাপড়’ সাত থেকে ১০ হাজার টাকায় বিক্রি হয়। এক কাগজে চারটি টাকা প্রিন্ট হয়, আর এক বান্ডিলে ৪০০টি টাকা প্রিন্ট হয়। এছাড়া টাকার নিরাপত্তা সুতা আলাদাভাবে কিনে তাতে গ্রাফিক ডিজাইনার দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের লোগো বসানো হয়। এভাবে তৈরি হয় সিকিউরিটি রোল। একটি সিকিউরিটি রোল ২৫ হাজার টাকায় বিক্রি হয়। কম্পিউটার বা ল্যাপটপ ব্যবহার করে প্রিন্টারের মাধ্যমে ‘জাল টাকা’ ছাপিয়ে তা নির্দিষ্ট সাইজে কাটা হয়। এগুলো মার্কেটে বাজারজাত করার জন্য রয়েছে পৃথক গ্রুপ। এসব গ্রুপের নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ থাকলেও একটি গ্রুপ আরেকটির ব্যাপারে তেমন কিছুই জানে না। জাল টাকার ব্যবসা সারা বছরই চলে। তবে ঈদ উপলক্ষে অন্যান্য ব্যবসার মতো এ ক্ষেত্রেও চাহিদা বেড়ে যায়। এখন ঢাকায় এ রকম ৪৫ থেকে ৫০টি গ্রুপ আছে। সারা দেশেই তাদের কাস্টমার আছে। সারা দেশেই জাল নোট সরবরাহ হয় ঢাকা থেকে। স্থানীয় পর্যায়ে জাল টাকা বাজারে ছাড়ার জন্য রয়েছে পৃথক লোক। ‘কাপড়ে’র মাধ্যমে জাল টাকা তৈরির কাজে এখানকার ৮ থেকে ১০টি চক্র জড়িত থাকার সন্ধান পাওয়া গেছে। অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞদের অভিমত ॥ অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞরা বলেন, জাল নোট বা জাল রুপী-এটা অর্থনীতির জন্য খুবই ভয়ঙ্কর। জাল টাকা ও আসল টাকার মধ্যে যদি পার্থক্য না করা যায়, তাহলে একদিকে যেমন অর্থনৈতিক ক্ষতি হবে, অন্যদিকে যেহেতু পাকিস্তানীরা তাদের এজেন্টদের হাতে এসব জাল টাকা দিয়েছে, তাই তারা এ টাকা দেশের ক্ষতি ও সন্ত্রাসের কাজে ব্যবহার করবে। তিনি বলেন, এটা ব্যাপকভাবে হয়ে থাকলে আমাদের কারেন্সি নোট বিশেষ করে ১০০, ৫০০ ও ১০০০ টাকার পুরাতন নোটগুলো জমা নিয়ে নতুন করে ছাড়া যেতে পারে। আর তা না হলে টাকার ডিজাইন পরিবর্তন করা যেতে পারে। ব্যয়বহুল হলেও আমাদের বড় নোটগুলোর (৫০০ টাকা ও ১০০০ টাকা) সিকিউরিটি আরও স্ট্রং করতে হবে যাতে সহজেই এ কাজটা (জাল) কেউ না করতে পারে। একই সঙ্গে কীভাবে, কোন চ্যানেলে ওই টাকাগুলো কিংবা টাকার কাগজগুলো আসছে তা গোয়েন্দাদের খুঁজে বের করতে হবে এবং ওই চ্যানেলটা বন্ধ করে দিতে হবে। পুলিশ সদর দফতরের একজন কর্মকর্তা বলেন, জাল নোট ও জাল রুপীর কারণে বেশি ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন যারা কাছে পাওয়া যায় তারা। কারণ আইন অনুযায়ী যার কাছে জাল নোট বা জাল রুপী পাওয়া যাবে তাকেই গ্রেফতার করে বিচারে সোপর্দ করা হবে। জাল নোট ও জাল রুপীর আগ্রাসন ঠেকাতে সম্প্রতি ঢাকায় অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ ও ভারত জালনোট সংক্রান্ত যৌথ টাস্কফোর্সের বৈঠকে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। জাল টাকা ও জাল রুপীর ঘটনায় অন্তত পাঁচ শতাধিক মামলা তদন্তনাধীন রয়েছে। জাল নোট ও জাল রুপী প্রস্তুতকারীদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনার নির্দেশ দেয়া হয়েছে বলে পুলিশ কর্মকর্তা জানিয়েছেন। অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য অপরাধ দমনে আমরা কাজ করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এতে জাল নোট বন্ধসহ অনেক অপরাধ দমন করা সহজ হবে।
×