ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

‘আমরা নতুন নিয়োগ দেব’॥ ৭ হাসপাতালে এ্যাম্বুলেন্সের চাবি হস্তান্তর অনুষ্ঠান

গ্রামবিমুখ ডাক্তারদের প্রধানমন্ত্রী ॥ বাড়ি যান

প্রকাশিত: ০৫:৩৮, ২৯ ডিসেম্বর ২০১৭

গ্রামবিমুখ ডাক্তারদের প্রধানমন্ত্রী ॥ বাড়ি যান

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যেসব চিকিৎসক মফস্বলের হাসপাতালে থাকতে চান না তাঁদের প্রতি সতর্কবার্তা উচ্চারণ করে বলেছেন, যারা মফস্বল ছেড়ে শহরে চলে আসে তাদের চাকরি করার দরকার নেই। ঢাকায় বসে প্রাইভেট প্র্যাকটিস করলেই তো অনেক টাকা পাবে। দয়া করে তারা বিদায় নিয়ে বাড়ি চলে যাক, আমরা নতুন নিয়োগ দিব। ছেলে-মেয়েরা লেখাপড়া শিখে প্রতিনিয়ত চাকরি খুঁজে বেড়াচ্ছে। বৃহস্পতিবার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে সাতটি সরকারী হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রে জাপানের তৈরি অত্যাধুনিক এ্যাম্বুলেন্সের চাবি হস্তান্তর অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী সরকারী চিকিৎসকদের কর্মক্ষেত্রে থেকে যথাযথভাবে মানুষকে সেবা দেয়ার নির্দেশ দিয়ে বলেন, আমরা যখন উপজেলা পর্যায়ে চিকিৎসকদের নিয়োগ দেই তখন অনেকেই আছেন যারা কর্মক্ষেত্রে থাকতে চান না। বরং তারা যেকোন উপায়েই ঢাকায় থাকেন। চিকিৎসকদের ঢাকাতেই যদি থাকার ইচ্ছা হয়, তাহলে তাদের সরকারী চাকরি করার প্রয়োজন নেই। তাদের চাকরি ছেড়ে দিয়ে বাড়িতে চলে যাওয়াই ভাল। দ্বীপাঞ্চল ও হাওড় অঞ্চলে নৌ এ্যাম্বুলেন্সের প্রয়োজনীয়তার কথাও তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী। দেশের মেডিক্যাল কলেজগুলোতে মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করার তাগিদ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘মেডিক্যাল কলেজগুলো আমরা করে দিচ্ছি, এটার মানটা আমাদের বজায় রাখতে হবে। সেখানে কেমন পড়ালেখা হচ্ছে, চিকিৎসক কেমন বের হচ্ছে। রোগী মারা ডাক্তার হচ্ছে, না রোগী বাঁচানোর ডাক্তার হচ্ছে- এটা একটু ভাল করে দেখতে হবে। তিনি বলেন, অনেকগুলো মেডিক্যাল কলেজ আমরা দিয়েছি। আর যেখানে যেখানে ক্যান্টনমেন্ট আছে, সেখানে অলরেডি পাঁচটা মেডিক্যাল কলেজ করার অনুমতি আমরা দিয়েছি। বলেছি যে, সব জায়গায় আমরা দেব। মানসম্পন্ন চিকিৎসক তৈরিতে মেডিক্যাল কলেজগুলোর শিক্ষার মান উন্নয়নে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশনা প্রদান করে তিনি আরও বলেন, সরকার দেশে বিপুলসংখ্যক মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠা করেছে। আমরা ইতোমধ্যেই পাঁচটি সেনানিবাসে মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠার অনুমোদন দিয়েছি এবং পর্যায়ক্রমে অন্যান্য সেনানিবাসেও এই ধরনের কলেজ প্রতিষ্ঠা করব। শেখ হাসিনা বলেন, এসব মেডিক্যাল কলেজে কী ধরনের চিকিৎসা সেবা প্রদান করা হচ্ছে তা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে তদারকি করতে হবে। তাঁর সরকার স্বাস্থ্য সেবার উন্নয়নে মেডিক্যাল শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষা নিশ্চিতের লক্ষ্যে ঢাকায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছে এবং চট্টগ্রাম ও রাজশাহীতে আরও দুটি মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, স্বাস্থ্যসেবা দেশের মানুষের কাছে পৌঁছে দিচ্ছি। তবে আপনাদের আরও সচেতন হতে হবে। আমাদের ডাক্তাররা যেন কর্মস্থলে থাকে। উপজেলায় আবাসন সমস্যার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, একটা সমস্যা আমি খুঁজে বের করেছি। সেটা হচ্ছে- তাদের আবাসিক সমস্যাটা। অনেক ইয়ং (তরুণ) ডাক্তাররা যায়, এখন মেয়েরাও যায়। কিন্ত গেলেও একটা উপজেলায় তাদের থাকার জায়গা নেই। এই সমস্যা সমাধানে উপজেলাগুলোতে বহুতল ভবন নির্মাণ করতে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দেয়ার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, প্রত্যেক উপজেলায় একটি করে মাল্টিস্টোরিড বিল্ডিং যদি করে দেয়, অনেক সরকারী অফিসার তারা গিয়ে ওখানে ভাড়া নিয়ে থাকতে পারবে। স্বনামধন্য মেডিক্যাল কলেজের শ্রেণিকক্ষের পাঠ তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহার করে বিভিন্ন জেলার মেডিক্যাল কলেজে দেখানোর কথাও বলেন প্রধানমন্ত্রী। এছাড়া বিদেশী বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের দেশের মেডিক্যাল কলেজগুলোতে আসতে দেয়া উচিত বলেও মন্তব্য করে তিনি বলেন, বিদেশী বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের এখানে আসতে দেওয়া উচিত; পড়ানোর জন্য। এসব বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা এখানে লেকচার দিয়ে যায়, তাহলে আমাদের শিক্ষার্থীরা অভিজ্ঞতা সঞ্চার করতে পারে। আমাদের রোগীদের বিদেশে যেতে হয় না। স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নে আওয়ামী লীগ সরকারের নেয়া বিভিন্ন উদ্যোগের কথা বলতে গিয়ে সরকার প্রধান বলেন, আজকে বাংলাদেশে যতগুলো ইনস্টিটিউট করা হচ্ছে, আমি অতো নাম বলব না। ১৯৯৬ সাল থেকে ২০০১ পর্যন্ত প্রতিটি ইনস্টিটিউটের শুরুটা কিন্তু আমার হাত থেকেই হয়েছে। আমাদের এত জনসংখ্যা, তাদের চিকিৎসা দিতে গেলে লোকবল তৈরি করা এবং বিশেষায়িত বিশেষ করে বিশেষায়িত মানুষজনের প্রয়োজন খুব বেশি। প্রত্যেকটা বিভাগীয় শহরে একটি করে মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, বিশেষায়িত ইনস্টিটিউট করে দিচ্ছি, এতে বিশেষজ্ঞ থাকতে পারে এবং বিশেষজ্ঞ তৈরি হচ্ছে। গ্যাস্ট্রোএ্যান্ট্রোলজিতে পিছিয়ে থাকার কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, একটা জায়গায় আমরা পিছিয়ে আছি, সেটা হল, গ্যাস্ট্রোএ্যান্ট্রোলজিস্ট। এক্ষেত্রে আমাদের ডাক্তার খুব কম। এ বিষয়ে আমাদের হাতে গোনা কয়েকজন ডাক্তার ছিলেন। এখন কিছু নতুন ডাক্তার এসেছেন। পেটের পীড়াকে এই অঞ্চলের জনগণের একটি স্বাভাবিক সমস্যা হিসেবে আখ্যায়িত করে তিনি বলেন, বাংলাদেশের মানুষ পেটের পীড়ায় সব থেকে বেশি ভোগে। এটা আমাদের পরিবেশের জন্য, আমাদের জলবায়ুটা এমন যে, এটা হবেই। এটা অস্বাভাবিক কিছু না। গ্যাস্ট্রোএ্যান্ট্রোলজি ইনস্টিটিউট তৈরির ভবিষ্যত নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে তিনি বলেন, একটা গ্যাস্ট্রোএ্যান্ট্রোলজি ইনস্টিটিউট তো করার কথা। আমি জানি না সেটার ভাগ্য কোথায় ঝুলে আছে। স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টির নির্দেশ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১৯৯৬ থেকে ২০০১ পর্যন্ত কমিউনিটি ক্লিনিক প্রকল্পে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার ৭০ ভাগ সাফল্য অর্জন করেছিল। কমিউনিটি ক্লিনিক সম্পূর্ণ আমার নিজস্ব ধারণা। সেভাবেই এটা তৈরি করা হয়েছিল। ১১ হাজার ক্লিনিক তৈরি করেছিলাম, চার হাজার আমরা চালু করেছিলাম। এক বছরের মধ্যে দেখা গিয়েছিল যে, প্রায় ৭০ ভাগ সাফল্য অর্জন করেছে। কিন্তু ২০০১ সালে ক্ষমতায় এসে তৎকালীন বিএনপি সরকার এই কমিউনিটি ক্লিনিক প্রকল্প বন্ধ করে দেয়। অনুষ্ঠানে জানানো হয়, এবার বিভিন্ন হাসপাতাল ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ৯৮ এ্যাম্বুলেন্স দেয়া হবে। প্রথম পর্যায়ে ৬০ এবং দ্বিতীয় পর্যায়ে ৩৮ এ্যাম্বুলেন্স দেয়া হবে। জাপানের টয়োটার এই অত্যাধুনিক এ্যাম্বুলেন্সে সকল প্রাথমিক চিকিৎসার সুবিধা রয়েছে। ২০১৭ সালে এই প্রতিটি এ্যাম্বুলেন্সের মূল্য ৪১ লাখ টাকা। বৃহস্পতিবার জাতীয় হƒদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, বান্দরবান সদর হাসপাতাল এবং গোপালগঞ্জের টুঙ্গীপাড়া, গাজীপুরের কালিয়াকৈর, খুলনার ফুলতলা, কুড়িগ্রামের রাজীবপুর, নেত্রকোনা কেন্দুয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের প্রতিনিধিদের হাতে এ্যাম্বুলেন্সের চাবি তুলে দেন প্রধানমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রী এই এ্যাম্বুলেন্সগুলো রক্ষণাবেক্ষণে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে আলাদা তহবিল গড়ে তোলার নির্দেশ দিয়ে বলেন, এ্যাম্বুলেন্সের একটা চাকা নষ্ট হলে, তা ঠিক করতে টাকার জন্য আবেদন করতে করতে চারটা চাকাই নষ্ট হয়ে যায়। সেটা যেন না হয়, এ্যাম্বুলেন্স বসে যায়। এজন্য তাৎক্ষণিক তহবিল গঠনের জন্য তিনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতি নির্দেশ দেন। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে আয়োজিত অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম, স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী জাহেদ মালেক স্বপন ছাড়াও স্বাগত বক্তব্য রাখেন স্বাস্থ্য বিভাগের সচিব সিরাজুল হক খান এবং সমাপনী বক্তব্য রাখেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক আবুল কালাম আজাদ। এ সময় মুক্তিযুদ্ধবিষয়কমন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক, প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্র চন্দ, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী, প্রধানমন্ত্রীর প্রেসসচিব ইহসানুল করিম, স্বাস্থ্য সচিব সিরাজুল হক খান, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবুল কালাম আজাদ প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। পটুয়াখালী জেলা পরিষদ চেয়ারম্যানকে শপথ পাঠ করালেন প্রধানমন্ত্রী ॥ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বৃহস্পতিবার তাঁর কার্যালয়ে পটুয়াখালী জেলা পরিষদের নবনির্বাচিত চেয়ারম্যান খলিলুর রহমানকে শপথ বাক্য পাঠ করিয়েছেন। শপথ অনুষ্ঠান শেষে প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিম সাংবাদিকদের জানান, পটুয়াখালী জেলা পরিষদের নবনির্বাচিত চেয়ারম্যান খলিলুর রহমানকে প্রধানমন্ত্রী আনুষ্ঠানিকভাবে শপথ বাক্য পাঠ করিয়েছেন। স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব আবদুল মালেক অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন। স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন, জাতীয় সংসদের চিফ হুইপ আ স ম ফিরোজ এমপি, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী প্রমুখ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। সাংবাদিক লাভলুর চিকিৎসায় প্রধানমন্ত্রীর অনুদান ॥ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দৈনিক ভোরের কাগজের প্রধান প্রতিবেদক সৈয়দ আকতারুজ্জামান সিদ্দিকী লাভলুর চিকিৎসায় ১০ লাখ টাকা অনুদান প্রদান দিয়েছেন। বৃহস্পতিবার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে তাঁর প্রেস সচিব ইহসানুল করিম এই অনুদানের চেক প্রদান করেন। দীর্ঘদিন ধরে লিভার ক্যান্সারে আক্রান্ত সাংবাদিক লাভলু সম্প্রতি ভারত থেকে চিকিৎসা নিয়ে ফিরেছেন। জানা গেছে, তিনি চিকিৎসা নিতে আবারও ভারতে যাবেন।
×