ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ফিরে দেখা ২০১৭

চীন ও ভারতের পাল্টাপাল্টি বাণিজ্য রুট

প্রকাশিত: ০৩:৩৭, ৩০ ডিসেম্বর ২০১৭

চীন ও ভারতের পাল্টাপাল্টি বাণিজ্য রুট

২০১৭ সালে চীন ভারতের মধ্যে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে। ২০১৭ সালের ১৬ মে বেজিংয়ে ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড (ওবিওআর) শীর্ষক আন্তর্জাতিক সম্মেলনের আয়োজন করে চীন। এতে অংশ নেয়নি দিল্লী। তবে ভারত ঘিরে থাকা প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে ভুটান ছাড়া বাকি সব দেশই এতে অংশ নেয়, এবং উদ্যোগের সঙ্গে নিজেদের একাত্মতা প্রকাশ করে। দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের ভূমিকায় অসন্তুষ্ট এবং এ নিয়ে বেজিংয়ের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েন চলছে এমন এশীয় দেশ ভিয়েতনাম ও জাপান সম্মেলনে কেবল প্রতিনিধি পাঠায়। ওয়ান রোড শীর্ষক দুইদিনের ওই সম্মেলনের মাধ্যমে চীন তার দুই অঞ্চলের সঙ্গে বিশ্বের প্রায় ৬১ দেশকে সমুদ্র, সড়ক ও রেলপথে সংযুক্ত করার মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে এগুচ্ছে বেজিং। এই পথ এশিয়াকে ইউরোপ ও আফ্রিকার সঙ্গে সংযুক্ত করবে। চীনের এ মহাপরিকল্পনার বিষয়ে ভারতের আপত্তি রয়েছে। সম্মেলন শেষ হওয়ার পর চীনের গ্লোবাল টাইমস পত্রিকা ভারতকে উদ্দেশ্য করে সম্পাদকীয় শিরোনাম করে চীনের সঙ্গে বিরোধ ছাপিয়ে ভারতকে সামনে দেখতে হবে। ভারতীয় বিশ্লেষক রাজা মোহন এক প্রবন্ধে লিখেছেন, চীনের এই উদ্যোগ ভারতের প্রতিবেশীদের ওপর চীনের বাণিজ্যিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও নিরাপত্তাসংক্রান্ত প্রভাবকে আরও জোরালো করবে, যা দিল্লীর প্রভাবকে দুর্বল করবে। এই উদ্যোগে চীন শুধু অর্থনৈতিকভাবেই লাভবান হবে না, বরং সামরিকভাবেও সুবিধা পাবে। তিনি লিখেছেন, দিল্লী নিজেকে বেইজিংয়ের সমকক্ষ হিসেবে বিবেচনা করে। তার পক্ষে চীনের সহযোগী হিসেবে খেলা বেশ কঠিন। এই উদ্যোগের দীর্ঘমেয়াদী পরিণতি নিয়ে দেশটির (ভারত) মধ্যে উদ্বেগ রয়েছে। এর বিপরীতে ভারত এগুচ্ছে তার প্রাচীন কটন রুট বাস্তবায়নের মহাপরিকল্পনা নিয়ে। প্রাচীন যুগে ভারত মহাসাগরকে কেন্দ্র করে উপমহাদেশে যে বয়ন শিল্পের বিকাশ ঘটেছিল। প্রাচীন ভারতে বণিকরা ভারত মহাসাগরের যে কয়েকটি রুট ব্যবহার করে তাদের পণ্যসামগ্রী, বিশেষ করে ভারতীয় সুতি কাপড় নিয়ে সুদূর আফ্রিকা পর্যন্ত যেত। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ভারতীয় সংস্কৃতির বিকাশ ঘটেছিল যে পথ ধরে তাই নয়াদিল্লীর কটন রুট। চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড মহাপরিকল্পনার সঙ্গে মোদির প্রস্তাবিত কটন রুট ধারণা সাংঘর্ষিক। এই কটন রুটকে কেন্দ্র করে ভারত মহাসাগরে তার সামরিক উপস্থিতি নিশ্চিত করতে চাইছে নয়াদিল্লী। এহেন প্রেক্ষাপটে চলতি বছরের ৭ জুলাই থেকে ১৭ জুলাই বিশ্বের অন্যতম পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে জাপানসহ বঙ্গোপসাগরে যৌথ মহড়া চালায় ভারত। এমন এক সময়ে এ মহড়া অনুষ্ঠিত হয় যখন দোকলামে বেইজিংয়ের সঙ্গে অনেকটা মুখোমুখি অবস্থানে ছিল নয়াদিল্লী। বিশাল আয়োজনের ওই মহড়ায় ভারত তার সর্বোচ্চ শক্তি নিয়ে যোগ দেয়। মহড়ায় নিজের পুরো নৌশক্তি প্রদর্শন করে ভারত। দেশটির সবচেয়ে বড় ও একমাত্র বিমানবাহী রণতরী আইএনএস বিক্রমাদিত্যসহ তিন দেশের সব মিলিয়ে ১৬টি জাহাজ ও ৯৫টিরও বেশি বিমান ওই মহড়ায় অংশ নেয়। মার্কিন বিমানবাহী রণতরী ইউএসএস নিমিটজ ও জাপানের হেলিকপ্টারবাহী রণতরী জেএস ইজুমো এতে অংশ নেয়। মহড়া নিয়ে ভারত সরাসরি কিছু না বললেও যুক্তরাষ্ট্র ও জাপান অনেকটা স্পষ্ট করেই বলেছে, এর মূল উদ্দেশ্য ছিল চীনকে বিশেষ সঙ্কেত দেয়া। ইউএস স্ট্রাইক গ্রুপ ১১-এর কমান্ডার রিয়ার এ্যাডমিরাল উইলিয়াম ডি বায়ার্ন বলেন, এই মহড়া সব ধরনের ভুল হিসাব-নিকাশ মুছে দেবে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে আরেক মার্কিন কমান্ডার বলেন, এই মহড়ার গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব পড়বে চীনের ওপর। তারা (চীন) জানবে আমরা (যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, জাপান) একসঙ্গে আছি। জাপানের মেরিটাইম সেলফ ডিফেন্স ফোর্সের ভাইস চিফ অব স্টাফ হিরোশি ইয়ামামুরার বরাত দিয়ে দেশটির আসাহি শিম্বুন পত্রিকায় বলা হয়েছে, ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরে স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা ও তিন দেশের সম্পর্ক আরও জোরদার করা এই মহড়ার লক্ষ্য। আসাহি শিম্বুন ওই প্রতিবেদনের শিরোনাম দিয়েছিল, এই মহড়ায় শক্তি প্রদর্শনের উদ্দেশ্য চীনের প্রতি সঙ্কেত পাঠানো। এ কারণেই মহড়া শুরুর আগেই নিজের অবস্থান তুলে ধরে উদ্বেগ প্রকাশ করে চীন। দোকলাম ইস্যুতে ২০১৭ সালের মাঝামাঝির দিকে ভুটানের পশ্চিমাংশের দোকলাম মালভূমি নিয়ে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ে বিশ্বের দুই পারমাণবিক শক্তিধর দেশ চীন ও ভারত। দোকলামকে চীন ও ভুটান উভয়ই নিজেদের বলে দাবি করে। ১৮৯০ সালের কনভেনশন অনুযায়ী, মাত্র ৮৯ বর্গকিলোমিটারের মালভূমিটি চীন তার নিজের বলে দাবি করে আসছে। ভুটানও মনে করে, এটা তাদের নিজেদের এলাকা। চীন সেখানে অবকাঠামোগত নির্মাণ কাজ শুরু করলে ভুটানের অনুরোধে ভারত সেখানে সেনা মোতায়েন করে। দ্বন্দ্বটা সেখান থেকেই শুরু। পরবর্তীতে সমঝোতার মাধ্যমে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেও এ ঘটনার ভেতর দিয়ে চীন ও ভারতের অন্তর্নিহিত দ্বন্দ্ব ও অবিশ্বাস প্রকটভাবে বেরিয়ে আসে। এ বিষয়ে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই বলেছেন, দোকলামের ঘটনায় চীন ও ভারতের মধ্যে কূটনৈতিক স¤পর্ক লাইনচ্যুত হয়নি। তবে তিনি স্বীকার করেছেন, ৭৩ দিন স্থায়ী ডোকলাম সঙ্কট নয়াদিল্লী ও বেইজিংয়ের মধ্যে সম্পর্ক ক্ষতিগ্র্রস্ত ও প্রভাবিত করেছে। এর বাইরে চলতি বছর চীন ও ভারতের সম্পর্কে অবিশ্বাস ও সন্দেহ তৈরির অন্যসব ইস্যুগুলো যেমন পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরে চীনের অবকাঠামো তৈরির পরিকল্পনা, অভিন্ন নদীগুলোর গতিপথ ও প্রবাহ বদলের চেষ্টা, অরুনাচল প্রদেশ, দালাইলামা, ইত্যাদি বিষয়ে দুপক্ষ অনেকটা আগের অবস্থানেই আছে। তবে রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমার গোটা বিশ্বে কোনঠাসা হয়ে পড়লেও এ বিষয়ে চীন ও ভারত অনেকটা অভিন্ন অবস্থানে থেকে নেপিদোকে সমর্থন দিয়ে গেছে। দুই দেশই আন্তর্জাতিক কোন সভা সমাবেশ বা গণমাধ্যমে রোহিঙ্গা শব্দটি পর্যন্ত উচ্চারণ করেনি। এক্ষেত্রে এ দুদেশের সমঝোতা ছিল চমৎকার। -দ্য ডিপ্লোম্যাট, ব্রুকিং।
×