ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

তাজউদ্দীনসহ চার নেতার স্মারক স্থাপনা চাই -মমতাজ লতিফ

প্রকাশিত: ০৩:৩০, ২৯ ডিসেম্বর ২০১৭

তাজউদ্দীনসহ চার নেতার স্মারক স্থাপনা চাই -মমতাজ লতিফ

কিছুদিন আগে নির্মূল কমিটি ও ভারতীয় দূতাবাসের উদ্যোগে আয়োজিত ভারত কর্তৃক বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান দিবস উদযাপন উপলক্ষে আয়োজিত আলোচনা সভায় অনেকেই মুক্তিযুদ্ধের সফল সমাপ্তির নেপথ্যে প্রধান অবদান রাখা ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী এবং তাজউদ্দীন আহমদের কূটনৈতিক-রাজনৈতিক কৌশলের ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। তাছাড়াও মুক্তিযোদ্ধারা, মুক্তিযুদ্ধ প্রজন্ম অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করবার মতো বয়সী নারী-পুরুষ, দেশের জ্যেষ্ঠ নাগরিক, ’৭১-এ তরুণ, কিশোর বয়সী সবাই এখনও অপেক্ষা করে আছে কখন মহান মুক্তিযুদ্ধের সফল পরিচালক, প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের নামে একটি জাতীয় স্থাপনার নামকরণ করা হবে। তাজউদ্দীন আহমদ বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর শুধু নন, তাঁর সবরকম রাজনৈতিক আলোচনায়, ’৭১-এ ভুট্টোর সঙ্গে আলোচনায় বঙ্গবন্ধু যার ওপর সবচাইতে বেশি নির্ভর করতেন, তিনি তাজউদ্দীন। তাঁর পাশে আরও ছিলেন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট সৈয়দ নজরুল ইসলাম, মনসুর আলী ও কামরুজ্জামান, যারা বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের পর মোশতাকের শত প্ররোচনায়ও মোশতাক সরকারে যোগ দিতে অস্বীকার করে বঙ্গবন্ধুর প্রতি নিজেদের গভীর আস্থা ও আনুগত্যের প্রমাণ দিয়েছিলেন ঢাকা জেলে বন্দী হয়ে। অথচ সে বীরোচিত আত্মোৎসর্গকে তাঁদের নিজ দল, দলের নেতা, নেত্রী উপলব্ধি করেননি- এ তো হতে পারে না। কেননা জাতি জানে, অনেক দীর্ঘকালের পরীক্ষিত আওয়ামী লীগ নেতা বা মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদান রাখা ব্যক্তি মোশতাকের সরকারে বন্দুকের নলের কাছে বাধ্য হয়ে যোগ দিয়েছিলেন, যদিও মুক্তিযুদ্ধে তাঁদের অবদানটি মুছে যাবে না। সেখানে জেলে অন্তরীণ তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, মনসুর আলী ও কামরুজ্জামান বলা যায় আরেকটি যুদ্ধে শত্রুর কাছে আত্মসমর্পণ না করে নিরস্ত্র অবস্থায় শত্রুর প্রস্তাব প্রত্যাখ্যানের মধ্য দিয়ে প্রাণ উৎসর্গ করে বিজয়ী হয়েছেন। তাঁরা জেলবন্দী হয়েও যুদ্ধাপরাধী দল, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শবিরোধী পাকিস্তানপন্থীদের বিরুদ্ধে একটি প্রতিবাদী লড়াই করেছিলেন। সেজন্য তাঁদের হত্যা করা হয়েছে, কেননা সেদিন বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও আওয়ামী লীগকে নেতাশূন্য করে ধ্বংস করতে। কিন্তু তাঁরা সেদিন অনেক বড়, অনেক উঁচুমাপের নেতার প্রমাণ দিয়েছিলেন। তাঁরা জাতির কাছে সে মাপের শ্রদ্ধা, সম্মান, স্বীকৃতি কি লাভ করেছেন? প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, সেই ৬ ডিসেম্বরের আলোচনায় ভারতের প্রখ্যাত সাংবাদিক, মুক্তিযুদ্ধের সাংবাদিক- মুক্তিযোদ্ধা মানস ঘোষ তাঁর বক্তব্যে জানান যে, কনফেডারেশন করে পাকিস্তান টিকিয়ে রাখার মোশতাকের নানা ষড়যন্ত্রের মধ্যে এক সময় সিআইএ তাজউদ্দীনকে অপহরণ করে তুলে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছিল, যা তাঁরা এক পর্যায়ে জানতে পারেন। মার্কিন দূতাবাসের এক সিআইএ এজেন্ট প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনের থিয়েটার রোডের অফিস কাম থাকা-খাওয়ার ছোট্ট কক্ষের বিপরীতে অবস্থিত একটি হোটেলের কক্ষ ভাড়া করে ঐ ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নে সচেষ্ট ছিল। তথ্যটি সাংবাদিকদের গোচরীভূত হলে তারা ছুটে যান ঐ এজেন্টকে ধরবার উদ্দেশ্যে। গিয়ে দেখেন, ততক্ষণ কক্ষটি শূন্য হয়ে গেছে, হাওয়া হয়ে যায় ঐ এজেন্ট। বাঙালী জাতিকে কতগুলো সত্যকে কৃতজ্ঞতার সঙ্গে সারাজীবন স্মরণে রাখতে হবে- বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চ স্বাধীনতার জন্য যে যুদ্ধ করতে হবে তা ভালভাবে উপলব্ধি করে কৌশলে জাতিকে যার যা আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তুলে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে আহ্বান জানিয়েছিলেন যে পরম বন্ধু, সহচর, বিশ্বস্ত, আপোসহীন নেতাদের ওপর আস্থা রেখে তারা ছিলেন তাজউদ্দীন, সৈয়দ নজরুল, মনসুর আলী, কামরুজ্জামান, মশিউর রহমান, জহুর আহমদ চৌধুরী, মোহাম্মদ আলী, মিজানুর রহমানসহ আরও হাজার হাজার সারাদেশে ছড়ানো আওয়ামী লীগ নেতা, কর্মী। নিঃসন্দেহে এদের মধ্যে তাজউদ্দীন ছিলেন প্রধান। কেননা, বঙ্গবন্ধু তাঁকেই সবার আগে, ২৫ মার্চেই ভারতে চলে যাওয়ার নির্দেশ দেন এবং ইন্দিরা গান্ধী সরকারের সঙ্গে সবরকম সংলাপ, আলোচনা করে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে তাজউদ্দীনকেই যোগ্যতম গণ্য করেছিলেন, এতে কোন সন্দেহ নেই। ইতিহাসে সাক্ষ্য আছে, ভুট্টো-মুজিব বৈঠকে ধূর্ত ভুট্টো যখন আলোচনার নামে সময়ক্ষেপণ করে বিমান ভর্তি সিভিল ড্রেসে পাকিস্তানী সৈন্য নিয়ে আসছিল, তখন এক সময় মন্তব্যে বলেছিল, ‘মুজিবের পাশে ঐ ছোটখাটো ফাইলপত্র হাতে থাকা ব্যক্তিটিকে নিয়ে আমার চিন্তা।’ সে ব্যক্তি বলা বাহুল্য তাজউদ্দীন সাহেব, বঙ্গবন্ধুর আস্থাভাজন সহচর। ইন্ধিরা গান্ধী তাজউদ্দীন সাহেবকেই বিশ্বাস করতেন। তাঁর সব আবেদন-চাওয়ায় যে যুক্তি থাকত, তাতে ইন্ধিরা গান্ধী সন্তুষ্ট হতেন এবং মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রয়োজনীয় সব কিছু রসদ-অস্ত্র-গোলাবারুদ, খাদ্য, ওষুধ, চিকিৎসা যোগানোর ব্যবস্থা করতেন তাজউদ্দীনের ওপর আস্থা ছিল বলেই। এ কথা বহুল কথিত যে, একমাত্র তাজউদ্দীন আহমদ তাঁর ছোট অফিসকক্ষে বসে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার যথাযোগ্য নির্দেশনা, সিদ্ধান্ত গ্রহণ, চিঠিপত্র তৈরিসহ সব কাজ করতেন এবং পাশের ছোট কক্ষে ছোট এক চৌকিতে ঘুমাতেন। ¯স্নান সেরে নিজের কাপড় নিজেই ধুতেন। পরিবারকে বলেছিলেন, যুদ্ধ শেষ না হওয়া পর্যন্ত তিনি পারিবারিক জীবনযাপন করবেন না। এ রকম স্থির প্রতিজ্ঞাবদ্ধ মেধাবী নেতা জাতি তার ক্রান্তিকালে মহান মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য লাভ করেছিল- এ ছিল জাতির পরম সৌভাগ্য, যিনি মুক্তিযুদ্ধের শত্রুমিত্র চিনতে দেরি করতেন না, তাদের সব ষড়যন্ত্র ও মন্দ উদ্দেশ্যকে ব্যর্থ করে দিতে ভিন্ন ভিন্ন কৌশল গ্রহণ করতে দক্ষ ছিলেন বলেই বহু অজানা-জানা ষড়যন্ত্রকে এভাবে পরাজিত করে মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের, ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে এবং সর্বোপরি বঙ্গবন্ধুকে ও বাঙালী জাতিকে বিজয়ী করে স্বাধীন বাংলাদেশ উপহার দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। অবশ্যই তার সঙ্গে, পাশে, রণাঙ্গনে ছিল লাখ লাখ নেতা, কর্মী, বীর সেনানায়ক, সেনা, মুক্তিযোদ্ধা, গেরিলা ক্র্যাক প্লাটুন, নৌ-কমা-ো। আরও ছিল ভারতীয় সেনাবাহিনীর, ভারতীয় জনগণের, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের, রাশিয়া সরকার ও জনগণের সমর্থন, সাহায্য-সহযোগিতা। কিন্তু এত সব কিছুকে নানা রাজনৈতিক দলের মুক্তিযোদ্ধাদের এবং রাজনীতিকদের সমন্বয় করে একদিকে এক কোটি শরণার্থীর খাদ্য, আশ্রয়, চিকিৎসা, অপরদিকে রণাঙ্গনকে সুচিন্তিত সেক্টরে ভাগ করে সেনা কর্মকর্তা ও সিভিল মুক্তিযোদ্ধাদের সমন্বয় করে বিশাল একটি যুদ্ধ পরিচালনা করা এবং শেষ পর্যন্ত সব বাধা-ষড়যন্ত্রকে পরাজিত করে বিজয় ছিনিয়ে আনা- এক কথায় পরমাশ্চর্য বিরল একটি ঘটনা। এ ঘটনার প্রধান নায়ক তিনি। অন্য নেতারা অবশ্যই নানা কাজে দিন-রাত ব্যস্ত ছিলেন। কিন্তু সবার সব কাজকে একটি মাত্র লক্ষ্য-বিজয়ে উপনীত হতে সফলভাবে পরিচালনা করেছেন যিনি তিনি হলেন নিঃসঙ্গ সারথী তাজউদ্দীন আহমদ। এর জন্য যে মেধা, বুদ্ধি, উদ্ভাবনী ক্ষমতা, সমন্বয়ের দক্ষতা, দূরদৃষ্টি, শত্রু, মিত্র চিহ্নিত করতে পারার বোধ এবং সর্বোপরি ষড়যন্ত্র ও বাধা অতিক্রম করার কৌশল এবং সমস্যার সমাধানের যে মানের দক্ষতার প্রয়োজন ছিল, সেসব দুর্লভ গুণ তাজউদ্দীন আহমদের মধ্যে ছিল বলেই বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম তাঁর হাত দিয়েই সম্ভব হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু যে স্বপ্নের দ্রষ্টা, সে স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধের সফল পরিচালনার মাধ্যমে তাঁর সমান দূরদৃষ্টিসম্পন্ন, সজাগ, সচেতন, সমস্যা সমাধানে সমান পারঙ্গম তাজউদ্দীন আহমদের। তাজউদ্দীন আহমদ আন্তরিক রাজনৈতিক সঙ্গীদের সর্বাত্মক সহযোগিতা পেয়েছিলেন- সেই সৈয়দ নজরুল, মনসুর আলী, কামরুজ্জামান, তাঁরই সঙ্গে অন্তরীণে থেকে তাঁরই সঙ্গে নিহত হয়ে প্রাণ উৎসর্গ করেছেন! খুব আশ্চর্য হই এই ভেবে যে, ’৭১-এর শহীদদের রক্তে মিশে গেছে বঙ্গবন্ধুর রক্ত, আবার বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযোদ্ধাদের রক্তের সঙ্গে মিশে গেছে তাজউদ্দীন, সৈয়দ নজরুল, মনসুর আলী, কামরুজ্জামানের রক্ত! স্বপ্নদ্রষ্টার রক্তের সঙ্গে মিশেছে স্বপ্নকে বাস্তবে রূপদানকারীদের রক্ত! ইতিহাসের অশ্রুতে ধোয়া কোন এক বেদীতে বসে তাঁরা পাঁচজন আমাদের দিকে তাকিয়ে আছেন। জাতি তাঁদের ভোলেনি। জাতি চায় উন্নত হতে থাকা দেশের কয়েকটি বড় স্থাপনার নাম হবে স্বাধীনতার প্রধান রূপকারদের নামে, নতুবা নতুন প্রজন্ম তাঁদের অবিস্মরণীয় অবদান ভুলে যাবে। এঁরা ছাড়াও ’৭১-এ প্রত্যেক জেলায় আওয়ামী লীগের দক্ষ, আন্তরিক, নিঃস্বার্থ নেতারা ছিলেন, ছিলেন বীর মু্িক্তযোদ্ধারা, অকুতোভয় গেরিলারা, বীরাঙ্গনারা- তাঁদের নামে অনেক স্মারক স্থাপনা, ব্রিজ, রাজপথ-হাইওয়ে, বিমানবন্দর, স্টেডিয়াম, শিল্পাঞ্চল হতে পারে। আমাদের ’৭১-এর যুদ্ধশিশুদের দত্তক গ্রহীতা কানাডিয়ান দম্পতিদের কৃতজ্ঞতা জানানোরও প্রয়োজন আছে, আছে সেই সব যুদ্ধশিশুর একটি মিলনমেলা অনুষ্ঠানের। মাতৃভূমি ওদের মায়ের ভালোবাসা দেবে- এটাই তো হওয়া উচিত। লেখক : শিক্ষাবিদ
×