ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

দর্শকদের হৃদয়াকাশে ২০১৭

প্রকাশিত: ০৬:৩৬, ২৮ ডিসেম্বর ২০১৭

দর্শকদের হৃদয়াকাশে ২০১৭

এই গেল বছরের কথা। ডিসেম্বর ২০১৬। একেবারেই শেষের দিকে, প্রায় সব পত্রপত্রিকা থেকে টেলিভিশন আসছে বছর ২০১৭ সালকে স্বাগত জানিয়ে নানা বিষয়ের কত সম্ভাবনার খবর দেখিয়েছে, ছাপিয়েছে। এটা কিন্তু গত বছরের কোন বিশেষ ঘটনা নয়। বিগত সব বছর শেষে এমনটা হওয়া স্বাভাবিক। সত্য বলতে আমরা যে কোন নতুন বিষয় বা অধ্যায় একটা ইতিবাচক চিন্তার ভেতর শুরু করি বা করতে অভ্যস্ত। আমাদের মন সেটাই সমর্থন করে। কিন্তু সত্য যেটা ঘটে সেটা কিন্তু বছর শেষে আমরা অনুমান করি। অসলে সত্য হলো ভাল-মন্দ বা শুভ-অশুভ নিয়েই আমাদের জীবন। তার পরও আমরা নতুন বছর মনে যা কিছু ভাল তার সব নিয়েই ভাবতে ভালবাসি। অন্য সবদিকের মতো আমাদের বিনোদন দুনিয়া নিয়েও ইতিবাচক চিন্তা ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু বাস্তবে, ২০১৭ সাল ছিল এই দুনিয়ার অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার বছর। সব ঘটনা আলাদা আলাদা করে উল্লেখ করলে, লেখা হবে অনেক বড়। তবে সারা বছর দর্শকদের হৃদয়াকাশে যে ঘটনাগুলো নানাভাবে উঁকিঝুঁকি মেরেছে, প্রভাবিত করেছে। এমনকি কোন কোন বিষয়ে সরাসরি প্রতিক্রিয়া দেখানোর চেষ্টা করেছে। সেই বিষয়গুলো শুধু মনে করিয়ে দেয়া। লিখেছেনÑ সব্যসাচী দাশ নায়করাজ রাজ্জাকের প্রয়াণ ’৪৭-এর দেশ ভাগের আগে এবং পরে এই উপমহাদেশ ছিল সবদিক থেকেই উত্তাল! এর মধ্যে যথাসম্ভব একেকটি ব্যক্তিজীবন ছিল সব থেকে বেশি উত্তাল! সময়ের প্রচ- অস্থিরতার প্রভাবে বেশিরভাগ মানুষের জীবন ছিল দিশেহারা। এই টালমাটাল ¯্রােতে এক রকম উজানে নৌক বেয়ে ওপার বাংলা থেকে এই বাংলায় জীবন এবং পরিবার নিয়ে চলে আসেন এই অপরাজেয় মানুষটি। সময়, ১৯৬৪ সাল। অসভ্য সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় তছনছ পশ্চিম বাংলাসহ ভারতবর্ষের বেশকিছু এলাকা। রাজ্জাক তখন স্ত্রী ও এক সন্তানের জনক। জীবন বাঁচাতে এদের সঙ্গে নিয়ে চলে আসেন ঢাকায়। ঢাকা তাঁর জীবন তুলনামূলক নিরাপদ হলেও নিরাপদ ছিল না তাঁর জীবিকার পথ। হতাশার অতল সাগরে নিমজ্জিত হতে হয় এই মানুষটিকে। নিজের যোগ্যতা বলতে অভিনয়যোগ্যতাই ছিল সার। কেননা ওই বাংলায় কিশোর বয়স থেকেই (সপ্তম শ্রেণীর ছাত্রাবস্থায়) মঞ্চে অভিনয় করেছেন। ঢাকায় যখন তিনি এলেন তখন এই বাংলায় চলছে পাকিস্তানী শাসকের নিদারুণ শোষণ। সেই শোষণকালীন সময়ে রাজ্জাক ‘ঘরোয়া’ নামে একটি ধারাবাহিক নাটকে অভিনয় করে দর্শকদের তার নাম জানান। এরপর আবদুল জব্বার খানের সহযোগিতায় ফিল্মে কাজ করার সুযোগ পান। ১৯৬৬ সালে ‘১৩ নম্বর ফেকু ওস্তাগার লেন’ চলচ্চিত্রে একটি ছোট চরিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে বড় পর্দায় রাজ্জাকের অভিষেক ঘটে। এরপর ‘কার বউ’, ‘ডাক বাবু’, ‘আখেরী স্টেশন’ নামে সিনেমায় ছোট ছোট চরিত্রে অভিনয় করে নিজেকে চেনাতে থাকেন। প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা জহির রায়হানের সিনেমা ‘বেহুলা’র প্রধান চরিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে ঢাকাই দর্শকদের আশিষ লাভ করেন নায়করাজ। এরপর তাঁকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। এরপর ‘আগুন নিয়ে খেলা’, ‘এতটুকু আশা’, ‘নীল আকাশের নীচে’, ‘জীবন থেকে নেয়া’, ‘ওরা ১১ জন’, ‘অবুঝ মন’, ‘রংবাজ’, ‘আলোর মিছিল’, ‘অশিক্ষিত’, ‘ছুটির ঘণ্টা’, ‘বড় ভাল লোক ছিল’সহ এ রকম চমৎকার চমৎকার প্রায় ৩০০ চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। স্বাধীনতা পুরস্কার, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, শ্রেষ্ঠ অভিনেতার পুরস্কার, বাচসাস পুরস্কারসহ অনেক পুরস্কার তাঁর নামের সুবিচার করেন। সিনেমাও পরিচালনা করেছেন প্রায় ষোলোটি। তাঁর ৭৫ বছর জীবনের দীর্ঘ ৫৩ বছর কাটিয়েছেন অভিনয়ের সঙ্গে। যে কারণে অসংখ্য মানুষ তাঁকে কয়েক যুগ ধরে দেখেছেন, সময় আর মায়ায় খুব আপন করে নিয়েছেন। কেউ কেউ করেছেন তাঁকে ব্যক্তিগত সুখ দুঃখের সঙ্গী। অভিনয়কে ভালবাসার পাশাপাশি, পেশাদারিত্বের ঠিকঠিক মর্যাদা দেয়ায় নায়করাজ অসংখ্য হৃদয় জেতার মতো কঠিন কাজ নিজের অজন্তেই করেছেন। তাঁর ফুলের মতো সারল্যভরা হাসি, হৃদয় ভোলানো অভিনয় সত্যই আপামোর দর্শকদের হৃদয়ে দাগ কেটেছে। এ সবকিছুর মায়া কাটিয়ে গত ২ আগস্ট এই গুণী মানুষটি যখন ইহলোকের মায়া কাটিয়ে পরলোকে চলে যান তখন, তাঁর অসংখ্য ভক্ত-অনুরাগী থেকে সহকর্মী সকলেই ভীষণভাবে মর্মহত হন। আসলে প্রায় গত হতে যাওয়া এই বছরটির আলোচনার পর্বে ছিল আমাদের এই মহানায়কের প্রয়াণ। শাকিক-অপুর রোম্য বেশ জল্পনা-কল্পনা এবং রোম্য আলোচনা বেশ আগেই শুরু হয়েছিল! ঢাকাই সিনেমার জনপ্রিয় নায়িকা অপু বিশ্বাস যখন থেকে দীর্ঘ সময় ধরে সব ধরনের খবরের বাইরে ছিলেন, টেলিভিশন, পত্রপত্রিকা বেশ খোঁজাখুঁজি করেও তাকে আবিষ্কার করতে পারছিল না! এভাবেই কিছুকাল কাটছিল তার অদৃশ্য অবস্থান। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে অল্প বিস্তর চলচ্চিত্রপাড়া বিভিন্ন মনগড়া খবর প্রায়াই এ মাথা-ও মাথা হচ্ছিল! সবকিছু হটিয়ে একদিন বিকেলে খবর এলো আগামীকাল একটি চ্যানেলে লাইভ প্রোগ্রামে আসছেন অপু! বিষয়টা এমন ছিল যে, বাংলার অসংখ্য মানুষ পারলে ওই রাতটা নির্ঘুম কাটায়! অবশেষে রাত শেষ হলো। সকাল হলো এরপর বেলা গড়িয়ে দুপুর, দিনের শেষভাগে আশ্চর্যের এক জাদুর খ- কোলে নিয়ে ক্যামেরার সামনে উপস্থিত হলেন চিত্র নায়িকা অপু বিশ্বাস। গভীর বেদনার সঙ্গে জানালেন তার দীর্ঘদিনের আড়ালে থাকার গল্প! অপু বললেন, আমি এখন বিশ্বাস থেকে ইসলাম। আমার কোলে আমার সন্তান জয়। আমার স্বামী শাকিব খান। ২০০৮ এর ১৮ এপ্রিল আমাদের বিয়ে হয়েছে। ঢাকাতেই। পরিবার পরিজনের উপস্থিতিতে। গত বছর ২৭ সেপ্টেম্বর কলকাতায় জন্মায় জয়। এখন আমরা দুজনেই স্বামীর সংসার এবং বাবার ¯স্নেহ থেকে বঞ্চিত। সারাদেশের অসংখ্য মানুষ তার এই বক্তব্য মন্ত্রমুগ্ধের মতো শোনে। এখান থেকেই শুরু তাদের ব্যক্তিগত জীবনের খোঁজখবর। এই ঘটনার রেস বছরজুড়ে বেড়েছে ছাড়া কমেনি! দিন দিন যেন এই বিষয়ের আলোচনা আরও বাড়ছে! বছর শেষের খবর, চিত্রনায়ক শাকিব খান উকিল নোটিস পাঠিয়ে স্ত্রী অপু বিশ্বাসকে তালাকের সিদ্ধান্ত জানান। এরপর ঘটনা মোড় নেয় নতুন মেরুতে। এভাবেই নতুন নতুন ঘটনায় সারা বছর পর্দার বাইরে আলোচনায় আছেন আপাতত এই তারকা দম্পতি! স্বপ্নের নায়ক সালমান শাহের মৃত্যু রহস্য দীর্ঘ ২১ বছর আগে বাংলার তুমুল জনপ্রিয় চিত্রনায়ক সালমান শাহ মারা যান। তাঁর ওই অনাকাক্সিক্ষত মৃত্যু কত যে শত শত হৃদয়ে রক্তক্ষরণ ঘটিয়েছে তার অন্ত নেই! সে সব লিখে বা বলে শেষ করা যাবে না। বাংলার চলচ্চিত্রকাশে যে ক’টি ধ্রুবতারা দর্শক হৃদয়ে প্রেমের প্রদীপ জ্বালিয়েছেন, তাঁর মধ্যে সালমান অন্যতম। তাঁর ওই অনাকাক্সিক্ষত মৃত্যু সে সময় কেউই মেনে নিতে পারেনি। আজও তাই! মৃত্যুর পর থেকেই তাঁর পরিবার এবং ভক্তকূল অভিন্ন কথা বলে আসছেন, তাদের সন্তান বা প্রিয় নায়ক আত্মহত্যা করেননি। তাকে হত্যা করা হয়েছে। ২১ বছর পর যখন তার অপমৃত্যু মামলার ৮ম আসামি রাবেয়া সুলতানা রুবী সুদূর আমেরিকা থেকে এক ভিডিও বার্তায় সালমানের মায়ের উদ্দেশে কেদেঁ কেঁদে বলেন, ‘ভাবি, আপনার ছেলে আত্মহত্যা করে নাই তাকে হত্যা করা হয়েছে।’ মুহূর্তেই তার এই ভিডিও বার্তা ঢাকাসহ সারাদেশের অসংখ্য মানুষ বিদ্যুতের ঝলকানির মতো চমকে গেলেন। অসংখ্য ভক্ত সরাসরি বলেই ফেললেন, এই সত্য তো আমরা অনেক আগেই ধারণা করে রেখেছি! শুরু হয় সামাজিক যোগাযোগা মাধ্যম থেকে চায়ের টেবিলে আলোচনার ঝড়! নতুন করে আবারও অসংখ্য ভক্ত দর্শকের মাঝে ফিরে আসে সেই রাজপুত্র। রাজপথে তার হত্যার বিচারের দাবিতে মানববন্ধন পর্যন্ত করেছে তাঁর ভক্তকুল! আলোচনা এতটাই বেশি ছিল যে, এই বিষয় নিয়ে টেলিভিশনের পর্দায় আসতে হয়েছে সালমানে স্ত্রী, শ্বশুরসহ অনেকেই। অবশেষে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)-কে এই মৃত্যু সংক্রান্ত পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট দিতে বলা হয়। এসবের বাইরে আসল সত্য হলো নায়ক সালমান শাহ সত্যিকার অর্থে আজও মরেনি! তাঁর অগণিত ভক্তকুলের হৃদয়ে! যখন তাকে নিয়ে কোন না কোন খবর প্রকাশিত হয় তখনই শুরু হয় সালমান ভক্তদের চাঞ্চল্য! চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির নির্বাচন ২০১৭ চলচ্চিত্র শিল্প এবং শিল্পীদের ভাল-মন্দ দেখভালের জন্য ‘বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতি’ নামে একটা সমিতি আছে। এই সমিতির পরিচালনা পর্ষদ দুই বছর মেয়াদে শিল্পীদের ভোটে নির্বাচিত হয়। গত ২ ফেব্রুয়ারি আগের সমিতির মেয়াদ শেষ হয়। যে কারণে বছরের শুরুতেই ছিল নতুন কমিটি নির্বাচনের তোড়জোড়! আলাদা আলাদা প্যানেল, নতুন সম্ভাবনার নির্বাচনী ইশতেহার চলছিল বেশ রাঘঢাকে জোর প্রচারণা, মিশা সওদাগর, জায়েদ খান বনাম ওমর সানী, ফেরদৌস, প্যানেলের মধ্যে গত পাঁচই মে শুক্রবার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। আগের সভাপতি শাকিব খান অবশ্য এবার প্রার্থী ছিলেন না। তবে ওমর সানী-ফেরদৌস প্যানেলকে সমর্থন করেছেন। নির্বাচনের দিনে মধ্য রাতে ভোট গণনার সময় একটা সিনেমাটিক ঘটনা ঘটে, বাস্তবে নায়কের গায়ে হাত তোলার মতো গুরুতর ঘটনা! যদিও পরবর্তীতে এটা অসত্য বলে প্রমাণিত হয়। শিল্পী সমিতি এই নির্বাচন নিয়ে অনেক নতুন নতুন ক্লাইমেক্সে বহু সিনেমাপ্রেমী দেখেছেন! বছরের অনেকটা সময়জুড়ে ছিল এই গরম হওয়া! ডুব ও অন্যান্য ভারতীয় তথা আন্তর্জাতিক অঙ্গনের শক্তিমান অভিনেতা। ইরফান খান, ঢাকাই সিনেমার পরিচালক মোস্তফা সরোয়ার ফারুকীর পরিচালনায় অভিনয় করছেন। এ প্রসঙ্গে ভারতীয় প্রভাবশালী পত্রিকা আনন্দবাজারে তাঁর একটি সাক্ষাতকার ছাপা হয়। সেখানে তিনি এক প্রশ্নের উত্তরে বলেন, বাংলাদেশের জননন্দিত কথাসাহিত্যক হুমায়ূন আহমেদের জীবনী নিয়ে এই সিনেমার গল্প। এই খবর যখন ঢাকায় রাষ্ট্র হয় তখন কত ঘটনাই আমরা দেখলাম সঙ্গে সাক্ষ্যও হলাম। অবশেষে ডুব মুক্তি পেল এবং সবাইকে সঙ্গে নিয়ে ভেসে উঠল! ডুব সিনেমার মোহে পড়ে আমাদের কেটে গেছে বছরের অনকটা সময়। এ ছাড়া জনপ্রিয় তারকা দম্পতি তাহসান-মিথিলার বিবাহবিচ্ছেদ। গুণী শিল্পী লাকী আখন্দ, আবদুুল জব্বার, বারী সিদ্দিকী, অকাল মৃত্যুখবর দর্শদের অনেকটা সময় মনোযোগ কেড়েছে! এসবের ভেতর মৌলিক থ্রিল গল্পের সিনেমা ‘ঢাকা অ্যাটাক’ টেলিফিল্ম ‘বড়ছেলে’-এর সাফল্য রেস ছিল বছরের অনেকটা সময় দর্শকদের ভালবাসার মণিকোঠায়।
×