ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

বেঙ্গল উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত

কত্থক সন্তুর ও খেয়ালের অনুরণনে বিনিদ্র রজনী

প্রকাশিত: ০৫:২৫, ২৮ ডিসেম্বর ২০১৭

কত্থক সন্তুর ও খেয়ালের অনুরণনে বিনিদ্র রজনী

মনোয়ার হোসেন ॥ কেমন করে যেন হারিয়ে যায় রাতের ঘুম। সুরের বৈভবে উড়ে যায় তন্দ্রাচ্ছন্ন ভাবটি। তাল ও লয়ের খেলায় অবসন্নতার বদলে মধ্যরাতেও চনমনে হয়ে ওঠে ইন্দ্রিয়। আর এভাবেই শ্রোতা-দর্শককে নির্ঘুম করে রাখে বেঙ্গল উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত উৎসব। তাই তো রাগ-রাগিনীর ব্যাকরণ বোঝা বোদ্ধা না হয়েও সুরের সম্মোহনী টানে এ উৎসবে জড়ো হয় অগণন সুররসিক। বুধবার উৎসবের দ্বিতীয় রাতেও সে দৃশ্যের ব্যত্যয় ঘটেনি। নয়নজুড়ানো কত্থক নৃত্য, সন্তুরের সুমধুর সুর ও খেয়ালের মোহময় অনুরণনে কেটেছে তাদের বিনীদ্র রাত। সঙ্গীত জাগায় প্রাণ প্রতিপাদ্যে বেঙ্গল ফাউন্ডেশন আয়োজিত ষষ্ঠতম উৎসবের নতুন ভেন্যু ধানম-ির আবাহনী মাঠ। স্কয়ার নিবেদিত ও ব্র্যাক ব্যাংকের সহযোগিতায় অনুষ্ঠিত উৎসবটি উৎসর্গ করা হয়েছে অধ্যাপক আনিসুজ্জামানকে। পঞ্চরজনীর বেঙ্গল উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত উৎসবের দ্বিতীয় রাত ছিল বুধবার। এ রাতের পরিবেশনা পর্ব শুরু হয় কত্থক নাচের নান্দনিকতায়। ‘উৎসব’ নামের মন রাঙানো পরিবেশনা নিয়ে মঞ্চে আসে ভারতের প্রখ্যাত কত্থক নৃত্যশিল্পী অদিতি মঙ্গলদাস। এই শিল্পীর নেতৃত্বে অনবদ্য পরিবেশনাটি উপস্থাপন করে অদিতি মঙ্গলদাস ড্যান্স কোম্পানি। সাত সদস্যের নৃত্যশিল্পীর দলটির হাতের আঙ্গুলগুলোও যেন বলে যায় কথা, চোখের মণিকোঠায় উঠে আসে ভাষা। সেই সঙ্গে ঘুঙুরপরা পায়ের কারুকাজ মাতিয়ে দেয় মন। এভাবেই শিল্পীদের তাল ও লয়সমৃদ্ধ মুদ্রার সঙ্গে অভিব্যক্তির সম্মিলনে অপূর্ব নৃত্যশৈলীতে ঝরে পড়ে উৎসব উপভোগকারীদের মুহুর্মুহু করতালি। দলটির দ্বিতীয় পরিবেশনার শিরোনাম ছিল ‘প্রিয়তমের খোঁজে’। তুর্কী বংশোদ্ভূত সঙ্গীতসাধক এবং ফার্সী ও হিন্দী ভাষার কবি হযরত আমির খসরুর মানব ও ঈশ্বরপ্রেমের বর্ণনায় রচিত কবিতাংশ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে নৃত্য পরিবেশন করেন অদিতি ও তার দল। তারানার মাধ্যমে শেষ হয় অদিতি ও তার দলের পরিবেশনা। অদিতি মঙ্গলদাসের সঙ্গে পরিবেশনায় অংশ নেয়া বাকি ছয় সদস্য হলেন গৌরি দিবাকর, মিনহাজ, আ¤্রপালি ভা-ারি, অঞ্জনা কুমারী, মনোজ কুমার ও সানি শীর্ষদিয়া। দলটির সঙ্গে কণ্ঠ ও হারমোনিয়ামে সঙ্গত করেন ফারাজ আহমেদ, তবলা ও পাঢ়ান্তে মোহিত গাঙ্গানি, পাখোয়াজে আশীষ গাঙ্গানি ও বাঁশিতে ছিলেন রোহিত প্রসন্ন। আর তিনটি উপস্থাপনার মধ্যে উৎসব পর্বের মূল পারকাশন রচনা করেছেন গোবিন্দ চক্রবর্তী। প্রিয়তমের খোঁজে পর্বের সঙ্গীত ভাষ্য সঙ্গীত রচনা করেন সামিউল্লাহ খান। তারানা পর্বের সঙ্গীত রচনা করেছেন শোভা মুডগাল ও আনীশ প্রধান। পরিবেশন শেষে শিল্পীদের হাতে উৎসব স্মারক তুলে দেন নাট্যজন রামেন্দু মজুমদার। কত্থক নাচ দেখার পালা শেষে তবলার বোলে উদ্দীপ্ত হয় উৎসব। দেশের শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের পুনর্জাগরণের বারতা দিয়ে মঞ্চে আসে বেঙ্গল পরম্পরা সঙ্গীতালয়ের শিক্ষার্থীরা। পরিবেশনায় অংশ নেয় প্রশান্ত ভৌমিক, সুপান্থ মজুমদার, এম যে জেসাস ভুবন, ফাহমিদা নাজনিন, নুসরাত-ই-জাহান ও শ্রেষ্ঠা প্রিয়দর্শিনী। সুরেশ তালওয়ালকরের পরিচালনায় নবীন তবলিয়ারা রাগ কিরওয়ানি নাগমায় তিন তালে কস্পোজিশন পরিবেশন করেন। পরিবেশনা শেষে শিল্পীদের হাতে সম্মাননা স্মারক তুলে দেন ঢাকার ভারতীয় হাইকমিশনার হর্ষবর্ধন শ্রিংলা। তবলার বোলের বাজনা শেষে বিশাল প্রান্তরে বয়ে যায় সন্তুরের সুরেলা ধ্বনি। সুরের আশ্রয়ে মানবিকতার ডাক দেয়া উৎসবটি আরও বর্ণিল হয়ে ওঠে প-িত শিবকুমার শর্মার সুনিপুণ বাদনে। মন উচাটন করা সুরে শ্রোতার অন্তরে ছড়িয়ে দেন প্রশান্তির পরশ। আলোড়িত হৃদয় খুঁজে পায় নির্মল আনন্দ। শ্রোতার সেই মুগ্ধতার রেশ ধরে কুড়িয়ে নেন কয়েক দফা করতালি। শুভ্রকেশী এই কিংবদন্তি শিল্পী পরিবেশন করেন রাগ ঝিঁঝোটিতে আলাপ, জোড়, ঝালা ও গত। তার সঙ্গে তবলায় সঙ্গত করেন যোগেশ শামসি ও তানপুরায় তাকাহিরো আড়াই। পরিবেশনা শেষে শিবকুমার শর্মার হাতে সম্মাননা স্মারক তুলে দেন পানিসম্পদমন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদ। দ্বিতীয় রাতের চতুর্থ পরিবেশনায় খেয়ালের হৃদয়গ্রাহী সুর নিয়ে মঞ্চে আসেন প-িত উলহাস কশলকর। এরপর ওস্তাদ শাহিদ পারভেজ খান পরিবেশন করেন সেতার। এরপর বেঙ্গল পরম্পরা সঙ্গীতালয়ের শিক্ষার্থী অভিজিত কু-ু পরিবেশন করেন ধ্রুপদ। প-িত রনু মজুমদারের বাঁশি আর প-িত দেবজ্যোতি বোসের সরোদের যুগলবন্দী পরিবেশনার মাধ্যমে শেষ হয় দ্বিতীয় দিনের আয়োজন। উপমহাদেশের প্রখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞদের পরিবেশনার পাশাপাশি উৎসব প্রাঙ্গণে চলছে বাংলাদেশের সঙ্গীত সাধক ও তাদের জীবনী নিয়ে সচিত্র প্রদর্শনী। এছাড়াও বেঙ্গল ইনস্টিটিউট অব আর্কিটেকচার, ল্যান্ডস্কেপস এ্যান্ড সেটেলমেন্ট আয়োজন করেছে ‘সাধারণের জায়গা’ শীর্ষক স্থাপত্য প্রদর্শনী। প্রথম দিনের মধ্যরাতের পরিবেশনার বিবরণ : মঙ্গলবার মধ্যরাতে খেয়াল পরিবেশন করেন বিদুষী পদ্মা তালওয়ালকর। তার সঙ্গে কণ্ঠে অঙ্কিতা দেওল, তবলায় ছিলেন সঞ্জয় অধিকারী এবং হারমোনিয়ামে রূপশ্রী ভট্টাচার্য্য সঙ্গত করেন। শিল্পী প্রথমে পরিবেশন করেন কেদার রাগ। এরপর তিনি দেশ রাগে তারানা, মীরার ভজন এবং সবশেষে পরিবেশন করেন রাগ বাগেশ্রী। পরিবেশনা শেষে বিদুষী পদ্মা তালওয়ালকরের হাতে উৎসব সম্মাননা স্মারক তুলে দেন জ্ঞানতাপস আব্দুর রাজ্জাক ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. আহরার আহমেদ। এরপর সেতার পরিবশেন করেন বাংলাদেশের ফিরোজ খান। তার সঙ্গে তবলায় ছিলেন জাকির হোসেন। তিনি ঝিঁঝোটি রাগ ও ধুন পরিবেশন করেন। পরিবেশনা শেষে শিল্পীর হাতে সম্মাননা স্মারক তুলে দেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া। এর পর খেয়াল পরিবেশন করেন বেঙ্গল পরম্পরা সঙ্গীতালয়ের শিক্ষার্থী সুপ্রিয়া দাস। তার সঙ্গে তবলায় ছিলেন প্রশান্ত ভৌমিক ও হারমোনিয়ামে গৌরব চট্টোপাধ্যায়। তিনি মালকোষ রাগে খেয়াল ও দেশ রাগে ঠুমরী পরিবেশন করেন। পরিবেশনা শেষে তার হাতে সম্মাননা স্মারক তুলে দেন বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান আবুল খায়ের। প্রথম দিনের আয়োজন শেষ হয় রাকেশ চৌরাশিয়ার বাঁশি ও পূর্বায়ন চট্টোপাধ্যায়ের সেতারের যুগলবন্দীর মধ্য দিয়ে। তাদের সঙ্গে তবলায় ছিলেন অভিজিৎ রায়। শুরুতেই এ যুগল পরিবেশন করেন রাগ ললিত; পরে বাজিয়েছেন জোড়, ঝালা ও গত। দুই শিল্পী পরিবেশনা শেষ করেন ভোররাতের রাগ ভৈরবীতে ধুন বাজিয়ে। শিল্পীদের হাতে সম্মাননা স্মারক তুলে দেন জনপ্রশাসন সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি এইচ এন আশিকুর রহমান। আজকের উৎসবসূচী : আজ বৃহস্পতিবার উৎসবের তৃতীয় দিন। এ রাতের আয়োজন শুরু হবে বেঙ্গল পরম্পরা সঙ্গীতালয়ের শিক্ষার্থীদের সেতার বাদনের মধ্য দিয়ে। এরপর ঘাটম ও কঞ্জিরার যুগলবন্দী পরিবেশনা উপস্থাপন করবেন বিদ্বান ভিক্ষু বিনায়ক রাম ও সেলভাগণেশ বিনায়ক রাম। খেয়াল পরিবেশন করবেন সরকারী সঙ্গীত কলেজের শিক্ষার্থীরা। এরপর সরোদ বাদন করবেন আবির হোসেন, বাঁশি বাদন করবেন গাজী আবদুল হাকিম, ধ্রুপদ পরিবেশন করবেন প-িত উদয় ভাওয়ালকর এবং বেহালা বাদনে অংশ নেবেন বিদুষী কালা রামনাথ। সব শেষে খেয়াল পরিবেশন করবেন প-িত অজয় চক্রবর্তী। এবারের বেঙ্গল উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত উৎসবের সম্প্রচার সহযোগী চ্যানেল আই, মেডিক্যাল পার্টনার স্কয়ার হাসপাতাল, ইভেন্ট ব্যবস্থাপক ব্লুজ কমিউনিকেশন্স এবং আয়োজন সহযোগী ইনডেক্স গ্রুপ, বেঙ্গল ডিজিটাল, বেঙ্গল বই ও বেঙ্গল পরম্পরা সঙ্গীতালয়। সার্বিক সহযোগিতায় পারফেক্ট হারমনি, সিঙ্গাপুর।
×