ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

একটি আসনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সাংগঠনিক কমিটি এবং বার্মিজ মহিলা -স্বদেশ রায়

প্রকাশিত: ০৫:১৯, ২৮ ডিসেম্বর ২০১৭

একটি আসনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সাংগঠনিক কমিটি এবং বার্মিজ মহিলা -স্বদেশ রায়

রংপুরের সিটি কর্পোরেশনে কোনরূপ প্রতিযোগিতায় যেতে না পেরে লজ্জাজনক হারের পর আওয়ামী লীগের জেনারেল সেক্রেটারি নানাভাবে বলার চেষ্টা করছেন, তার দল ভাল করেছে। পাশাপাশি অনেকটা ধরাশায়ী হওয়া কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের কথাও যখন উঠছে- তিনি সেখানেও তাঁর দল ভাল করেছে এমন যুক্তি দেখানোর চেষ্টা করছেন। জনাব কাদেরের এ চেষ্টা তাঁর দিক থেকে শতভাগ সঠিক। কারণ, তাঁকে এখন দুটো বিষয় রক্ষা করতে হবে। এক. দলের মনোবল ধরে রাখা; দুই. তিনি জেনারেল সেক্রেটারি হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পরে দল ভাল করছে এটা প্রতিষ্ঠিত করা। কারণ, তিনি জেনারেল সেক্রেটারি হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পরে দলের কোন জয়ের রেকর্ড নেই। তা ছাড়া তাঁর পেছনে সব সময়েই তাড়া করে ফিরছে সৈয়দ আশরাফের সাফল্য। শেখ হাসিনার যোগ্য সেক্রেটারি হিসেবে সৈয়দ আশরাফ বাংলাদেশের ইতিহাসে শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগকে যে পর পর দুইবার ক্ষমতায় বসিয়েছেন তাঁর সহযোগী ছিলেন। ১/১১-এর পরে তাঁর ভূমিকা উজ্জ্বল। আবার ২০১৩-তে ডিপ্লোমেটিক যুদ্ধেও তাঁর ভূমিকা ছিল প্রশংসার যোগ্য। সর্বোপরি, তিনি কথা কম বলতেন। তাই তাঁর কোন বেফাঁস কথার রেকর্ড নেই। প্রতিদিন অনেক কথা বলা এই বর্তমান জেনারেল সেক্রেটারি ইতোমধ্যে নিজেই বলেছেন, বেশি কথা বলা ঠিক নয়। বেশি বললে বেফাঁস বলা হয়ে যায়। নিজের সম্পর্কে এ উপলব্ধি সত্যিই প্রশংসার যোগ্য। তবে এই প্রশংসা করার পরেও বলতে হয়, তার পরেও তিনি প্রতিদিন অনেক কথা বলছেন। যাহোক, সেটা তাঁর নিজস্ব বিষয়। তা ছাড়া আমরা সাংবাদিকরা ওইভাবে প্রাকটিক্যাল পলিটিক্স বুঝি না, যা রাজনীতিকরা ইশারাতেই বুঝে ফেলেন। ওবায়দুল কাদের পোড় খাওয়া রাজনীতিক। তাই তিনি এই দুই সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে অসহায় পরাজয়ের পরেও সাফল্য খুঁজছেন। আর সেটাই স্বাভাবিক। পরাজয়ের ভেতর সাফল্য না খুঁজে পরাজয়কে ভবিষ্যতের বিজয়ের পিলার তৈরি করতে হয় এমনটি মত দিয়েছেন ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি, প্রাজ্ঞ ব্যক্তিত্ব এপিজে আবুল কালাম। ওবায়দুল কাদের বলছেন, রংপুর নির্বাচনে তাঁর দল ভোট বেশি পেয়েছে। যেহেতু কমিশনাররা বেশি ভোট পেয়েছেন। কমিশনার, ইউনিয়ন পরিষদ মেম্বার নানা হিসাব-নিকাশে ভোট পান। এ হিসাব বাস্তবে জাতীয় রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের ভোটের জন্য কতটা যুক্তিযুক্ত তাও ভেবে দেখা দরকার। তেমনি তিনি বলছেন, কুমিল্লার গত নির্বাচনের থেকে এবারের নির্বাচনে তাঁর দল ৩৫ হাজার বেশি ভোট পেয়েছে। এখানে একটু স্মরণ করিয়ে দেয়া প্রয়োজন মোট ভোটারের সংখ্যাও বেড়েছে। সংখ্যানুপাতে সেটা কতটুকু? তবে সঠিক কাজ হতে পারে পরাজয়কে পরাজয় হিসেবে মেনে নিয়ে বাস্তবতা খোঁজা। কেন পরাজিত হচ্ছে আওয়ামী লীগ? যেখানে শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা ৭৬ ভাগের ওপরে আর খালেদার ১৮ ভাগ, এরশাদের তার থেকেও কম, সেখানে কেন আওয়ামী লীগের সংগঠন শেখ হাসিনার জনপ্রিয়তাকে তাদের ভোটে রূপান্তরিত করতে পারছে না? বাস্তবে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক কাঠামোর অবস্থাটা কী? কেন তারা পারছে না? সামগ্রিকভাবে সারাদেশে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক কাঠামোর অবস্থার খোঁজ নিতে হলে কিছুটা সময়ের দরকার। সাংবাদিকদের জন্য সেটা অসম্ভব কিছু নয়। বরং খুবই সহজ রিপোর্ট এটা। তবে সত্য হলো স্থানীয় সাংবাদিকদের দিয়ে ওই সংবাদ সঠিকভাবে সংগ্রহ সম্ভব নয়। স্থানীয় সাংবাদিকরা স্থানীয় কিছু কিছু আওয়ামী লীগ নেতার প্রতাপের ভয়ে ভীত। তারা প্রকৃত সত্য রিপোর্ট করতে পারবেন না। যাহোক, রংপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে এই পরাজয়ের পর একটি সংসদীয় আসনে আওয়ামী লীগের ও অন্যান্য দলের সঠিক সাংগঠনিক অবস্থার খবর নেয়ার চেষ্টা করি। আর সেই চেষ্টা থেকে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের একটি নির্বাচনী এলাকার সাংগঠনিক অবস্থার খবর পাই। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ওই নির্বাচনী এলাকায় আওয়ামী লীগের ইউনিয়ন ও গ্রাম পর্যায়ে কমিটি হয়েছিল আজ থেকে বারো বছর আগে। এর পরে আর কোন নতুন কমিটি হয়নি। একটি কমিটি বারো বছরের পুরনো হলে সেখানে সাংগঠনিক অবস্থা কী দাঁড়ায় তা নিশ্চয়ই ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন পড়ে না। কারণ বারো বছর আগে যিনি যুবক ছিলেন তিনি এখন প্রৌঢ়। অতএব তার পক্ষে কোনমতেই তরুণ ভোটারদের সঙ্গে যোগযোগ রক্ষা করা সম্ভব নয়। অন্যদিকে দেশে এখন ১৫ থেকে ৩৫ অবধি বয়স এমন মানুষের সংখ্যা কম-বেশি নয় কোটি। তার অর্থ দাঁড়ায় যে কোন নির্বাচনে এখন তরুণ ভোটাররাই মূল ফ্যাক্টর। রংপুরের যে প্রার্থী ছিলেন আওয়ামী লীগের তাঁর পক্ষে তরুণ ভোটার টানা কোনমতেই সম্ভব ছিল না। এ কাজটি করতে হতো সংগঠনের তরুণদের। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের যে নির্বাচনী আসনটির কথা বলছি, সেখানে কমিটি যেহেতু বারো বছর আগের, তাই প্রত্যেকটি ইউনিয়ন ও গ্রাম কমিটির প্রধান এখন বয়সের ভাবে ন্যুব্জ। বারো বছর আগে একজন সিনিয়র বা পরিণত যুবককেই তো কমিটি প্রধান করা হয়েছিল। এদের অনেকেরই এর ভেতর দু-একবার স্ট্রোক হয়ে গেছে। তাছাড়া হার্টের সমস্যা, ডায়াবেটিস ইত্যাদি তো আছেই। তাই তারা মাঠ পর্যায়ে ছুটোছুটি করে কতটুকুই বা আওয়ামী লীগের জন্য করতে পারবেন? অন্যদিকে এই জেনারেশনের আরও একটি সমস্যা আছে, তারা তরুণদের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেন। তাদের হুকুম করতে ভালবাসেন। বর্তমানের তরুণরা অনেক বেশি আত্মসম্মান বোধসম্পন্ন। প্রযুক্তির কারণে তারা যোগ্যও অনেক বেশি। সিনিয়ররা ওই বয়সে যতটুকু যোগ্য ছিলেন তার থেকে বেশি যোগ্য এরা। তাই তরুণরা সাধারণত এ ধরনের সিনিয়রদের ধারে-কাছে ভিড়তে চান না। অন্যদিকে সিনিয়রদের আরও একটি সমস্যা আছে, তারা এখনও পাকিস্তানী আমলের সেই ভাষণ, সেই আন্দোলনের রাজনীতি করেন। সেই যাত্রাপালার ঢঙে, কবিতার ছন্দে কথা বলেন। যা এখনকার তরুণদের কাছে হাসির খোরাক মাত্র। এ ছাড়া তারা শেখ হাসিনার উন্নয়নের চিত্র তুলে না ধরে কয়েকটি গৎবাঁধা কথাতেই তাদের ভাষণকে সীমাবদ্ধ রেখেছেন। অন্যদিকে, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ওই সংসদীয় আসনটিতে বিএনপির সাংগঠনিক অবস্থা কেমন তারও খোঁজ নেই। খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম- গত ঈদের আগ পর্যন্ত ওই সংসদীয় আসনে বিএনপির ইউনিয়ন বা গ্রাম পর্যায়ে কোন কমিটি ছিল না। কিন্তু ঈদের পরে অতি স্বল্প সময়ের ভেতর চুপিসারে এবং খুবই তৎপরতার মাধ্যমে তারা সব ইউনিয়ন ও গ্রাম পর্যায়ে নতুন কমিটি তৈরি করছে। প্রতিটি ইউনিয়ন ও গ্রামে তারা শুধু বিএনপির কমিটি করেনি, যুবদল ও ছাত্রদলের কমিটিও তৈরি করেছে। তাদের এ কাজে সব থেকে বেশি সহযোগিতা করেছে জামায়াতের কর্মীরা। কারণ জামায়াতে ইসলামী জানে তারা আগামী নির্বাচনে নির্বাচন করতে পারবে না। এ কারণে বিএনপিকে সাংগঠনিকভাবে দাঁড়াতে সব ধরনের সহযোগিতা করছে তারা। এ ছাড়া ওই সংসদীয় আসনে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক অবস্থা এমন যে, গত বিজয় দিবসে থানার কোন আহ্বায়ক বা সহ-সভাপতি কাউকেই পাওয়া যায়নি বিজয় দিবসে ফুল দেয়ার জন্য। অন্যদিকে জেলা কমিটিও এই থানা কমিটি তৈরি করার ক্ষেত্রে তাদের ‘টেকনিক্যাল’ সমস্যায় আটকে আছে। কারণ নতুন করে ওই আসনের ইউনিয়ন ও গ্রাম পর্যায়ে কমিটি করতে হলে থানায় একজনকে নতুন আহ্বায়ক করে কমিটি করতে হয়, যারা ইউনিয়ন ও গ্রামগুলোতে কমিটি তৈরি করবেন। ওই আহ্বায়কও তৈরি করা সম্ভব হচ্ছে না। সেখানে রেট হচ্ছে দশ লাখ টাকা। সৎ কেউই দশ লাখ টাকা দিয়ে থানা কমিটির আহ্বায়ক হতে চাচ্ছে না। তার কাজ তো ইউনিয়ন ও গ্রাম কমিটি শেষ করে কাউন্সিল দিয়ে থানার নির্বাচিত কমিটি করা। এ জন্য সে কেন দশ লাখ টাকা বিনিয়োগ করতে যাবে? যদি আমাদের গ্রামীণ প্রবাদ সত্য হয় যে, ভাতের হাঁড়ির একটি ভাত টিপলে সব ভাতের অবস্থা বোঝা যায় তাহলে বাস্তব অবস্থা কী তা বুঝতে কারও কষ্ট হওয়ার কথা নয়। আর এই যদি গোটা হাঁড়ির ভাতের অবস্থা না হোক, হাঁড়ির বেশিরভাগ ভাতের অবস্থা হয়, তাহলে তো আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক অবস্থা জর্জ অরওয়েল যে সময়ে বার্মায় পুলিশ অফিসার ছিলেন, ওই সময়ের বার্মিজ মহিলাদের মতো। তখন ক্যান্সারে আক্রান্ত বার্মিজ মহিলারা কোন চিকিৎসা না করিয়ে বরং নিজের মুখে দিনে দু-তিনবার মেকআপ করত যাতে বোঝা না যায় ক্যান্সার তার যৌবন শেষ করে দিচ্ছে।
×