ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

ঢাকার রাস্তায় যানবাহনের কালোধোঁয়া

বায়ুদূষণে ব্রেন ড্যামেজ ক্যান্সারের মারাত্মক ঝুঁকি

প্রকাশিত: ০৫:১৫, ২৮ ডিসেম্বর ২০১৭

বায়ুদূষণে ব্রেন ড্যামেজ ক্যান্সারের মারাত্মক ঝুঁকি

জান্নাতুল মাওয়া সুইটি ॥ ‘লাব্বাইক’ নামের একটি বাস মালিবাগ মৌচাক মার্কেটের সামনে দিয়ে যেতেই চারদিক ছেয়ে গেল কালো ধোঁয়ায়। রাস্তার পাশে ফুটপাথে যাচ্ছিল দুই কিশোরী, কালো ধোঁয়ায় মুহূর্তেই তাদের শরীরে মিশে গেল। তরুণীরা সঙ্গে সঙ্গেই নাকে হাত চেপে নিশ্বাস বন্ধ করল। শুধু দুই কিশোরী নয় বাসটি যতক্ষণ ওঠা-নামার জন্য দাঁড়িয়ে থাকল আশপাশের পথচারীরা বাধ্য হলো নাকে হাত চেপে চলতে। এ দৃশ্য বুধবার দুপুরের। শুধু ‘লাব্বাইক’ বাস নয় বরং রাজধানীতে চলাচলকারী সব লক্কড়-ঝক্কড় ও ধোঁয়ানির্গত হওয়া যানবাহন অনেক রয়েছে। স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর ধোঁয়া নির্গমনকারী যান চলাচলে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। মোটরযান অধ্যাদেশ ১৯৮৩ অনুযায়ী, স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকারক কোনো ধোঁয়া নির্গত হলে তা দুইশ’ টাকা জরিমানাসহ শাস্তিযোগ্য অপরাধ। জরিমানা উপেক্ষা করেও রাজপথে হরহামেশা চলাচল করছে এসব যানবাহন। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, বায়ুতে মিশে থাকা অতিসূক্ষ্ম দূষণ কণা এতই ছোট যে সেগুলো নাকে ঢুকে মস্তিষ্কে চলে যেতে পারে এবং ব্লাড-ব্রেন ব্যারিয়ার নষ্ট করে দেয়। এতে স্নায়ু প্রদাহের সৃষ্টি করতে পারে, যা শিশুদের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। এমনকি যানবাহন থেকে নির্গত ধোঁয়ার ফলে ক্যান্সারের ঝুঁকি রয়েছে। লাব্বাইক, বিকাশ, ভিআইপি লিংক, বাহনসহ রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে ঘুরে বেড়ানো এসব বাস থেকে কালো ধোঁয়া বেশি নির্গত হয়। এমনকি ফার্মগেট থেকে ঝিগাতলা রুটের লেগুনাগুলোর বেশিরভাগই লক্কড়-ঝক্কড় ও পুরনো। এগুলো থেকেও ক্রমাগত ধোঁয়া নির্গত হয়। কালো ধোঁয়া বের হওয়া যানবাহন চালকদের মন্তব্য ‘এসব ভাবা মালিকের কাজ। আমি তো শুধু চালাই।’ এমনকি জরিমানার বিষয়টি সম্পর্কেও জ্ঞাত নন তারা বলে জানালেন অনেকে। বাস, লেগুনাসহ মাইক্রোবাস এমনকি ব্যক্তিগত গাড়িগুলোও এ তালিকায় আছে। বুধবার দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজার মোড়ে বাসের জন্য অপেক্ষা করছিলেন আজমেরি সাবাহ, তার মুখে ছিল মাস্ক। ধোঁয়ার কথা বলতেই বিরক্তি নিয়ে তিনি বলেন, ‘অ্যাজমার সমস্যা থাকায় বাইরে বের হলেই মাস্ক পরতে হয়। ঢাকার বাতাস খুব খারাপ। কারণ বাতাসে মিশে থাকা দূষণে আমার মত অসুস্থরা ঠিকভাবে শ্বাসও নিতে পারে না। এর ওপর প্রতিদিন যানবাহনের ক্ষতিকর ধোঁয়া খেতে হচ্ছে। ইনহেলার সব সময় সঙ্গে রাখি। বললেন, এই পরিবেশেই বেড়ে উঠছে আমাদের শিশুরা। বিষাক্ত বাতাসে তাদেরও স্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়ছে।’ প্রকাশিত ইউনিসেফের সম্প্রতি নতুন এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, এক বছরের কমবয়সী প্রায় ১৭ মিলিয়ন শিশু এমন এলাকাগুলোতে বসবাস করে, যেখানে বায়ু দূষণের মাত্রা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সীমার চেয়ে অন্তত ছয়গুণ বেশি। যার ফলে তাদের বিষাক্ত বায়ুতে শ্বাস নিতে হয়, যা তাদের মস্তিষ্কের বিকাশকে ঝুঁকিতে ফেলে। এসব ছোট্ট শিশুর তিন-চতুর্থাংশেরও বেশি অর্থাৎ ১২ মিলিয়ন (১ কোটি ২০ লাখ) দক্ষিণ এশিয়ায় বসবাস করে। বায়ু দূষণ কীভাবে ছোট শিশুদের মস্তিষ্কের বিকাশকে প্রভাবিত করতে পারে তা এই প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, দূষিত বায়ুতে শ্বাস নেয়া হলে তা সুনির্দিষ্টভাবে মস্তিষ্কের টিস্যু এবং জ্ঞানের বিকাশকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। যার বিরূপ প্রভাব বয়ে বেড়াতে হয় জীবনভর। অতিসূক্ষ্ম ম্যাগনেটাইটের মতো কিছু দূষণ কণা ঘ্রাণজনিত স্নায়ু এবং অন্ত্রের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করতে পারে এবং তাদের চৌম্বকীয় শক্তির (ম্যাগনেটিক চার্জ) কারণে অক্সিডেটিভ স্ট্রেস তৈরি করতে পারে, যা নিউরোডিজেনারেটিভ রোগের কারণ। পলিসাইক্লিক অ্যারোমেটিক হাইড্রো-কার্বনের মতো অন্য ধরনের দূষণ কণা মস্তিষ্কের এমন অংশের ক্ষতি করতে পারে, যেসব অংশ মস্তিষ্কের কোষের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন করে ও শিশুদের শিক্ষা এবং বিকাশের ভিত্তি রচনা করে। শিশুর মস্তিষ্ক অত্যন্ত নাজুক, কেননা প্রাপ্তবয়স্ক একজনের মস্তিষ্কের তুলনায় খুব অল্প পরিমাণে বিষাক্ত রাসায়নিকেই এটি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। বায়ু দূষণের ক্ষেত্রেও শিশুরা অত্যন্ত ঝুঁকিতে থাকে। কারণ তারা অনেক দ্রুত শ্বাস নেয় এবং তাদের শারীরিক প্রতিরক্ষা ও রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা সম্পূর্ণ বিকশিত থাকে না। বায়ু দূষণের ফলে শিশুর স্বাস্থ্যঝুঁকি প্রসঙ্গে ইউনিসেফের নির্বাহী পরিচালক অ্যান্থনি লেক বলেন, ‘দূষণ শুধু শিশুর ফুসফুসের গঠনকেই ক্ষতিগ্রস্ত করে না, এটা স্থায়ীভাবে তাদের মস্তিষ্কের বিকাশ ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে, যা তাদের ভবিষ্যতকেই ক্ষতির মুখে ফেলে। বায়ুদূষণ থেকে শিশুদের সুরক্ষিত রাখা গেলে তাতে শুধু তাদেরই উপকার নয়, সমাজও স্বাস্থ্যসেবা খরচ সাশ্রয় ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির মাধ্যমে এর উপকারিতা পায় এবং প্রত্যেকের জন্য একটি নিরাপদ-পরিচ্ছন্ন পরিবেশ তৈরি হয়। তার মতে, কোনো শিশুরই বিপজ্জনকভাবে দূষিত বাতাসে শ্বাস নেয়া উচিত নয় এবং কোন সমাজেরই বায়ু দূষণকে অবজ্ঞা করা উচিত নয়। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের মতে, ‘এসব গাড়ির পেট্রোলিয়াম আংশিক জ্বলে। ফলে বাতাসে বিষাক্ত পদার্থ বের হয়। মূলত সীসা-জাতীয় পদার্থ, যেটা শ্বাসতন্ত্রের জন্য ক্ষতিকর। এ ধোঁয়ার প্রভাব সরাসরি শিশুদের ওপর পড়ে। মানসিক বিকাশে সমস্যা হয়। এছাড়া কার্বন ডাইঅক্সাইড, কার্বন মনো-অক্সাইডও ছড়ায়। এতে এ্যাজমা হতে পারে এবং ফুসফুসের ক্ষতি করে।
×