ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

রিপোর্টারের ডায়েরি

প্রকাশিত: ০৫:৩৯, ২৭ ডিসেম্বর ২০১৭

রিপোর্টারের ডায়েরি

সবাই কি ওই রাতে গন্তব্যে ফিরেছিল? গত ২ ডিসেম্বর শনিবার পবিত্র ঈদ-ই-মিলাদুন্নবী উপলক্ষে সকল প্রতিষ্ঠানই বন্ধ। বলে রাখা ভাল গণমাধ্যমের ছুটি খুব একটা মেলে না। সরকারী বন্ধ থাকলেও পত্রিকা-টেলিভিশন খোলা থাকে। এমনকি খবরের খোরাক মেটাতে ঈদেও অনেক গণমাধ্যমকর্মী বাড়ি যেতে পারেন না। এর মধ্যেও দু’-একটা ছুটিতে পত্রিকা প্রকাশ না হলেও টেলিভিশন কিন্তু ঠিকই চালু থাকে। ঈদ-ই-মিলাদুন্নবী উপলক্ষে ২ ডিসেম্বর ছুটি হওয়ার কারণে পরের দিন ৩ ডিসেম্বর পত্রিকা প্রকাশ হবে না। তাই বাড়ি যাওয়ার একটা প্রস্তুতি ছিল। বৃহস্পতিবার অফিস করলাম। শুক্রবার সাপ্তাহিক আর শনিবার একদিনের বাড়তি ছুটি মিলে দুই দিনের একটু বিশ্রাম কাটাব বাড়িতে। যেই ভাবা সেই কাজ। অফিস শেষে রাত আটটার পরই বের হলাম। জনকণ্ঠ ভবন থেকে মহাখালী বাস টার্মিনাল যখন পৌঁছালাম প্রায় নয়টা ছুঁই ছুঁই। যানজট নিত্যসঙ্গী রাজধানীতে। তবে বাড়ি যাব ভেবে আর তেমন খারাপ লাগেনি। অনেক বাস অপেক্ষমাণ; কিন্তু ভাড়া যথারীতির চেয়ে বেড়ে গেছে দ্বিগুণ। বলে রাখা ভাল শুক্র-শনিবার সরকারী ছুটি হলেও অনেক বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে শনিবার অফিস করতে হয়। যেহেতু এদিন ছুটি ছিল তাই যাত্রীর চাপও বেড়েছে। আর পরিবহনেরও কদর বেড়েছে। ঢাকা-ময়মনসিংহ এনা বাসে সব সময় ভাড়া ২২০ টাকা। অন্যান্য বাসে ১৫০ টাকা। এদিন এনাতে লম্বা লাইন। আর অন্যান্য বাসে ভাড়া ৩৫০ টাকা। পরিবহন আছে, যাত্রীও আছে, তবে কোন পরিবহন ছেড়ে যাচ্ছে না। কারণ অতিরিক্ত ভাড়ার কারণে অনেকের ইচ্ছা থাকলেও সাধ্যে কুলিয়ে উঠতে পারছে না। আবার যাদের সাধ্য আছে তারা বাসে অপেক্ষা করলেও পর্যাপ্ত যাত্রী (সিট ফিলাপ) না হওয়ার কারণে বাস ছাড়ছে না। অতিরিক্ত ভাড়া দিয়েও অপেক্ষার যে কি বেদনা তা ভুক্তভোগীরাই ভাল জানে। এদিকে এনা গাড়ির নির্ধারিত ভাড়া এবং যাত্রাতে আরামদায়ক হওয়ার কারণে সবাই লাইন ধরে আছে টিকেট পাওয়ার জন্য। পূর্ব পরিচিত একজন আমার জন্য টিকেট আগেই কিনে অপেক্ষায় ছিলেন, কারণ বাস তখনও টার্মিনালে আসেনি। আমি যাওয়ারও প্রায় ২০ মিনিট পর সেই বাসটি এলো। আমরা সবাই বাসে উঠলাম। অতিরিক্ত ভাড়া নেয়া বাসগুলো যাত্রী ভরপুর হলে কিছু বাস ছাড়তে দেখা যাচ্ছিল। বাসে বসেই নজরে এলো এক মধ্য বয়স্ক নারীর। একটি শিশুকে কোলে আরেক হাতে একটি ব্যাগ নিয়ে এক বাস থেকে আরেক বাসের দিকে একটু তাড়াহুড়া করে যাচ্ছিলেন। খেয়াল করে দেখলাম মহিলাটি বারবার শিশুটিকে কোলে করে বড় ব্যাগটি হাতে নিয়ে বিভিন্ন গাড়ির হেলপারকে অনুরোধ করছে একটু কম ভাড়া নেয়ার জন্য। সে আকুতি কানে তুলছেন না কোন হেলপারই। আমাদের বাস যখন বের হচ্ছিল টার্মিনাল থেকে মহিলাটিকে তখনও দেখলাম আলম এশিয়া থেকে ছুটে যান ইসলাম পরিবহনে, ছুটে যাচ্ছেন নেত্রকোনা পরিবহনের দিকে। শেষ পর্যন্ত গন্তব্যে ওই নারী যেতে পেরেছিলেন কিনা জানি না। বেশি ভাড়া দিয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা হয়ত ওই নারীর ছিল না কিংবা অন্য কোন কারণও থাকতে পারে। শুধু ঈদের সময়ই আমাদের দেশে পরিবহন সেক্টরে ভাড়া বৃদ্ধি হয় তা কিন্তু নয়। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন দিবস উপলক্ষে একটু লম্বা ছুটি হলেই গাড়ির ভাড়া নির্ধারিত না থেকে বেড়ে যাওয়ার বিষয়টা খুবই অনাকাক্সিক্ষত। কখন ভাড়া বাড়ছে, আবার নির্ধারিত হচ্ছে নিয়মিত যাতায়াতের যাত্রীরাও ভুলে যান। আমাদের বাসটি ছুটে চলছিল। আর আমি ভাবছিলাম টার্মিনালে ওই নারীর বিভিন্ন পরিবহনের কাছে ছুটে চলা, সেইসঙ্গে আরও শত শত যাত্রীর অপেক্ষার বিষয়টি। মানুষকে বিপদে ফেলে, জিম্মি করে টাকা আদায় করাটাকে মুক্তিপণ আদায় করার মতোই মনে হয় আমার কাছে। কিন্তু যার টাকা নেই তার মুক্তি কি মিলবে না? এই বিষয়ে টার্মিনালে নিরাপত্তা বাহিনী বা পরিবহনের যে কমিটিগুলো হয় তাদের মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি থাকা প্রয়োজন। ঈদের সময় বিষয়টি নিয়ে গণ্যমাধ্যমগুলোতেও প্রচুর আলোচনা হয়। সব সময়ের জন্য এর একটা যৌক্তিক সমাধান প্রয়োজন। অপেক্ষারত যাত্রীদের টার্মিনালে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সারাটা পথই মনে হয়েছে এরা কি সবাই ওই রাতে গন্তব্যে ফিরেছিল? পরিবারের কাছে ফেরা, শিকড়ে ফেরা, বাড়িতে ফেরায় আনন্দ আছে, আবেগও আছে। কারও বাড়ি ফেরা মানে হয়ত অনেক স্বপ্নকে সঙ্গে নিয়ে ফেরা। ওই রাতের মতো অনেক রাতই হয়ত অনেকের আসে, যখন অল্প আয়ের মানুষগুলো ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও ঘরে ফিরতে পারে না। -ওয়াজেদ হীরা বৃহস্পতিবারে ‘শনির দশা’! সেই শৈশবে একটি কবিতা পড়েছিলাম। কালীপ্রসন্ন ঘোষের লেখা। সেখানে একটি লাইন ছিল ‘একবার না পারিলে দেখ শতবার .. ।’ অথচ আমি কিনা শতবার নয়, মাত্র দ্বিতীয়বারের চেষ্টাতেই ডিআরইউর (ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি) টেবিল টেনিস প্রতিযোগিতায় অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয়ে গেলাম! এ যে সত্যিই অবিশ্বাস্য! কেননা আমার লক্ষ্যই ছিল কমপক্ষে তৃতীয় স্থান অধিকার করার! কেননা ২০১৪ সালের ডিআরইউর টিটি প্রতিযোগিতায় প্রথমবার অংশ নিয়েই তৃতীয় হয়েছিলাম। সেই আসরে ছিলেন অনেক বাঘা বাঘা খেলোয়াড়। তারপরও কিভাবে যেন ‘চামে চিকনে’ থার্ড হয়ে গিয়েছিলাম! ২০১৫ সালে টিটি প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়নি। অথচ এবার (২০১৬) যখন হলো তখন আর তৃতীয় নয়, এমনকি দ্বিতীয়ও নয়, প্রতিযোগী সব সাংবাদিকের মধ্যে হয়ে গেলাম একেবারে সেরা, মানে প্রথম স্থানের অধিকারী! এতটা যে কল্পনাও করিনি। এতটা আত্মবিশ্বাসও ছিল না শিরোপা জয়ের ব্যাপারে। তাহলে কিভাবে সম্ভব হলো এই অসাধ্য সাধন শুনুন সেই গল্প ... আগেই বলেছি এই প্রতিযোগিতায় যে চূড়ান্ত সাফল্যটা ধরা দেবে আমারই হাতের মুঠোয় সেটা একদমই ভাবিনি। এমনকি ছিল না বিন্দুমাত্র আত্মবিশ্বাসও। কেন, তার কারণ অবশ্যই আছে। কেননা আমার চেয়ে অনেক ভাল ও যোগ্য টিটি খেলোয়াড় ছিলেন এবারের প্রতিযোগিতায়। এদের অনেকেই আবার ২০১৪ আসরে অংশ নেননি (এবার অংশ নেন ১২ জন। যদিও নাম এন্ট্রি করেছিলেন ৩৬ জন, আর খেলার দিন হাজির ছিলেন ১৬ জন, শেষ পর্যন্ত চারজন নাম প্রত্যাহার করে নেন)। ফলে নতুন অথচ অভিজ্ঞ এই খেলোয়াড়দের চেহারা-সুরত দেখে তো আমার আত্মারাম খাঁচা ছাড়ার জোগাড়! দিনটা ছিল ৬ অক্টোবর, বৃহস্পতিবার, ২০১৬। টিটিতে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর মনে হয়েছে এই দিনটায় আসলেই আমার বৃহস্পতি ছিল তুঙ্গে! অথচ দিনের শুরুটা এমন বাজেভাবে শুরু হয়েছিল যে, একে বলা যেতে পারে ‘বৃহস্পতিবারে শনির দশা!’ পল্টনের শহীদ তাজউদ্দীন আহমেদ ইনডোর স্টেডিয়ামে (উডেন ফ্লোর জিমনেশিয়াম) খেলা হবে। রিপোর্টিং টাইম সকাল সাড়ে ১০টায়। যাবার সময় আবার না বিরক্তিকর যানজটে পড়তে হয়, সেজন্য সকাল ৮টার মধ্যেই ঘুম থেকে উঠে পারিবারিক কাজকর্ম সব ঝটপট সারলাম। তারপর দ্রুত নাস্তা সারতে বসলাম। কিন্তু টেনশনের চোটে উদরে মোটে একটা সাদা রুটির বেশি প্রবেশ করাতে পারলাম না। বাসা থেকে বেরুলাম সাড়ে ৯টায়। হেঁটে মুগদাপাড়া বিশ্বরোডে গিয়ে উঠলাম। ওখানে মুগদা আইডিয়াল স্কুল এ্যান্ড কলেজ অবস্থিত। সেখান থেকে ‘বাহন’ বা ‘মিডওয়ে’ বাস না পেয়ে প্ল্যান করলাম মতিঝিলগামী একটি ম্যাক্সিতে উঠব। উঠলামও। আর সেখান থেকেই ঝামেলার ‘শুভ সূচনা!’ যাব কমলাপুর স্টেডিয়াম-কমলাপুর রেলস্টেশন-আরামবাগ হয়ে। কিন্তু মুগদা আইডিয়াল স্কুলের ছেলে-মেয়েরা ব্যানার-প্ল্যাকার্ড নিয়ে সেদিকের রাস্তা অবরোধ করে ফেলল চোখের পলকে, কিছু বুঝে উঠার আগেই। তাদের দাবি- ৭টি সৃজনশীল পদ্ধতি বাতিল করতে হবে। তারা এমনভাবে রাস্তায় নেমেছে এবং সব যানবাহন আটকে রেখেছে, মনে হচ্ছে কমপক্ষে আধ ঘণ্টার আগে তারা সরবে না। হাতে সময় নেই। উপায় না দেখে আমাদের ম্যাক্সির যাত্রীদের অনুরোধে (আসলে বলা উচিত হুমকি) চালক ভিন্ন রুট দিয়ে যেতে বাধ্য হলো। ভিন্ন রুট বলতে খিলগাঁও ফ্লাইওভার-শাজাহানপুর-ফকিরেরপুল-দৈনিক বাংলা ...। খিলগাঁও ফ্লাইওভারের অর্ধেকটা যেতে না যেতেই আবারও থমকে দাঁড়াতে হলো আমাদের ম্যাক্সিটাকে। এবার ফ্লাইওভারের ওপরেই লেগে গেছে ‘রাম গিট্টু’ মানে ভয়াবহ জ্যাম। চালক জানালো সামনে আরেকটি আইডিয়াল স্কুলের স্টুডেন্টরা একই আন্দোলন করছে। ফলে ফ্লাইওভারের নিচ থেকে জ্যাম লেগে সেটা ওপরেও এসে পৌঁছেছে। কি সর্বনাশ! তাহলে টিটি খেলার স্থানে যাব কি করে? মহাচিন্তায় পড়ে গেলাম। মিনিট দশেক অপেক্ষা করে দেখলাম জ্যাম ছোটে কিনা। না, কোনই সুলক্ষণ নেই! যা আছে কপালে, মরিয়া হয়ে ম্যাক্সি ভাড়ার পুরোটাই গচ্চা দিয়ে শুরু করলাম ‘হন্টন প্রক্রিয়া।’ প্রথমেই পার হলাম ‘পুলসিরাত’, মানে উড়াল সেতু। তারপর হেঁটে হেঁটে উডেন ফ্লোর জিমনেশিয়ামের সামনে। ঘড়িতে তখন ১০টা ২০ বাজে। যাক, সময়মতোই পৌঁছানো গেছে। কিন্তু সেটা করতে গিয়ে জান কাবার হওয়ার দশা! এত দ্রুত হাঁটতে হয়েছে যে, কি বলব। এত তাড়াতাড়ি জীবনে আর হাঁটিনি। খেলব আর কি, সব শক্তি তো হেঁটেই খতম! এরপর কি হলো তা বলব আরেকদিন। -রুমেল খান [email protected]
×