ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

অরুণ কুমার বিশ্বাস

রম্যকথন ॥ ব্যাংক নাকি ব্যাঙের ছাতা!

প্রকাশিত: ০৫:৩৫, ২৭ ডিসেম্বর ২০১৭

রম্যকথন ॥ ব্যাংক নাকি ব্যাঙের ছাতা!

একটা কথা এখন প্রায়শ শোনা যায় ব্যাংকে যেমন তারল্য সঙ্কট, আমজনতার মনেও তেমনি সারল্য সঙ্কট। কেউ আর কাউকে চট করে বিশ্বাস করতে চায় না। আর এ কথা কে না জানে, ব্যাংক মানেই মানুষের বিশ্বাস নিয়ে বিজনেস। নইলে সামান্য এক টুকরো ছাপানো কাগজের ওপর নির্ভর করে মানুষ কোটি কোটি টাকা ব্যাংকের মামুলি একজন ক্যাশিয়ারের হাতে তুলে দিত না। শুধু কষ্টের সঞ্চয় তুলে দিয়েই যে হাত ধুয়ে ফেলছে এমন নয়, বরং সেই টাকা অন্যের হাতে গচ্ছিত রাখার বিনিময়ে মাসে মাসে একটা ফিও দিতে হচ্ছে তাকে। উপরি হিসাবে আরও আছে আবগারি ট্যাক্স। ‘টাকায় টাকা আনে’র বদলে এখানে টাকা আরও টাকা নিয়ে নেয়! হালে দেখা যায়, বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো জনতার সেই আমানত নিয়ে যথেচ্ছ ছিনিমিনি খেলছে। আপনি চাইলে ছি-কুতকুতও বলতে পারেন। ছোটবেলায় আমরা দুষ্টু পোলাপান ক্লাস ফাঁকি দিয়ে যেমন ছি কুতকুত খেলতাম, আমাদের ব্যাংকগুলোও সেরকম গ্রাহকের আমানত নিয়ে স্রেফ খেলাধুলা করছে। পবিত্র আমানতের করছে খেয়ানত! সবাই করছে তা বলছি না, তবে অনেকেই করছে। অবশ্য এমনটি যে ঘটবে, যার ঘটে একরত্তি বুদ্ধি আছে, তার পক্ষে আরও আগেই তা অনুমান করা উচিত ছিল। ভরা বর্ষা মৌসুমে দেখবেন প্রচুর ব্যাঙের ছাতার আবির্ভাব ঘটে। যত্রতত্র সারমেয়র মূত্রপাত থেকে এবম্বিধ ব্যাঙের ছাতার উদ্ভব ঘটে বলে গাঁয়ের দিকে একটা বিশ্বাস প্রচলিত আছে। বঙ্গদেশে ব্যক্তিমালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংকের সংখ্যার যেমন শেষ নেই, তেমনি তাদের ছলচাতুরিরও অবধি নেই। এরা বড়ই মহান তাই পাবলিকের সমুদয় টাকাকড়ি নিজের মনে করে খরচ করে, খোলামকুচির মতো নয়-ছয় করে ক্রমশ পুরো আমানত ‘গাপ’ করে দেয়। এমন দিল-দরিয়া কারবার আপনি আর কোথায় পাবেন! ইদানিং দেশব্যাপী ব্যাঙের ছাতার ব্যাপক চাষ হচ্ছে। পিজ্জা-পাস্তায় ব্যাঙের ছাতা খাওয়া হচ্ছে। ব্যাংকঅলারাই বা তাহলে থেমে থাকবে কেন! তফাৎটা হলো এই, ব্যাঙের ছাতা চাষ করলে মুনাফা হয়। তাতে পাবলিকের আমানত মারা পড়ে না। অথচ আমাদের ব্যাংক মালিকরা যেনতেন প্রকারেণ সরকার বাহাদুরের কাছ থেকে একখানা ছাড়পত্র বাগিয়ে অমনি নেমে পড়েন মুনাফার ধান্ধায়। এই সেক্টরে এখন যা চলছে, তাকে লুটপাট বললে বোধ করি খুব একটা অত্যুক্তি হয় না। শুরুতে ছিল এ্যাগ্রেসিভ মার্কেটিং, আর এখন হচ্ছে এ্যাগ্রেসিভ লুটপাট। ব্যাংকের বোর্ড অব ডিরেকটর্স থেকে শুরু করে এমডি-কেদারাদার (মানে চেয়ারম্যান) সবাই মিলে যে যেভাবে পারছেন, সমানে পাবলিকের আমানতকে আপন করে নিচ্ছেন। আমনতকারীদের যার যতটুকু আছে সবটুকুই যেন তাদের গিলে খেতে হবে। বলতে নেই, আমাদের সুখেনবাবু ব্যাংকওয়ালাদের এই পেয়ার-মহব্বতের পাল্লায় পড়ে সাত-সকালে সরষে ফুল দেখছেন। চোখের সামনে কেমন যেন হলুদাভ ছবি নাচতে শুরু করেছে। এরপর তিনি নাশতার বদলে খাবি খাবেন, আর তারপর জীবনের সঞ্চয়টুকু খুইয়ে বিছানা নেবেন চিরতরে। কী করে হলো এসব! সেও এক কাহিনী বটে। গুহ্যকথা পুরোটা তো সাত তাড়াতাড়ি খোলাসা হয়। না, জনতার নজরেও আসে না। মিডিয়াভাইদের প্রচেষ্টায় উঠে আসে কিছু গোপন কেচ্ছা। তারপর সেই খবর পড়ে সুখেনদের হার্টের ব্যামো শুরু হয়। এই বলে কেবল মাথা চাপড়ায়- গেল গেল, গেল রে, টাকাটুকা যা ছিল সব ওরা লুটেপুটে খেলরে! সামনে মেয়ের বিয়ে সুখেন তাই কুড়ি হাজার টাকার একখানা চেক লিখে নিজেই গেলেন ব্যাংকে। টাকা চাই তার, জলদি। নইলে একমাত্র মেয়ের বিয়ে আটকে যাচ্ছে। ক্যাশ-কাউন্টারের সামনে লাইন দিলেন। বেশ দীর্ঘ লাইন। কারণ কানাঘুষায় আমানতকারীগণ শুনেছেন, ব্যাংকের কারবার নাকি লাটে ওঠার যোগাড়। যার যা আছে চটজলদি তুলে নাও, নইলে চোখে সরষে ফুল দেখবে। কিন্তু ব্যাংকের সামনে দীর্ঘ লাইন কী করে যেন অকসাৎ ফাঁকা হয়ে গেল মালুম হয় না সুখেনের। এনিথিং রঙ! সুখেন কান পাতলেন। দু-চারজনকে এই বলে খেদিয়ে দেয়া হচ্ছে, ব্যাংকে প্রবল তারল্য সঙ্কট, পরে আসুন। সেই পরেটা কবে শুনি! আসুন আস্তে-ধীরে, সামনের হপ্তায়। তবে আসার আগে খোঁজ নিয়ে আসবেন। টাকা এলে পাবেন, নইলে নাই। লাস্যময়ী নারীটি শিফনশাড়ি সামলে কথাগুলো বলল আনাড়ির মতো। কথা শুনে সুখেনের মাথায় বাজ পড়ল। যারা দু-চার হাজার চাচ্ছে, তারা টাকা পাচ্ছে। অংকটা দশের ওপরে হলেই তার হয় মরণদশা। কথায় বলে, যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই রাত্রি হয়! সুখেনের কপালেও তাই হলো। তাকে জানালো হলো, কুড়ি হাজার নয়, অংকটা পাঁচ করে আনুন। অত টাকা ব্যাংকে নেই। নেই কেন, অ্যাঁ? আমার টাকা আমি নেব কার বাপের কী! খ্যাঁক করে উঠলেন কন্যাদায়গ্রস্ত পিতা। চ্যাতেন কেন স্যার। থামুন, একটু শান্ত হয়ে বসুন। গলায় লাল রং লেঙুড় ঝোলানো এক মাকুন্দ তাকে বলল। টাকা মামুলি জিনিস নয়, ফাঁকাবুলিও নয়। টাকা ব্যাংকে রেখেছেন বেশ করেছেন। ভবিষ্যতে আরও রাখবেন। কিন্তু ব্যাংকওয়ালাদেরও তো কিছু খাই-খরচা আছে, নাকি! একবার টাকা ঢুকে গেলে কর্তৃপক্ষের মর্জিমতোন ওটা তুলতে হয়। যতই টাকার গায়ে লেখা থাক, চাহিবামাত্র ইহার বাহককে...! এই বাহক কে জানেন তো! ব্যাংকের অসীম ক্ষমতাধর কেদারাদার ও বোর্ড অব ডিরেকটর্র্স। তারা না চাইলে টাকার গায়ে যতই লেখাপড়া থাক, তাতে কোন কাজ হবে না। টাকা আপনি পাবেন না। এবার যান, অংকটা কেটে পাঁচ করে আনুন। নইলে ফুটুন! বিষণ্ন মনে বাসায় ফিরলেন সুখেনবাবু। নিমিষে তার সুখটুকু উধাও হলো। মেয়ের বিয়ে কী করে দেবেন, সেই প্রশ্নের আগে তার মনে যে খটকা লাগলো তা হলো, ব্যাংকওয়ালারা পাবলিকের টাকা নিয়ে করেটা কী! মেরে দেয়, নাকি পাচার করে! শুনতে খারাপ শোনালেও বাস্তবতা বুঝি তাই! নইলে দেশীয় ব্যাংকগুলোতে তারল্য সঙ্কট কেন হবে! বহুজাতিক ও বড় ব্যাংকগুলোতে তো এমন হয় না। বিলেতে পড়তে গিয়ে দেখেছি, বার্কলিজ বা হ্যালিফ্যাক্স ব্যাংকের কোন আমানতকারীর চেক ফেরত দেয়া দূরে থাক, মোটা টাকা লোন দিতে না পারলে তারা নাক-কান মলে, পারলে ক্লায়েন্টের পা ধরে ক্ষমা চায়। যেন মস্ত এক অপরাধ করে ফেলেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের তত্ত্বাবধানকারী প্রতিষ্ঠান। তাদের ভাষ্য, তারা নাকি নিছক নখ-দন্তহীন ব্যাঘ্র। এসব ক্ষেত্রে বিবি-র তেমন কিছুই করার নেই। বিবি স্রেফ একখানা পত্র ঠুকে বা শোকজ নোটিস ইস্যু করে বসে থাকে। পাবলিকের মূল্যবান আমানত খেয়ানতকারী এসব ব্যাংককে শাস্তি দেয়ার কোন এখতিয়ার বা মেকানিজম তার নেই। মনের দুঃখে সুখেন ভাবেন, এবার থেকে তিনি আর ব্যাংকে টাকা রাখবেন না। বরং ব্যাঙের ছাতার চাষাবাস শুরু করবেন। তাহলে আর কারও তারল্য সঙ্কটের ধার তাকে ধারতে হবে না। চাষবাস করে যদি কিছু জমে, তাহলে তিনি মাটির ব্যাংকে জমাবেন, নয়তো গিন্নিকে সোনার গহনা বানিয়ে দেবেন। তাতে স্ত্রীর চেহারা খোলতাই হবে, মন ভাল থাকবে, আবার জোচ্চোরের হাতে পড়ে তার সাধের আমানত খেয়ানতও হবে না। যাকে বিশ^াস করা যায় না, তাকে আর যাই হোক ধনসম্পত্তির হিস্যাদার করা যায় না। অবশ্য আরেকটা আশঙ্কার কথাও মনে আসে সুখেনের। দেশের মানুষের এত এত টাকা, সব তো আর মাটির ব্যাংকে ধরবে না। বা ব্যাঙের ছাতার চাষাবাদে বিনিয়োগ করেও কুলবে না। পাবলিক তাহলে এত টাকা রাখবে কই! কাঁথা-বালিশের তলায় লুকোনোর দিন তো শেষ। দেশের সব টাকা কি তবে পাচার হয়ে বাইরে চলে যাবে! পানামা-প্যারাডাইজ পেপার্স কেলেঙ্কারিতে আমরা নিয়মিত শিরোনাম হব! মানুষ আমাদের নাম জানবে বিশ্বদরবারে বাংলাদেশ মিনি-মাগনায় পরিচিতি পাবে, বেশ তো। কে না জানে, নো ব্র্যান্ডিং ইজ ব্যাড ব্র্যান্ডিং। পরিচিতি সে একভাবে পেলেই হলো। আমরা না হয় ব্যাঙের ছাতার মতো খেয়ানতকারী ব্যাংক বানিয়ে পেলুম আর কি! লেখক : কথাসাহিত্যিক
×