ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

অর্থনীতির বৃত্ত ভাঙ্গার গল্প

প্রকাশিত: ০৫:৩২, ২৭ ডিসেম্বর ২০১৭

অর্থনীতির বৃত্ত ভাঙ্গার গল্প

(গতকালের পর) মূল্যস্ফীতি ॥ অর্থনীতির মূল নির্দেশক হচ্ছে মূল্যস্ফীতি। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরকার বরাবরই সতর্ক কৌশল বজায় রেখেছে। ফলে মূল্যস্ফীতির হার ধারাবাহিকভাবে কমছে। ২০১১-১২ অর্থবছর শেষে গড় বার্ষিক মূল্যস্ফীতি ছিল ১০.৬২, সেখানে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে সার্বিক গড় মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৫ দশমিক ৪৪ শতাংশ। তার আগের অর্থবছর তা ছিল ৫ দশমিক ৯২ শতাংশ। ২০১৬-১৭ অর্থবছরের বাজেটে গড় মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৮ শতাংশের মধ্যে রাখার লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছিল। অর্থবছর শেষে দেখা যাচ্ছে, সেই চেষ্টায় সফল হয়েছে সরকার। বিশেষ করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে বেড়ে ওঠা লাগামহীন মূল্যস্ফীতিকে মহাজোট সরকার শুধু নিয়ন্ত্রণে আনতেই সক্ষম হয়নি। দেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতির ধারা নিম্নমুখী করার সফলতা অর্জন করেছে। চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেটেও গড় মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৫ শতাংশের নিচে রাখার লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে। তবে এ বছরের পাহাড়ী ঢল ও বন্যায় মাঠের বোরো ফসল নষ্ট হয়ে চালের মূল্যে যে উল্লম্ফন ঘটেছে, তাতে মূল্যস্ফীতির এ লক্ষ্য অর্জন কঠিন হয়ে পড়বে। চালের দাম এখন ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি। বেশিরভাগ সবজি বিক্রি হচ্ছে কেজিপ্রতি ৬০ টাকার বেশি দরে। কয়েক বছরে গরুর মাংসের দাম দ্বিগুণ হয়ে গেছে। ভোজ্যতেলের দাম ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। পেঁয়াজের দামও এখন গগনচুম্বী। সময়ে সময়ে রসুন, আদা, চিনি ইত্যাদির দামও বেড়ে ভোক্তাদের বাজার খরচ বাড়িয়ে দিচ্ছে। এমনকি লবণও ৪০ টাকা কেজিতে কিনে খেতে হচ্ছে দেশবাসীকে। ব্যয় বাড়তে থাকায় একদিকে ব্যয়বহুল নগরী হয়ে উঠছে ঢাকা, অন্যদিকে ব্যয় বৃদ্ধির চাপে গ্রামীণ জীবনও কঠিন হয়ে উঠছে। বাজেট ॥ ২০০৮-০৯ সালেও আমাদের বাজেট ছিল এক লাখ কোটি টাকার নিচে (৯৯ হাজার ৯৬২ কোটি টাকা)। আট বছরে সেই বাজেট চার গুণ বেড়ে চার লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। জাতীয় বাজেটে এই বরাদ্দ বৃদ্ধির কারণে রাজস্ব আয় যেমন বেড়েছে, তেমনি বেড়েছে উন্নয়ন অর্থায়ন। মাত্র আট বছরে দ্বিগুণেরও বেশি রাজস্ব সংগ্রহের কারণেই আমরা এখন নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের সাহস দেখাতে পারছি। মেট্রোরেল, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্রের মতো মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নে আর সঙ্কোচ করতে হচ্ছে না। তবে দেশের এই সীমিত সম্পদ ব্যবহারের ক্ষেত্রে আমাদের আরও দক্ষতার পরিচয় দিতে হবে। উন্নয়ন প্রকল্পের গুণগত মান নিয়ে এখনও প্রশ্ন আছে। সেই প্রশ্নের উর্ধে উঠে উন্নয়ন প্রকল্পে অর্থ ব্যবহারের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। উপচে পড়া ঝুড়ি ॥ স্বাধীনতার পর সাবেক মার্কিন কূটনীতিক হেনরি কিসিঞ্জার বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি আখ্যা দিয়েছিলেন। সেই বাংলাদেশ এখন প্রাচুর্যে, সম্পদে উপচেপড়া ঝুড়ি। মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মজেনাই তার দেশের সাবেক পররাষ্ট্র মন্ত্রীর অপবাদ নাকচ করে দিয়ে বলেছেন, ‘বাংলাদেশী মানুষ পরিশ্রমী, কর্মঠ, সৃষ্টিশীল ও উদ্যমী। তারা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানুষ। বাংলাদেশ এখন আর তলাবিহীন ঝুড়ি নয়, বরং সম্পদ ও প্রাচুর্যে উপচেপড়া ঝুড়ি।’ স্বাধীনতাপূর্ব ও পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের জনসংখ্যা ছিল অনেক কম। তখন এ দেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের প্রায় ৬০ শতাংশ খাদ্য উৎপাদিত হতো এখানে। বাকিটা আমদানি করতে হতো বিদেশ থেকে। বর্তমানে দেশে ১৬ কোটি মানুষের সম্পূর্ণ খাদ্য চাহিদা মেটানো হচ্ছে দেশের উৎপাদন থেকেই। এর মাধ্যমে সুস্পষ্ট হয়ে যায়, বাংলাদেশে কৃষি খাতে কতটা ব্যাপক উন্নতি সাধিত হয়েছে। এটা কোন জাদুর বলে সংঘটিত হয়নি। এই অভাবনীয় উত্তরণের পেছনে যেমন রয়েছে সরকারের সঠিক পরিকল্পনা, তেমনি আছে এ দেশের কৃষকদের বিপুল শ্রম। শাক-সবজি, ফলমূল ও খাদ্যশস্য উৎপাদনে বাংলাদেশের কৃষি ব্যবস্থায় রীতিমতো নবজাগরণ ঘটেছে। কৃষকদের অদম্য উৎসাহ আর দক্ষতার কারণে কৃষি উৎপাদনে অনেক অসাধ্য সাধন সম্ভব হয়েছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের কৃষকের শ্রম ও প্রযুক্তি ব্যবহারের সক্ষমতার কথা বলতেই হয়। গত দুই দশকের মধ্যে এখন দেশের বেশিরভাগ জমিতে দুই ফসল; এমনকি তিন ফসলের আবাদ চলছে। আবার দুই ফসলের মধ্যবর্তী সময়ে চাষ হচ্ছে শাক-সবজি। ফলে কৃষি খাতে নীরবে অগ্রগতির বিপ্লব চলছে। জলবায়ুর পরিবর্তন আর প্রকৃতির খামখেয়ালিকে জয় করে গত আট বছরে দেশে খাদ্য উৎপাদন বেড়েছে ৩০ ভাগ। সঠিক কৃষি ব্যবস্থাপনার ফলে উত্তরবঙ্গের ভয়াল মঙ্গা এখন কেবলই ইতিহাস। কৃষির এই উন্নয়নের কারণে কৃষকের খুব ছোট ছোট পুঁজি গঠন হচ্ছে। সরকারের উচিত হবে গ্রামীণ এই ক্ষুদ্র পুঁজি গঠনের প্রক্রিয়াকে সচল রাখা, যাতে এক সময় মাঝারি আকারের পুঁজির মালিক হতে পারে তারা। এই পুঁজি কাজে লাগিয়ে কৃষক যেন তার অর্থনৈতিক কর্মকা- চালিয়ে যেতে পারে। বিদ্যুতে অবিশ্বাস্য অগ্রগতি ॥ অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য জ্বালানির কোন বিকল্প নেই। জন্মলগ্ন থেকেই সরকারগুলো বাংলাদেশকে সম্ভাবনাময় দেশ হিসেবে উল্লেখ করে এলেও, জ্বালানি খাত সব সময়ই ছিল অবহেলিত। ফলে শিল্পায়নের জন্য বেসরকারী খাত জ্বালানির খড়ায় ভুগেছে। বিদ্যুতের যে অসহনীয় অবস্থা ছিল, তাতে দৈনিক ৮-১০ ঘণ্টা পর্যন্ত লোডিশেডিং মোকাবেলা করতে হয়েছে দেশবাসীকে। তবে বিদ্যুত গতিতেই সেই পরিস্থিতি পাল্টে যাচ্ছে। স্বাধীনতার ৩৮ বছরে যেখানে বিদ্যুত উৎপাদন ক্ষমতা ছিল ৪ হাজার ৯শ’ মেগাওয়াট, সেখান থেকে মাত্র ৮ বছরে বিদ্যুত উৎপাদন ক্ষমতা তিন গুণেরও বেশি বৃদ্ধি পেয়ে ১৬ হাজর মেগাওয়াট ছাড়িয়েছে। এ এক বিশাল অর্জন। শিল্প উদ্যোক্তাদের এখন আর বিদ্যুতের জন্য হাহুতাশ করতে হয় না। ঢাকাবাসী সম্ভবত লোডশেডিং ভুলতেই বসেছে। বিনিয়োগ নিয়ে শঙ্কা ॥ অর্থনীতির এই অগ্রগতির মাঝে মন খারাপের খবর হলো বিনিয়োগ। উন্নয়ন সম্ভাবনা উঁকিঝুঁকি মারলেও বেরকারী বিনিয়োগে ভাল খবর নেই। সরকারী বিনিয়োগ বাড়লেও বেসরকারী বিনিয়োগ গত ১০ বছর ধরেই স্থিতিশীল হয়ে আছে। উন্নয়ন অর্থায়ন বৃদ্ধির কারণে সরকারী বিনিয়োগ জিডিপির ৩০ শতাংশ ছাড়িয়ে গেলেও, বেসরকারী বিনিয়োগ ২২-২৩ শতাংশের মধ্যেই ঘুরপাক খাচ্ছে। সরকারী বিনিয়োগ অবকাঠমো সুবিধা তৈরি করে দেয়। যাতে বেসরকারী খাত বিনিয়োগে এগিয়ে আসে এবং বিনিয়োগের মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে। যা আয় বৃদ্ধির মাধ্যমে মানুষের জীবনযাত্রার মান বাড়িয়ে দেয়। কিন্তু সরকারী বিনিয়োগ বৃদ্ধির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে না বেসরকারী বিনিয়োগ। বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য এটাই শঙ্কার বিষয়। তবে সরকার বেসরকারী বিনিয়োগ বৃদ্ধির জন্য ১০০টি অর্থনৈতিক জোন করার উদ্যোগ নিয়েছে। এসব জোন তৈরির কাজ দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলছে। অনেক বিদেশী উদ্যোক্তা এসব অর্থনৈতিক জোনে বিনিয়োগ করার জন্য এগিয়ে আসছে। যা দেশের অর্থনীতিতে নতুন আশার সঞ্চার করছে। স্বপ্ন দেখাচ্ছে প্রযুক্তি খাত ॥ সবশেষে তথ্যপ্রযুক্তি খাতের কথা বলতে চাই। বাংলাদেশ এখন এগিয়ে যাচ্ছে তথ্যপ্রযুক্তির ওপর ভর করে। একটা সময় ভাবা হতো, তথ্যপ্রযুক্তি শুধু সংযোগের কাজেই ব্যবহৃত হবে। সেই প্রযুক্তি এখন উপার্জনের মাধ্যম হিসেবে সুযোগ তৈরি করে দিচ্ছে। স্বপ্ন দেখাচ্ছে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার। নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ থেকে আমরা এখন মধ্যম আয়ের দেশে যাচ্ছি। স্বপ্ন দেখছি, উন্নত দেশের। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু মাত্র সাড়ে তিন বছরে বাংলাদেশকে এক স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে পুনর্গঠিত করেন, যা ছিল বিশ্বে নজিরবিহীন। অনেক বাধাবিঘ্ন কাটিয়ে, বিশ্ব দরবারে আজ একটি আধুনিক গণতান্ত্রিক দেশের মডেল হিসেবেই বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটেছে। বাংলাদেশ এখন অনেক দেশের জন্যই অনুকরণীয় মডেল। এটাই বাংলাদেশের বৃত্ত ভাঙ্গার গল্প। (সমাপ্ত) লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক
×