ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ফরম না পেয়ে ফিরে যাচ্ছেন ক্রেতারা

পরিবার সঞ্চয়পত্রের কৃত্রিম সঙ্কট

প্রকাশিত: ০৫:১০, ২৭ ডিসেম্বর ২০১৭

পরিবার সঞ্চয়পত্রের কৃত্রিম সঙ্কট

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ পরিবার সঞ্চয়পত্রের ফরম না পেয়ে বিকল্প কৌশলে ফরম সংগ্রহ কিংবা ফেরত যেতে হচ্ছে অনেক গ্রাহকদের। বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, জাতীয় সঞ্চয় অধিদফতর চাহিদানুযায়ী ফরম সরবরাহ করতে না পারায় এই ঘাটতি তৈরি হয়েছে। আর সঞ্চয় অধিদফতরের দাবি, পরিবার সঞ্চয়পত্র ফরমের কোন ঘাটতি নেই। চাওয়া মাত্রই তারা এ ফরম সরবরাহ করে থাকে। এদিকে দেশের তফসিলী ব্যাংকগুলোর বিরুদ্ধেও সঞ্চয়পত্র বিক্রিতে অনীহার অভিযোগ পাওয়া গেছে। এক্ষেত্রে তারাও আবেদন ফরম না থাকার অজুহাত দাঁড় করাচ্ছেন। গত রবিবার কয়েকজন ভুক্তভোগীর কাছে এমন অভিযোগ করেন। এরপর গ্রাহক সেজে সোনালীসহ কয়েকটি ব্যাংকের শাখায় গিয়ে ভুক্তভোগীদের এমন অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়। জানা গেছে, বর্তমানে যে কোন উৎসের চেয়ে সঞ্চয়পত্র খাতে সুদ তথা মুনাফার হার বেশি। আর সঞ্চয়পত্রের বিভিন্ন প্রকারের মধ্যে পরিবার সঞ্চয়পত্রের চাহিদা বেশি। পাশাপাশি তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্র, ৫ বছর মেয়াদী বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্র ও পেনশনার সঞ্চয়পত্রের প্রায় সমান চাহিদা রয়েছে। এই চার ধরনের সঞ্চয়পত্রের জন্য প্রতিদিনই মানুষ বাণিজ্যিক ব্যাংক, জাতীয় সঞ্চয় অধিদফতরের অধিনস্থ সকল সঞ্চয় ব্যুরো ও পোস্ট অফিসে বেশি ভিড় করছেন। কিন্তু বাণিজ্যিক ব্যাংকের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা সঞ্চয়পত্র কিনতে চাইলে আবেদন ফরম না থাকার অজুহাতে সাধারণ মানুষকে ফিরিয়ে দিচ্ছেন। সূত্র বলছে, বরাবরই সঞ্চয়পত্র বিক্রির কার্যক্রমকে ঝামেলা মনে করে আসছে ব্যাংকগুলো। কেননা এ কাজে কমিশন খুবই কম, খরচ অনেক বেশি। এ কারণে বেসরকারী বেশিরভাগ ব্যাংকই সঞ্চয়পত্র বিক্রি করতে চায় না। এদিকে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো সঞ্চয়পত্র কেনা নিরুৎসাহিত করায় বাংলাদেশ ব্যাংকের মতিঝিল অফিসে সঞ্চয়পত্র প্রত্যাশীদের ভিড় বাড়ছে। এছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে সঞ্চয়পত্র কিনলে এর মুনাফা অনলাইনে ব্যাংক একাউন্টের মাধ্যমে উত্তোলনের সুবিধা মেলায়ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকে বেশি ভিড় করে মানুষ। এতে বাড়তি চাহিদা মেটাতে হিমশিম খাচ্ছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা। অন্যদিকে বাণিজ্যিক ব্যাংক, জাতীয় সঞ্চয়পত্রের ব্যুরো ও ডাকঘর থেকে সঞ্চয়পত্র কিনলে বর্তমানে এ সেবা পাওয়া যাচ্ছে না। কয়েকটি বেসরকারী ব্যাংকের শাখায় পরিবার সঞ্চয়পত্র কিনতে না পেরে মঙ্গলবার বাংলাদেশ ব্যাংকের মতিঝিল অফিসে আসেন গৃহিণী আবিদা হোসেন। তিনি জনকণ্ঠকে জানান, সঞ্চয়পত্র কিনতে চাইলে ব্যাংকগুলো তাকে ফরম না থাকার কথা জানিয়েছেন। তাই তিনি বাধ্য হয়েই বাংলাদেশ ব্যাংকে এসেছেন। কিন্তু এখানেও ফরম নেই বলে তাকে জানানো হয়েছে। এ বিষয়ে একটি বেসরকারী ব্যাংকের কর্মকর্তা বলেন, যদি ফরম না-ই থাকে তবে সার্কুলার করে জানিয়ে দেয়া হয় না কেন? শুধু মানুষজন এসে হয়রানির শিকার হচ্ছেন। তিনি বলেন, আমিও একজন ব্যাংকার। আমি সচেতন হওয়ায় হয়ত পরিচিতদের মাধ্যমে একটি ফরম জোগার করে নিতে পারব কিন্তু অন্যরা কি করবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের মতিঝিল অফিসে পরিবার সঞ্চয়পত্রের ফরম শেষ হয়ে যাওয়ার কথা স্বীকারও করেন এ অফিসের সাধারণ সঞ্চয়পত্র শাখার যুগ্ম ব্যবস্থাপক মোঃ ইসলামইল হোসেন পাটওয়ারী। তিনি বলেন, বরাবরই পরিবার সঞ্চয়পত্রের চাহিদা বেশি থাকে। জাতীয় সঞ্চয় অধিদফতর থেকে সরবরাহ না থাকায় আমরা আপাতত এর ফরম দিতে পারছি না। তাছাড়া অধিদফতর যদি চাহিদানুয়ায়ী সরবরাহ না করে তবে আমরা দেব কোথা থেকে। কারণ আমরা তো আর সঞ্চয়পত্রের ফরম ছাপি না। তিনি বলেন, সর্বশেষ আমরা অধিদফতরের কাছে ৩০ হাজার ফরম চেয়েছিলাম। কিন্তু আমাদের দেয়া হয় মাত্র ৩ হাজার। এই তিন হাজার আমরা বাংলাদেশ ব্যাংকের সব শাখার পাশাপাশি তফসিলী ব্যাংকগুলোতেও সরবরাহ করেছি। এখন শেষ হয়ে যাওয়ায় আবার অধিদফতরের কাছে চাহিদা পাঠিয়েছে। তিনি আরও বলেন, ডিজিটাল বাংলাদেশে এখন অনেক সেবাই সহজে পাওয়া যায়। এখন ওয়েসবাইট থেকেই সঞ্চয়পত্রের ফরম সংগ্রহ করা যায়। এদিকে ব্যাংকে বিপুল পরিমাণ অলস অর্থ পড়ে থাকায় ধারাবাহিক আমানতের সুদ কমছে। বর্তমানে ব্যাংক আমানতের গড় সুদহার ৫ শতাংশের নিচে নেমেছে; সেখানে সঞ্চয়পত্রের সুদহার মিলছে এর দ্বিগুণেরও বেশি। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, চলতি বছরের অক্টোবর শেষে ব্যাংকিং খাতে গড় আমানতে সুদের হার দাঁড়িয়েছে ৪ দশমিক ৮৯ শতাংশ। অন্যদিকে বর্তমানে বিভিন্ন সঞ্চয় প্রকল্পের সুদ মিলছে ১১ থেকে ১২ শতাংশের মধ্যে। এর মধ্যে পরিবার সঞ্চয়পত্রের সুদ ১১ দশমিক ৫২ শতাংশ, তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্রের সুদহার ১১ দশমিক ০৪ শতাংশ, পাঁচ বছর মেয়াদী বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্রের সুদ ১১ দশমিক ২৮ শতাংশ ও পেনশনার সঞ্চয়পত্রের সুদ ১১ দশমিক ৭৬ শতাংশ। মূলত ব্যাংকের চেয়ে দ্বিগুণ সুদহার হওয়ায় গত কয়েক অর্থবছরে অস্বাভাবিক গতিতে সঞ্চয়পত্র বিক্রি বেড়েছে। চলতি অর্থবছরেও একই চিত্র পরিলক্ষিত হচ্ছে। জাতীয় সঞ্চয় অধিদফতরের তথ্যে দেখা গেছে, চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেটে সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩০ হাজার ১৫০ কোটি টাকা। এর বিপরীতে অর্থবছরের প্রথম ৪ মাসেই (জুলাই-অক্টোবর) সঞ্চয়পত্র নিট বিক্রি হয়েছে ১৭ হাজার ৩১৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ চার মাসেই লক্ষ্যমাত্রার অর্ধেকের বেশি সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। এ সময়ে পরিবার সঞ্চয়পত্রই বেশি বিক্রি হয়েছে। চার মাসে এখান থেকে নিট বিনিয়োগ এসেছে ৬ হাজার ৩১৬ কোটি টাকা। আর তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্র থেকে বিনিয়োগ এসেছে ৪ হাজার ৫৪৩ কোটি টাকা। গত অর্থবছরে পুরো সময়ে ৫২ হাজার ৩২৭ কোটি টাকার নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। যা এ যাবতকালের সর্বোচ্চ। গত অর্থবছরেও সর্বোচ্চ ২০ হাজার ৯৭৬ কোটি টাকার নিট বিনিয়োগ আসে পরিবার সঞ্চয়পত্র বিক্রি থেকে।
×