ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

চাহিদার চেয়ে বেশি উৎপাদন ক্ষমতা

প্রকাশিত: ০৬:২২, ২৬ ডিসেম্বর ২০১৭

চাহিদার চেয়ে বেশি উৎপাদন ক্ষমতা

অপূর্ব কুমার ॥ চাহিদার অভাবে পুরো উৎপাদন ক্ষমতা ব্যবহার করতে না পারায় আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশের অধিকাংশ সিমেন্ট কারখানা। পাশাপাশি বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি, চট্টগ্রাম বন্দরের দীর্ঘসূত্রতার কারণে ক্লিংকারসহ কাঁচামালের আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়া, ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নসহ নানা কারণে সিমেন্ট খাতে মুনাফার হার সর্বনিম্ন পর্যায়ে চলে এসেছে। এ অবস্থায় দেশে নতুন সিমেন্টের মূল্য বৃদ্ধির পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। উদ্যোক্তারা জানান, সম্ভাবনাময় খাত হিসেবে দেশের সিমেন্ট খাতে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ নিয়ে এগিয়ে এসেছেন দেশী-বিদেশী বিনিয়োগকারীরা। সরকারী হিসাবে দেশে সিমেন্ট কারখানার সংখ্যা ১২৩টি। এর মধ্যে মাত্র ৩৩টিতে বর্তমানে উৎপাদন চালু রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক উৎপাদন ক্ষমতা প্রায় ৪ কোটি মেট্রিক টন। কিন্তু দেশীয় চাহিদার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বর্তমানে দেশে ২ কোটি ৪০ লাখ মেট্রিক টন সিমেন্ট উৎপাদিত হচ্ছে- যা উৎপাদন ক্ষমতার ৬০ শতাংশ। বাকি প্রায় ৪০ শতাংশ উৎপাদন ক্ষমতা ব্যবহার করতে পারছে না কারখানাগুলো। সংশ্লিষ্টরা জানান, বৈশ্বিক পর্যায়ে প্রযুক্তির উন্নয়নের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সিমেন্ট কারখানায় নিয়মিতভাবে নতুন বিনিয়োগ করতে হয়। তবে দেশে কাক্সিক্ষত মাত্রায় চাহিদা না বাড়ায় অধিকাংশ কারখানাই নতুন বিনিয়োগ সক্ষমতা থাকে না। ফলে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে যায়। অন্যদিকে ক্ষমতার তুলনায় অনেক কম উৎপাদনে বাধ্য হওয়ায় সিমেন্টের উৎপাদনে পরিচালনা ব্যয় বেড়ে যায়। ফলে প্রত্যাশা অনুযায়ী মুনাফা করতে পারছেন না উদ্যোক্তারা। এতে উৎপাদিত সিমেন্টের মান বজায় রাখতে গিয়ে মূল্য বাড়াতে বাধ্য হচ্ছেন উৎপাদকরা। এ বিষয়ে সিয়াম সিটি সিমেন্ট বাংলাদেশ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পি এন আইয়ার বলেন, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি ও চট্টগ্রাম বন্দরে দীর্ঘজটের কারণে গত কয়েক বছরে ক্লিংকারসহ কাঁচামাল আমদানিতে ব্যয় বেড়েছে। তার ওপর এ বছরের শুরুতে ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেল (ডব্লিউটিসি) চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙ্গর থেকে বাল্ক পণ্যের পরিবহণ ব্যয় ১৫ শতাংশ বৃদ্ধি করেছে। গত কয়েক মাসে ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমে যাওয়ায় সিমেন্ট উৎপাদনে মুনাফার হার কমে গেছে। এর মধ্যে আবার বিদ্যুতের মূল্য বাড়ানো হয়েছে। এর ফলে যেসব কোম্পানির নিজস্ব ক্যাপটিভ পাওয়ার প্ল্যান্ট নেই, তাদের ব্যয় বেড়েছে। নানাভাবে খরচ বাড়লেও উৎপাদন ক্ষমতার চেয়ে চাহিদা কম থাকায় সিমেন্টের দাম অনেকটা নি¤œমুখী। সব মিলিয়ে সিমেন্ট উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো বর্তমানে সর্বনি¤œ মুনাফায় ব্যবসা করতে হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে শেষ পর্যন্ত বাজারে সিমেন্টের দাম উল্লেখযোগ্য হারে বাড়বে বলেই মনে হচ্ছে।’ জানা গেছে, সিমেন্ট শিল্পে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জিত হলেও এ শিল্পের কাঁচামাল ক্লিংকারের বড় অংশই আমদানি করতে হয়। পাশাপাশি স্থানীয় কাঁচামাল থেকেও সিমেন্ট উৎপাদন হয়। সেন্টমার্টিন দ্বীপ, জয়পুরহাট ও সিলেটের খনি থেকে আহরিত চুনাপাথর সিমেন্ট শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়। মূলত ছাতক ও আয়েনপুর সিমেন্ট ফ্যাক্টরি স্থানীয় চুনাপাথর এবং জ্বালানি হিসেবে গ্যাস ব্যবহার করে সিমেন্ট উৎপাদন করে। এ দুটি কারখানার উৎপাদন ক্ষমতা প্রায় ৩০ লাখ মেট্রিক টন। অন্যান্য সিমেন্ট কারখানায় চীন, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ফিলিপিন্স, ইন্দোনেশিয়া ও ভারত থেকে ক্লিংকার আমদানি করে উৎপাদন করে। ফলে ডলারের দামের উঠানামা এ খাতের উৎপাদন খরচে বড় ধরনের প্রভাব ফেলে। গত কয়েক মাসে ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় সিমেন্ট উৎপাদন খরচ বেড়েছে। এর সঙ্গে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির ফলে মুনাফার ক্ষেত্রে বড় ধরনের ধাক্কা খেয়েছে সিমেন্ট কোম্পানিগুলো। এ অবস্থায় নতুন করে দাম বাড়িয়ে পরিস্থিতি সামাল দেয়ার চিন্তা করছে তারা। বাংলাদেশ সিমেন্ট ম্যানুফেকচারার্স এ্যাসোসিয়েশনের নেতারা জানান, নানা কারণে সম্প্রতি মুনাফার পরিমাণ নগণ্য পর্যায়ে চলে এসেছে। কোন কোন প্রতিষ্ঠান লোকসান দিয়ে ব্যবসা করতে বাধ্য হচ্ছে। এ অবস্থায় মূল্য সমন্বয় ছাড়া অন্য কোন রাস্তা নেই। নাম প্রকাশ না করার শর্তে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত এক সিমেন্ট কোম্পানির উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, দেশে উৎপাদনের তুলনায় সিমেন্টের সরবরাহ অর্ধেকে নেমে এসেছে। ফলে সম্ভাবনাময় এই খাতটির কোম্পানিগুলোকে লোকসান গুণতে হচ্ছে। এছাড়া অবকাঠামোগত জটিলতার কারণে আগের তুলনায় পণ্য পরিবহনও ব্যয়ও বেড়েছে। ফলে পণ্যের পেছনে খরচ বাড়ছে। কিন্তু সেই তুলনায় বিক্রি নেই। যার কারণে এক প্রকার লোকসানেই পড়তে হচ্ছে কোম্পানিগুলোকে। তিনি বলেন, এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে সার্বিক অর্থনীতিতে। সব শ্রেণীর ভোক্তার ওপর চাপ বাড়ছে। ঢাকার শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত দেশীয় কোম্পানিগুলোর ৩০ জুন ২০১৭ সালের আর্থিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বেশিরভাগ কোম্পানিগুলোর মুনাফা কমেছে। আরামিট সিমেন্টের গত অর্থবছরে শেয়ারপ্রতি লোকসান দাঁড়িয়েছে ২.৯৭ টাকা। আগের অর্থবছরে একই সময়ে যা ছিল ০.৮৪ টাকা। মেঘনা সিমেন্টের গত অর্থবছরে শেয়ারপ্রতি আয় দাঁড়িয়েছে ২.৯১ টাকা, যা আগে একই সময়ে ছিল ৩.০৮ টাকা। গত অর্থবছরে কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি সমন্বিত মুনাফা ছিল ৫.১৭ টাকা। যা আগের বছরে একই সময়ে ছিল ৬.৪৮ টাকা। একইভাবে এম আই সিমেন্টের শেয়ারপ্রতি আয় দাঁড়ায় ৪.৪৫ টাকা। যা আগের বছরে একই সময়ে ছিল ৫.০১ টাকা। একইভাবে দেশের বাজারে তালিকাভুক্ত বড় মূলধনী কোম্পানি লাফার্জ সুরমার মুনাফায় ভাটা পড়েছে। সর্বশেষ কোম্পানিটির তৃতীয় প্রান্তিক অনুসারে কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি আয় দাঁড়ায় ০.১৮ টাকা, যা আগে একই সময়ে ছিল ০.৩২ টাকা। একইসঙ্গে আরও একটি বহুজাতিক কোম্পানি হাইডেলবার্গ সিমেন্টের সর্বশেষ প্রান্তিকের শেয়ারপ্রতি মুনাফা দাঁড়িয়েছে ১.৭২ টাকা। যা আগে ছিল ৪.৪৭ টাকা। অর্থাৎ বাজারে তালিকাভুক্ত সবকটি কোম্পানিরই মুনাফায় বড় ধরনের ধস ছিল। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে কোম্পানির দরে। কোম্পানিগুলোর শেয়ারধারীরাও লোকসানে রয়েছে।
×