ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

অথচ ৯৬ ভাগ বাসে বাড়তি ভাড়া আদায় করা হয়

রাজধানীতে মানসম্পন্ন বাস মাত্র ২৫ ভাগ, লক্কড়-ঝক্কড়ই বেশি

প্রকাশিত: ০৬:২০, ২৬ ডিসেম্বর ২০১৭

রাজধানীতে মানসম্পন্ন বাস মাত্র ২৫ ভাগ, লক্কড়-ঝক্কড়ই বেশি

রাজন ভট্টাচার্য ॥ রাজধানীতে চলাচলরত বাসের মধ্যে মানসম্পন্ন মাত্র ২৫ ভাগ! বেশিরভাগ বাসই লক্কড় ঝক্কড়। এসব বাসের কোনটিই সিটিং সার্ভিস হিসেবে চলার উপযোগী নয়। অথচ প্রায় ৬০ ভাগের বেশি বাস এখন সিটিং সার্ভিস হিসেবে চলছে। এরমধ্যে ৯৬ শতাংশ বাস বাড়তি ভাড়া আদায় করে নৈরাজ্য সৃষ্টি করছে। অথচ এ ব্যাপারে পরিবহন মালিক সমিতি, বিআরটিএ থেকে শুরু করে পুলিশ নীরব ভূমিকা পালন করছে। যাত্রী অধিকার সংরক্ষণে কাজ করা যাত্রী কল্যাণ সমিতির এক গবেষণা প্রতিবেদনে এমন চিত্র উঠে এসেছে। পরিবহন মালিক সমিতি নেতৃবৃন্দ বাড়তি ভাড়া আদায়ের কথা স্বীকার করে বলছেন, বাড়তি ভাড়া আদায় বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া জরুরী। যারা বাড়তি ভাড়া নিচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে মালিক সমিতির পক্ষ থেকে ব্যবস্থা নেয়ার কথা জানান তারা। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ বিআরটিএ বলছে, বাড়তি ভাড়া আদায়সহ পরিবহন সেক্টরে সকল নৈরাজ্য রোধে নিয়মিত মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হচ্ছে। প্রয়োজনে মোবাইল কোর্ট আরও বাড়ানো হবে। যাত্রী কল্যাণ সমিতির গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, ঢাকা মহানগরীর যাত্রীরা বাস-মিনিবাসে সিটিং সার্ভিসের নৈরাজ্যের শিকার হচ্ছে। ভাড়া নৈরাজ্য ও পিকআওয়ারে দরজা বন্ধ করে বাস চলাচলে মাঝপথের যাত্রীদের নিয়মিত রোদবৃষ্টি পোহাতে হয়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাস্তায় দাঁড়িয়ে থেকে তারা গাড়ি পান না। একই দূরত্বে একেক বাসে একেক হারে ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। আবার গাড়ির গায়ে সিটিং সার্ভিস লিখে সরকার নিধার্রিত ভাড়ার দ্বিগুণ, তিনগুণ কোন কোন ক্ষেত্রে ৫ গুণ পর্যন্ত বাড়তি ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। পাশাপাশি বাদুড়ঝোলা করে যাত্রীও বহন করা হচ্ছে। একদিকে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের নৈরাজ্য, অন্যদিকে অতিরিক্ত যাত্রী বহন, তথা এসব সিটিং গাড়িতে দাঁড়িয়ে যাত্রী বহনে যাত্রী, চালক ও পরিবহন শ্রমিকদের সঙ্গে প্রায়ই বচসা, হাতাহাতির ঘটনাও ঘটছে। যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, ঢাকা মহানগরীর যাত্রী সাধারণের দীর্ঘদিনের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি গণপরিবহনে ভাড়া নৈরাজ্য পর্যবেক্ষণ উপ-কমিটির ৫ সদস্যের একটি টিম গত তিন মাসব্যাপী নগরীতে চলাচলরত ১ হাজার ৩০ বাস-মিনিবাসের ওপর জরিপ করে। যাত্রী সেবা, গাড়ির অবস্থা, ভাড়া, পারিপার্শি¦ক অবস্থাসহ সার্বিক বিষয় জরিপে উঠে আসে। পাশাপাশি চালক, হেলপার, যাত্রী, মালিক সমিতি, শ্রমিক সংগঠন, ট্রাফিক পুলিশের কর্মকর্তা-কর্মচারী, বিআরটিএর কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সরকার কর্তৃক বাস ও মিনিবাসে ভাড়া নির্ধারণ করা আছে। ঢাকা মহানগরীতে বাস ভাড়া (ব-সিরিজ) প্রতি কিমিঃ ১.৭০ টাকা ও মিনিবাস ভাড়া (জ-সিরিজ) প্রতি কিমিঃ ১.৬০ টাকা। সর্বনিম্ন ভাড়া ৩ কিমিঃ পর্যন্ত বড় বাসে ৭ টাকা, মিনিবাসে ৫ টাকা। অথচ নগরীতে চলাচলরত ৯৬ শতাংশ বাস-মিনিবাস অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের নৈরাজ্যের সঙ্গে জড়িত। তারা সরকার নির্ধারিত ভাড়া বা সর্বনিম্ন ভাড়া কিছুই মানে না। নামমাত্র কিছু বাসে সরকার নির্ধারিত ভাড়ার তালিকা থাকলেও তা অনুসরণ করা হচ্ছে না। বিভিন্ন বাস কোম্পানি কর্তৃক তাদের পরিবহনের জন্য কোম্পানি কর্তৃক প্রণীত ভিন্ন ভিন্ন ভাড়ার চার্ট অনুসরণ করে ভাড়া আদায় করা হয়। অথবা বাসে ওঠার সময় হেলপারের ইচ্ছানুযায়ী ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। এ কারণে সরকারের ভাড়া নির্ধারণের আইনগত যোগ্যতা এখানে চরমভাবে প্রশ্নের সম্মুখীন বলে দাবি করেন তিনি। এ ব্যাপারে বিআরটিএর সাবেক চেয়ারম্যান আইয়ুবুর রহমান বলেন, বিআরটিএর আইনে সিটিং সার্ভিস বলতে কিছু নেই। মালিকরা অতিরিক্ত মুনাফার লোভে এসব বিষয় আবিষ্কার করেছে। ভাড়া নির্ধারণে যাত্রীস্বার্থ প্রধান্য দিতে হবে। গণপরিবহন বিশেষজ্ঞ ড. সালেহ উদ্দীন আহমেদ বলেন, আমাদের জিডিবির ৩৭ শতাংশ ঢাকা থেকে উৎপাদিত হয়। অথচ ঢাকা যানবাহনের গতি দিনদিন কমছে এই কারণে জাতীয় উন্নয়ন ব্যহত হবে। তাই গণপরিবহনকে প্রাধান্যদিতে হবে। সিটিং সার্ভিস ও লোকাল সার্ভিস উভয়ের নৈরাজ্য ও হয়রানি বন্ধ না হলে ব্যক্তিগত গাড়ি বাড়তে থাকবে। সরকার নির্ধারিত ভাড়ায়, নির্ধারিত স্টপেজ অনুযায়ী সিটিং সার্ভিস বাস চালানোর সুপারিশ তুলে ধরে প্রতিবেদনে বলা হয়, ভাড়ার অঙ্ক ও দূরত্ব উল্লেখ করে টিকেট দিয়ে টাকা আদায় নিশ্চিত করতে হবে। সুস্পষ্ট ভাড়ার তালিকা বাসে ও বাস কাউন্টারে প্রদর্শনের ব্যবস্থা থাকতে হবে। সিটিং সার্ভিসে মালিকদের মর্জিমতো ভাড়া আদায় ও স্টপেজ নির্ধারণ করা যাবে না। মাঝপথের যে কোন স্টপেজে নামলে শেষ গন্তব্য পর্যন্ত ভাড়া আদায় করা যাবে না। কয়টি স্টপেজ থাকবে যা সরকার-মালিক-শ্রমিক-যাত্রী প্রতিনিধির সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে ঠিক করতে হবে। মালিকরা চালকদের কাছে দৈনিক চুক্তিতে বাস ইজারা দিতে পারবেন না। এছাড়া প্রতিটি সিটিং সার্ভিসের বাসের আসন থাকবে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, বাহ্যিক দিক থেকে দেখতে দৃষ্টিনন্দন। দরজা-জানালার কাঁচ ঠিক থাকবে। এসব বাসে প্রয়োজনীয়সংখ্যক ফ্যানের ব্যবস্থা থাকবে। জানালার পর্দা ও সিট কভারের ব্যবস্থা থাকতে হবে। সময়ে সময়ে এগুলো পরিষ্কার করতে হবে। প্রতিটি সিটিং সার্ভিস বাসে নিবন্ধনে অনুমোদিত আসনের অতিরিক্ত আসন থাকতে পারবে না। সিটিং সার্ভিসে নারী, শিশু, প্রতিবন্ধী যাত্রী ও অসুস্থ যাত্রীদের ওঠানামায় অগ্রাধিকার দিতে হবে। তাদের জন্য নির্দিষ্টসংখ্যক আসন সংরক্ষণ করতে হবে। ঢাকা শহরের মোট বাসের ২৫ শতাংশ সিটিং সার্ভিস হিসেবে চলাচল করতে পারে। এসব বাস হবে মানসম্মত। সিটিং সার্ভিসের অনুমোদন নেই এমনবাস সিটিং হিসেবে চালালে আটক করার বিধান করতে হবে। আইন অমান্যকারী পরিবহন মালিকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে, সিটিং সার্ভিসের বাসের আলাদা কালার থাকতে হবে, সিটিং সার্ভিসের বাসে নির্ধারিত স্টপেজের বাইরে রাস্তার মাঝ পথ থেকে যাত্রী নিতে পারবে না। দাঁড়িয়ে যাত্রী নেয়া নিষিদ্ধ করতে হবে। এসব বিষয়ে জানতে চাইলে, বিআরটিএ সচিব শওকত আলী জনকণ্ঠকে বলেন, পরিবহন সেক্টরে নৈরাজ্য আছে এটা সত্য। আমরা চেষ্টা করছি সকল প্রকার নৈরাজ্য রোধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে। এজন্য আমাদের নিয়মিত মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হচ্ছে। এখন রাতেও মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হয়। কেউ যাত্রীদের ঠকিয়ে ব্যবসা করতে পারবে না। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্লাহ বলেন, বাড়তি ভাড়া আদায়ের অভিযোগ পুরোপুরি সত্য। আমরা চাই বাড়তি ভাড়া আদায় বন্ধ হোক।
×