ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

এম রাশেদ জামান শোভন

স্মরণ ॥ অধ্যাপক মোহাম্মদ ইউনুস

প্রকাশিত: ০৩:৫৩, ২৬ ডিসেম্বর ২০১৭

স্মরণ ॥ অধ্যাপক মোহাম্মদ ইউনুস

২০০৪ সালের ২৪ ডিসেম্বর সাত সকালে অধ্যাপক ইউনুসকে রাজশাহীর বিনোদপুরে যখন ঘাতকরা হত্যা করে তখন তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৪ বছর। সুস্থই ছিলেন। পরের বছর রিটায়ার্ড করতেন। তবে আমরা বিনোদপুরে নিজেদের বাসায় যাওয়ার পর থেকে স্থানীয় আওয়ামী লীগের সঙ্গে তার কাজকর্ম বেড়ে যায়। অনেক সময় দলীয় কাজ বাসাতেও করতে দেখেছি। আব্বাকে সবাই বলতেন, আপনি বিনোদপুরে বাসা করলেন কেন? ওটা তো শিবিরের ঘাঁটি। আব্বাও হাসতে হাসতে বলতেন, ওদের মধ্যেই তো থাকতে হবে। ওরা কি করবে? মারবে? সে তো অনেকদিন থেকেই চেষ্টা করছে। আব্বাকে মেরে ফেলার পর খুব কম শিক্ষকই আমাদের বিনোদপুরের বাসায় এসেছেন। আর কিছু না, ভয়ে। এই জিনিসটা আমার বাবার মধ্যে একদম ছিল না। কোনদিন দেখিনি। যারা প্রফেসর ইউনুস হত্যায় অংশ নিয়েছিল তারা বাংলা ভাইয়ের অনুসারী বলে পরিচিত ছিল। অর্থাৎ জামায়াতে ইসলাম প্রফেসর ইউনুসকে হত্যার জন্য বাংলা ভাইয়ের লোকদের কাজে লাগায়। হত্যাকারীরা বলেছিল, শয়খ আবদুর রহমান তাদের নির্দেশ দিয়েছিল। যারা রাবিতে শিক্ষকতা করেন বা কর্মকর্তা-কর্মচারী সকলেই বলতে পারবেন প্রফেসর ইউনুস কি ধরনের বা কি আদর্শের মানুষ ছিলেন। বঙ্গবন্ধু পরিষদের সভাপতি ছিলেন। আজন্ম আওয়ামী লীগের কাজ করেছেন। এ জন্য কোনদিন কোন সুবিধা নিতে দেখিনি তাকে। জোর গলায় বলব, কেউ বলতেও পারবেন না কোন অসৎ বা অনৈতিক কোন কাজ তার দ্বারা হয়েছে। প্রফেসর ইউনুস খুব সংগ্রাম করে উঠে এসেছেন। রংপুর জেলা স্কুল। সেখান থেকে রাজশাহী কলেজ। আব্বার কলেজমেট ছিলেন স্বনামধন্য পরমাণু বিজ্ঞানী ওয়াজেদ মিয়া। স্কুল থেকে শুরু করে সব কিছুই নিজেকে উপার্জন করে চলতে হয়েছে তাকে। অর্থনীতি থেকে পাস করার পর তৎকালীন পিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ইনকাম ট্যাক্সে যোগদান করেন। অল্প কিছুদিন চাকরির পর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আব্বার শিক্ষক ডেকে পাঠান। কোন দিকে না তাকিয়ে রাবিতে যোগদান করেন অর্থনীতি বিভাগে। সেটা ১৯৬২ সালের ঘটনা। টাকা-পয়সার প্রতি কোন মোহ দেখিনি কোনদিন। জীবনের শেষ প্রান্তে সব সঞ্চয় দিয়ে একটি বাড়ি করেছিলেন রাজশাহীর বিনোদপুরে। একদিন কথাচ্ছলে বলছিলেন, ইনকামট্যাক্সের চাকরি করলে সচিব হয়ে রিটায়ার্ড করতেন। আমরা, আমি ও আমার ছোট বোন সারা, কোনদিন প্রাচুর্য্যরে মধ্যে মানুষ হইনি। খুব ছোট থেকেই বাবা আমাদের সবকিছু পরিষ্কার করে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। এইচএসসি পাস করার পর আব্বা ইন্ডিয়াতে নিয়ে গিয়েছিলেন রবীন্দ্র ভারতীতে ভর্তি করার জন্য। সঙ্গে ছিলেন কথা সাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক চাচা। ভর্তির সবকিছু নিশ্চিত করেও পড়া হয়নি রবীন্দ্র ভারতীতে। কিছুদিন পর পর ভারতে গিয়ে তবলার তালিম নিয়ে আসতাম প-িত আনন্দ গোপাল ব্যানার্জির কাছ থেকে। ১৯৯৫-এর ৩০ নবেম্বর শিবির আব্বার ওপর হামলা করে। এরপর থেকে আর মন বসত না কোন কিছুতে। সব সময় একটা আতঙ্ক তাড়া করে বেড়াত। ’৯৬-এ হামলার পর আব্বা যখন সন্ধ্যার সময় ক্লাবে যেতেন তখন পিছু পিছু যেতাম। ক্লাবের বাইরের পুকুরের ঘাটে বসে থাকতাম। আবার ফেরার সময় পিছু পিছু আসতাম। দেখলে রাগ করবেন বলে জানাতাম না। উনি আমাকে পরিষ্কার করে বলেছিলেন, এরা ক্ষমতার লোভে সব কিছু করতে পারে। আমাকেও যে কোন সময় আঘাত করতে পারে। ’৯৫-এর হামলার পর জামায়াতের বেশ কিছু শিক্ষক বাসায় আসেন। আব্বাকে বোঝাতে চেষ্টা করেন, উনি যেন কোনভাবেই শিবিরের বিরুদ্ধে মামলা না করেন। আমার খুব স্পষ্ট মনে আছে, যে সব শিক্ষক এসেছিলেন তারা প্রাণপণ চেষ্টা করেন যেন আব্বা কেসটা না করেন। আব্বা খুব ঠা-া মাথায় বলেছিলেন, যা সত্য ঠিক তাই আমি করব। মিথ্যার ওপর কোন দিন চলিনি। এসব ঘটনাই আব্বার হত্যাকা-ের সূচনা তৈরি করে। আব্বার হত্যাকা- অত্যন্ত পরিকল্পিত একটি হত্যাকা-। জামায়াতে ইসলাম অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবেই তাকে হত্যা করে। মোট চারজন শিক্ষককে হত্যা করা হয় রাবিতে। আব্বার পর তাহের স্যার। একদম খোলা বইয়ের মতো একটা ঘটনা। তৎকালীন সভাপতি সালেহী এই মামলার প্রধান আসামি। তিনি এখন বেকসুর খালাস। তার সহযোগী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মহিউদ্দিন জেলে আছেন। ঐ সময়ের দৃশ্য ভোলার না। ছাত্রশিবির সাহেব বাজারে জনসভা করে সালেহীকে উপস্থিত করে বলেছিল, এই যে এখানে আছে সালেহী, দেখি কি করে প্রশাসন তাকে ধরে নিয়ে যায়? কেউ ধরতে পারেনি। এরপর মিলন স্যার এবং তারপর ইংরেজীর শিক্ষক রেজাউল স্যার। কি চমৎকার ধারাবাহিকতা! ২০০৪ এ না হয় বিএনপি জামায়াত ক্ষমতায় ছিল তাহের স্যারের সময়ও তারা ছিল। তার পরের সময় তো আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়। এরপরও কিভাবে এ হত্যাগুলো হয়! আসলে রাজশাহীর প্রেক্ষাপট সম্পর্কে কারও ধারণাই নেই। এ শহরে জামায়াত কি পরিমাণ ক্ষমতাধর তা বোঝা যাবে যখন আওয়ামী লীগ চলে যাবে। পুরো শহরকে মুঠোয় নিতে বড়জোর একদিন লাগবে জামায়াতের। গত সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে লিটন সাহেব হেরে গেলেন। রাজশাহীতেই ছিলাম। কেন্দ্রীয় কমিটির ছাত্রলীগের কিছু নেতা কাজ করছিলেন রাজশাহীতে। নির্বাচনের আগের দিন বিনোদপুরের আওয়ামী লীগের কিছু কেন্দ্রে আমার পরিচিত বন্ধু-বান্ধব ছিল। তখন পর্যন্ত কোন টাকা পৌঁছায়নি সে সব কেন্দ্রে। আগের দিনই বিভিন্ন জায়গা থেকে খবর পেতে শুরু করলাম, কোনভাবেই লিটন ভাই জিতবেন না। রাজশাহীর মতো জায়গায় আওয়ামী লীগের অবস্থান কেমন? একাত্তরের পর থেকে এ অঞ্চলগুলোতে আওয়ামী লীগের পরিচর্যা ছিল না। ক্ষমতায় এসেও ঐ একই অবস্থা চলছিল। রাজশাহী শহরকে সুন্দর করে সাজিয়েও তাই কোন লাভ হয়নি। বুলবুল সাহেবই মেয়র হলেন। কম বেশি সবাই জানেন এসব। ধারাবাহিক শিক্ষক হত্যাগুলোর বিচারের অবস্থাও বেহাল। প্রফেসর ইউনু হত্যাকা-ে অভিযুক্তদের হাইকোর্টের রায়ে ফাঁসির দ- কমিয়ে যাবজ্জীবন করা হয়েছে। অথচ ১৬৪ ধারায় জবানবন্দী ছিল আসামিদের। কিছুদিন আগে সজল স্যার (রাবির গত উপ-উপাচার্য) রিং দিয়ে জিজ্ঞাসা করছিলেন কেসটার অবস্থা কি? তাকে এ্যাটর্নি জেনারেল ফোন দিয়েছিলেন জানার জন্য। এর কারণ হলো, আমরা আপত্তি জানিয়েছিলাম। এই সজল স্যারÑ আব্বাদের ছাত্রসম ছিলেন। কি বিশাল বদনাম নিয়ে বিদায় নিলেন। তারা রাজনীতি করেন সুবিধা পাওয়ার জন্য। বঙ্গবন্ধুর কোন আদর্শ তারা ধারণ করেন না। আমার বাবা কমপক্ষে কয়েকশ লোকের চাকরি দিয়েছিলেন রাবিতে। একজন শুধু বলুক সে বিষয়ে কোন লেনদেন ছিল। আর বর্তমানে এই চাকরির জন্য টাকা নেয়া একটা প্রথা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আওয়ামী লীগের নজর দেয়া উচিত রাজশাহীর প্রতি। যতœ নেওয়া উচিত দলের। তা না হলে একসময় বড় মূল্য দিতে হবে। আমার আম্মা একবার নেত্রীর সঙ্গে দেখা করেছিলেন। নেত্রী বলেছিলেন, আপনার এ্যাকাউন্ট নম্বরটা দিয়েন। নেত্রীর পার্সোনাল নম্বরও দিয়েছিলেন। আম্মা বলেছিলেন, আমরা কষ্টেসৃষ্টে চলে যাব। আপনি বিচারটা একটু দেখবেন। আমরা কিছু চাই না। শুধু প্রফেসর ইউনুস হত্যার সুষ্ঠু বিচার চাই। বড় ভাল মানুষ ছিলেন আমাদের বাবা। লেখক : সহকারী পরিচালক, ছাত্র নির্দেশনা ও পরামর্শদান দফতর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
×