ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

নাজনীন বেগম

প্রাথমিক শিক্ষায় ভর্তি ॥ শিশুর মনস্তত্ত্ব

প্রকাশিত: ০৩:৫৩, ২৬ ডিসেম্বর ২০১৭

প্রাথমিক শিক্ষায় ভর্তি ॥ শিশুর মনস্তত্ত্ব

প্রতিবারের মতো এ বছরেও শুরু হয়ে গেছে কোমলমতি প্রাণচঞ্চল শিশুদের বিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার এক অবর্ণনীয় দুর্ভোগ। যা কোনভাবেই দুর্ভোগের মতো অবস্থা তৈরি হওয়ার কথা ছিল না। নতুন বছরে নব উদ্দীপনায় প্রথম শিক্ষা জীবন শুরু হওয়ার সুবর্ণ সময়টুকু উদ্বেগ আর অতৃপ্ত অস্থিরতার মধ্যে কাটাতে হয়। প্রথমেই থাকে ভর্তি হওয়ার জন্য হরেক রকম কোচিংয়ের অপকৌশল। তার ওপর মানসিক অস্বস্তি তো আছেই। ভাল কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে জায়গা করতে পারবে কিনা কিংবা কোচিংয়ে আহরিত সমস্ত বিদ্যা উপড়ে দিয়ে খাতা পরীক্ষকম-লীর সুনজরে আসবে কিনা এসব বিভ্রান্ত চিন্তায় বাচ্চাদের কি পরিমাণ মানসিক নির্যাতনের শিকার হতে হয় তা ভাবাও যায় না। তার ওপর আছে অভিভাবকদের সীমাহীন পীড়ন। তারাও কোচিং আর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তাল মিলিয়ে অসহায় শিশুদের যে ধরনের প্রতিযোগিতায় নামান তা আদৌ শিক্ষা ব্যবস্থার সুস্থ ধারা কি না সেটা ভাববার অবকাশও তাদের থাকে না। তারা বেমালুম ভুলে যান নিজেদের শিক্ষাজীবনের কথা। কিংবা সত্যিকারের অভিভাবকের দায়িত্ব এবং সচেতনতার গুরুত্বপূর্ণ সূচকগুলো। শিশু-কিশোররা অল্প বয়স থেকেই জ্ঞানচর্চার এই সীমাহীন পাহাড় টপকাতে গিয়ে পরিবার থেকে আরম্ভ করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমনকি সত্যিকারের শিক্ষা ব্যবস্থা থেকেও ক্রমাগত বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। তাদের মেধা এবং মননে পর্যাপ্ত মানসিক চাপ তৈরি করা হয় সবার থেকে বেশি নম্বর পাওয়ার জন্য প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়ার তাড়নায়। অবুঝ আর অবোধ শিশুরা সেই লক্ষ্যেই প্রতিনিয়তই হন্য হয়ে ছুটে বেড়াচ্ছে। নিজস্ব নিয়মে পড়ার সময়টুকুও থাকে না এসব কোমলমতি শিশুর। অভিভাবকদের অস্থিরতার শিকার হয়ে নিজেরা যে তাদের নিয়ে কিছু ভাবতে পারে সে বোধটুকুও আজ তারা হারাতে বসেছে। নিজের জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণ করার মতো ক্ষমতা অল্প-বিস্তর সব শিশুর মধ্যেই সুপ্ত থাকে। প্রয়োজন তাকে সস্নেহ আর সযতœ স্পর্শে জাগিয়ে তোলা। তার পরও বলা যায় শুধুমাত্র ব্যক্তিক সিদ্ধান্তই কোন মানুষকে চালিত করে না। বরং পারিপার্শ্বিক সামাজিক প্রতিবেশও যে কাউকে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার সুষ্ঠু এবং সুস্থ পথনির্দেশনাও দেয়। সেই স্বাভাবিক, সুস্থ আর বিকাশমান শিক্ষার পরিবেশ কি আগের মতোই আছে যেখানে একটি শিশু বোধ-বুদ্ধি হওয়ার পর থেকেই ভাবতে পারত তার নিজের কথা, জীবনের আশা-আকাক্সক্ষার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অনুভবের স্বপ্নগুলো। যে ব্যবস্থায় শিক্ষার সূচনকাল থেকে কোচিংয়ের ওপর নির্ভর করে কোন শিশুকে প্রতিযোগিতার পাহাড় অতিক্রম করতে হয় সেখানে ভবিষ্যত প্রজন্মের অসহায়ত্ব সত্যিই জাতির জন্য অশনি সঙ্কেত। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় বাবা-মা দু’জনই উচ্চ শিক্ষিতই শুধু নন হয়তবা কোন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা কলেজের শিক্ষকও বটে। তাদের ছেলেমেয়েদেরও যদি শুরু থেকেই কোচিং সেন্টারে দৌড়াতে হয় তাহলে অন্যদের অবস্থা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা সহজেই অনুমেয়। দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের একজন গণিতের শিক্ষকের সন্তান যদি তার পরিবার থেকে অঙ্কের ভিত্তি তৈরি করতে না পারে এর চেয়ে দুঃখজনক তো আর কিছু হতে পারে না। বিংশ শতাব্দীর ক্রান্তিলগ্নেও শিক্ষার পরিবেশ ছিল অনেকটাই পারিবারিক আবহে নিজের মতো করে নিজেকে তৈরি করা। আর বিদ্যালয়ের অভিজ্ঞ এবং জ্ঞানী শিক্ষক সেই ভিতকে আরও মজবুত করার ক্ষেত্রে যে যুগান্তকারী অবদান রেখেছেন তারই পরিণতিতে দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের ভবিষ্যত নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছেছে। সে সময় পরিবারে যিনি অঙ্ক এবং ইংরেজী ভাল জানতেন শিশুরা প্রাথমিক স্তরে তাদের কাছ থেকেই অনেক কিছু শিখে নিত। তখন শিক্ষার স্বচ্ছন্দ আবহ ছিল কিন্তু কোন রকম মানসিক নির্যাতন ছিল না। অভিভাবকের দায়িত্ব ছিল শুধুমাত্র নির্দিষ্ট সময়ে সন্তান পড়ার টেবিলে বসেছে কি না এটুকু দেখা। পরিবার থেকে এটাও বিশেষ নজরে রাখা হতো সন্তান কোনভাবেই যাতে অন্যদিকে মন দিতে না পারে। স্বল্প শিক্ষিত মায়েরা সে কাজটুকু অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে করতে পারতেন বলে নিজের লক্ষ্যে স্থির থেকে সে সময়ের প্রজন্ম মেধা ও মননের বিকাশ ঘটিয়ে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হতে পেরেছেন। সেখানে স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানিত শিক্ষকদের অবদানও গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় আনা অত্যন্ত জরুরী। শিক্ষক মানেই জ্ঞানের আধার, পরম পূজনীয় এ শিক্ষা যেমন পরিবার থেকে দেয়া হতো একইভাবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও আবহ ছিল এমন যার কারণে ছাত্রছাত্রীরা এর বাইরে কিছু চিন্তাও করতে পারত না। কোচিং শব্দটি ছিল একেবারে অজানা, অচেনা একটি প্রত্যয়। অনেক সময় অঙ্ক এবং ইংরেজীতে দুর্বল সন্তানদের জন্য বাসায় গৃহশিক্ষক নিযুক্ত করা হতো। তারাও ছিলেন মেধার দিক থেকে উঁচু মানের এবং শিক্ষাদানকে যারা পণ্য হিসেবে ভাবতেও পারতেন না। তথ্যপ্রযুক্তির কল্যাণে হাতের মুঠোয় তখন বিশ্ব ছিল না। কিন্তু সত্যিকারের জ্ঞানচর্চার আনুষঙ্গিক বিষয় একেবারে নাগালের মধ্যে থাকত। সবার বাসায় ছোট্ট এক লাইব্রেরি সাজানো ছিল। যেখানে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, শরৎচন্দ্র থেকে শুরু করে বিভূতি-মানিকের বইও শোভা পেত। ম্যাক্সিম গোর্কির মা ছিল, টলস্টয়ের আন্নাকারেনিনা কিংবা যুদ্ধ এবং শান্তি ছিল। প্রগতি প্রকাশের কল্যাণে চেখভকে চিনতেও কষ্ট হতো না। সাংস্কৃতিক বিনোদনেরও অন্য মাত্রার সুস্থ আবহ ছিল। শহরে কিংবা গ্রামে নির্দিষ্ট কিছু এলাকায় যাত্রা গান, নাটক কিংবা সঙ্গীতের আসর জমত যেখানে অভিভাবকরাও সন্তানদের নিয়ে সুস্থ মনন বিকাশের ধারাকে নিয়মিতই চর্চা করতেন। সিনেমা হলেও সুস্থ চলচ্চিত্র মুক্তি পেত যা সবাইকে নিয়ে আনন্দের সঙ্গে উপভোগও করা যেত। শুধু তাই নয়, দৈনিক পত্রিকা রাখাও অনেক পরিবারের প্রতিদিনের কর্মপরিকল্পনার অংশ ছিল। বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গন এখনও তার ঐতিহ্যিক ধারায় বহমান। এখনও দেশ সঙ্গীত, উৎসব, নাট্যমেলা কিংবা বিভিন্ন ধরনের সুস্থ বিনোদন চর্চায় নিয়তই নিয়োজিত আছে। তবে এখনকার স্কুল-কলেজে পড়ুয়া ছাত্রছাত্রীদের এসব আয়োজন দেখার সময় কোথায়? শুরু থেকেই তৈরি হয় ভর্তিযুদ্ধের মতো এক ভয়ঙ্কর পরীক্ষা প্রদাহ। যার জীবাণুনাশক ওষুধ আদৌ বের হবে কিনা জানি না। প-িত জওহরলাল নেহরু কন্যা ইন্দিরা গান্ধীর কাছে যে সব চিঠি লিখতেন তা এক সময় গ্রন্থাকারে বের হয়। ‘পৃথিবীর ইতিহাস’ নামে বইটির বাংলা অনুবাদও হয়। যা পড়ে ইন্দিরা গান্ধীর নিজেকে তৈরি করার মূল ভিত্তি এবং অনুপ্রেরণা অনেকেরই দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। যে বোধ ভারতের এই সাবেক প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক প্রজ্ঞায় সুদূরপ্রসারী প্রভাব রেখেছিল। বই পড়ার আনন্দের সঙ্গে অন্য কোন কিছুরই তুলনা করা চলে না। নিজেদের পাঠ্যপুস্তক এবং প্রতিযোগিতার ভারে বর্তমান প্রজন্ম এমন বেসামাল অবস্থায় সেখানে গভীর চিন্তার বিষয়গুলো জানার অবকাশই বা কোথায়? কোন তথ্যের প্রয়োজন পড়লে অল্প সময়ে ওয়েবসাইড সার্চ করে বের করা সম্ভব। যাতে সময়ও বাঁচে নিজের প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনার নির্মম শৃঙ্খলার ওপরও কোন ধরনের চাপ তৈরি হয় না। ডিসেম্বর মাস জুড়েই চলে ভর্তি পরীক্ষার মতো এক কঠিন সমরাভিযানের। তার পরও সবার সবদিক রক্ষা হয় না। সরকারী প্রতিষ্ঠানের আসন সংখ্যা অপ্রতুল হওয়ায় বেসরকারী ইংরেজী মাধ্যম বিদ্যাপীঠে ছাত্র ভর্তির তোড়জোড় শুরু হয়ে যায়। নিম্ন মধ্যবিত্ত কিংবা মধ্যবিত্ত সমাজে যাদের সংখ্যাই বেশি তাদের লক্ষ্য থাকে সরকারী স্কুলে কোনমতে প্রবেশটুকু নিশ্চিত করা। তাহলে আর্থিক সুবিধা তো পাওয়াই যায় তার ওপর সন্তানের মেধারও এক ধরনের যাচাই-বাছাই হয়। বেশিরভাগ ছাত্রকে পড়তে হয় ইংরেজী মাধ্যম কিংবা অন্যান্য বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। এসব জায়গায় আর্থিক সঙ্কট সামলাতে গিয়ে অভিভাবকদের যে পরিমাণ হিমশিম খেতে হয় তা বর্ণনায়ও আসে না। এ ধরনের অবর্ণনীয় মানসিক চাপে সন্তানের মেধারও কোন উৎকর্ষ সাধন হয় না। এমন এক কঠিন শৃঙ্খলের মধ্যে ছেলেমেয়েরা তাদের শিক্ষার সুবর্ণ সময়টুকু পার করে নম্বরের হিসাব মেলাতে মেলাতে। ঘুম থেকে ওঠা এবং ঘুমোতে যাওয়া অবধি দৌড়ঝাঁপের ওপর পুরো দিনটি কেমন করে পার হয় সেটাও তাদের বিবেচনার বাইরে। সন্তানের সঙ্গে ক্রমাগত ছুটে বেড়াচ্ছে গৃহিণী মায়েরাও। কর্মজীবী বাবাদের তো সময়ই নেই এসব বাড়তি দায়িত্ব পালন করার। বর্তমানে অনেক নারী বিভিন্ন সরকারী-বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে কর্মজীবী হিসেবে সম্পৃক্ত হওয়ার কারণে সেভাবে সন্তানদের পেছন পেছন ঘুরতেও পারেন না। ফলে তাদের অবস্থা হয় আরও সঙ্গীন। না পারে কর্মস্থলে মনোযোগ দিতে এই আশঙ্কায় যে তার অনুপস্থিতিতে সন্তানের শিক্ষা কার্যক্রমের কোন ধরনের বিঘœ ঘটছে কিনা। আগের দিনের মায়েরা এসব ভাবতেনই না। এ তো গেল সন্তান, অভিভাবক ভর্তি এবং কোচিং বাণিজ্যের এক বেসামাল অবস্থা। তার ওপর প্রতিনিয়তই বিপত্তি ঘটাচ্ছে প্রশ্ন ফাঁসের মতো এক অনভিপ্রেত এবং অরাজক পরিস্থিতির অশুভ ছায়া। প্রশ্ন ফাঁসের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়ানো থাকে অর্থ বাণিজ্য। বস্তুবাদী সমাজবিজ্ঞানী কার্ল মার্কস বলেছিলেন পুঁজিবাদী ব্যবস্থার চরম পর্যায়ে সর্বস্তরে পণ্য বিকাশের যে অশুভ পাঁয়তারা শুরু হবে সেখান থেকে কারও মুক্তির পথও থাকবে না। পুরো শিক্ষা ব্যবস্থা আজ শুধু বাণিজ্যই নয় পণ্যের নগ্ন থাবায়ও ভয়ানকভাবে আক্রান্ত হচ্ছে। বাংলাদেশের মিশ্র উৎপাদন প্রণালীতে সামন্ত এবং পুঁজিবাদী সমাজ কাঠামোর ক্ষতিকারক উপাদানগুলো এমন ভয়ঙ্করভাবে মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে যাকে প্রতিহত করতে না পারলে ভবিষ্যত প্রজন্ম সুস্থ এবং স্বাভাবিকভাবে নিজেদের লক্ষ্য স্থির করতে বিড়ম্বনার শিকার হতে পারে। মধ্যযুগের সামন্ততান্ত্রিক ধর্মীয় উন্মাদনার সঙ্গে আধুনিক পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থার পণ্য বিস্তারের যে বিপর্যস্ত পরিস্থিতি তা পুরো কাঠামোকে বিপন্ন করার জন্য সহায়ক শক্তির ভূমিকায় নামাটা অসম্ভব কিছু নয়। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট সবাইকে সতর্ক এবং সাবধান হয়ে পরিস্থিতির গুরুত্ব অনুধাবন করতে হবে। শুধু তাই নয় এই অসহনীয় নির্মম বেষ্টনী থেকে কিভাবে বের হয়ে আসা যায় তারও একটি সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা বিজ্ঞজনদের কাছ থেকে আসা এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি জরুরী। লেখক : সাংবাদিক
×