ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

কাওসার রহমান

অর্থনীতির বৃত্ত ভাঙ্গার গল্প

প্রকাশিত: ০৩:৫২, ২৬ ডিসেম্বর ২০১৭

অর্থনীতির বৃত্ত ভাঙ্গার গল্প

বাংলাদেশ এই ডিসেম্বর মাসে বিজয়ের ৪৬তম বার্ষিকী উদযাপন করছে। এই বিজয় শুধু একটি পতাকা কিংবা একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্য অর্জিত হয়নি। বাংলাদেশের এই স্বাধীনতা অর্জনের পেছনে মূলমন্ত্র হিসেবে কাজ করেছে অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জন। পাকিস্তানী শোষণের হাত থেকে বেরিয়ে অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জনের মাধ্যমে এ দেশের মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন। সেই মুক্তি অর্জনের পথে বাংলাদেশ দীর্ঘদিনের অচলায়তন বা বৃত্ত ভাঙতে সক্ষম হয়েছে। এখন শুধু এগিয়ে যাওয়ার পালা। বিজয়ের এই ৪৬তম বার্ষিকীতে সেই বৃত্ত ভাঙ্গার গল্পটাই এবারের লেখায় তুলে ধরতে চাই। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এখন জাগরণ চলছে। এই জাগরণ উন্নয়নের, এই জাগরণ সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাওয়ার। বদলে যাওয়া এই অর্থনীতির ভিত রচিত হয়েছে ২০০৮-২০০৯ সালে। বৈশ্বিক মন্দা বা রাজনৈতিক অস্থিরতা মাঝে মধ্যে বাধা সৃষ্টি করলেও গত আট বছর ধরে দেশের অর্থনীতিতে একটি শক্তিশালী অবস্থান তৈরি হয়েছে। যে কারণে বাংলাদেশ তার সুবর্ণজয়ন্তীর অর্থবছরে ৭ লাখ কোটি টাকা বাজেট প্রদানের স্বপ্ন দেখছে। স্বপ্ন দেখছে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি দুই অঙ্কে নিয়ে যাওয়ার। এই স্বপ্ন এখন আর অবাস্তব কিছু নয়। কেবল রূপপুর- মেট্রোরেলের মতো মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের মধ্য দিয়েই সেই স্বপ্ন পূরণ সম্ভব। প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবেলায় বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন যথেষ্ট ‘রেজিলিয়েন্স’। বৈশ্বিক মন্দায় দ্রুত অগ্রসরমান দেশগুলো যেখানে মুখ থুবড়ে পড়েছে, সেখানে কী বৈশ্বিক কী দেশীয় বাণিজ্য ঝা-া তুলে সামনে এগিয়ে গেছে। অভ্যন্তরীণ সংঘাতময় রাজনীতি ও প্রাকৃতিক দুর্যোগে সাময়িক ধাক্কা খেলেও পরক্ষণেই ঘুরে দাঁড়িয়েছে অর্থনীতির সূচকগুলো। যে কারণে টানা ছয় বছরের ছয় শতাংশ প্রবৃদ্ধির বৃত্ত ভেঙ্গে ৭ শতাংশে ক্লাবে যোগ দিয়েছে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি। এটা সম্ভব হয়েছে আমদানি, রফতানি, রিজার্ভ, রেমিটেন্স ও রাজস্ব আয়ের সূচকগুলোর উর্ধমুখী প্রবণতার কারণেই। সংঘাতময় রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে ২০১৩ সালের সর্বশেষ প্রান্তিকে সূচকগুলো বেশ খানিকটা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছিল। তবে সমাজ ও রাজনীতিতে দ্রুত শান্তি ফিরে আসায় অর্থনীতি আবার স্বস্তিদায়ক অবস্থানে রয়েছে। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতায় অর্থনীতির রক্তক্ষরণের পর আবারও অর্থনীতির সূচকগুলো ঘুরে দাঁড়ানোর কৃতিত্ব অবশ্যই এ সরকারের। বাংলাদেশের সূচনালগ্নে দেশের অর্থনীতি ছিল প্রধানত কৃষিভিত্তিক। বিগত কয়েক দশকে এ অর্থনীতি ব্যবস্থায় এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। কৃষিভিত্তিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে খোলনলচে পাল্টে ফেলেছে এ দেশের শ্রমিক ভাই-বোনদের উৎপাদিত পোশাকের রফতানি আয় আর বিদেশ থেকে পাঠানো বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। হালে এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে তথ্যপ্রযুক্তি ও যোগাযোগ ব্যবস্থায় ক্রমবর্ধমান উন্নতির ছোঁয়া, যা এ দেশের সাধারণ জনগণকে করে তুলেছে অধিকতর সচেতন ও আত্মপ্রত্যয়ী। আর এ সচেতনতা ও আত্মপ্রত্যয়কে কাজে লাগিয়ে এ দেশের সাধারণ মানুষ তাদের অর্থনৈতিক অবস্থানকে ক্রমশ শক্তিশালী করার ঐকান্তিক প্রয়াসে লিপ্ত। যার ফলাফল প্রতিফলিত হয়েছে দেশের আর্থিক বৃদ্ধিতে। বাংলাদেশের ইতিহাসে এই প্রথম হ্রাস পাচ্ছে বৈষম্য। সেই সঙ্গে কমছে দারিদ্র্য। বৈষম্য কমতে শুরু করার পর মানুষ আয় বৃদ্ধির নানা সুযোগ পাচ্ছে। পাচ্ছে প্রবৃদ্ধির সুফল। এটা সম্ভব হয়েছে অর্থনীতিতে গতি সঞ্চারের কারণে। বাংলাদেশের অর্থনীতির এই অগ্রগতির গল্প খুব বেশি সময়ের নয়। মাত্র কয়েক বছরের। সুনির্দিষ্ট করে বলতে গেলে বলতে হবে আট বছরের। অনেকে প্রশ্ন করবেন, তাহলে কি তার আগের ৩৮ বছরে অর্থনীতি আগায়নি? এগিয়েছে। তবে ওই অগ্রগতিতে ‘টেকসই গতি’ ছিল না। ফলে অনেক সম্ভাবনা তৈরি করেও তা বার বার মুখ থুবড়ে পড়েছে। আর গত আট বছরের অগ্রগতিতে আমরা একটি ধারাবাহিকতা দেখতে পাচ্ছি। এ ব্যাপারে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সূচকের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। সূচকের প্রথমেই আসে আর্থিক বৃদ্ধি তথা জিডিপির। আর্থিক বৃদ্ধি বা জিডিপি প্রবৃদ্ধি ॥ কোন একটি দেশের অর্থনীতি পরিমাপের মাপকাঠি হচ্ছে জিডিপি প্রবৃদ্ধি। ক’দিন আগেও আমাদের জিডিপির আকার ছিল ১০০ বিলিয়নের নিচে। সেই জিডিপি এখন ২৫০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। আর গত আট বছরে বাংলাদেশ একটি স্থিতিশীল জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করে চলেছে। এর মধ্যে টানা ছয় বছর (২০০৯-১০ থেকে ২০১৪-১৫) প্রবৃদ্ধি ছয় শতাংশের ঘরে অবস্থান করে। সেই ছয় শতাংশের বেড়াজাল ভেঙ্গে গত দুই বছর ধরে সাত শতাংশের ওপর প্রবৃদ্ধি অর্জিত হচ্ছে। সর্বশেষ ২০১৬-১৭ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে ৭.২৮ শতাংশ। যা উন্নত দেশগুলোর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে। বাংলাদেশকে আর্থিক বৃদ্ধির এক সফল দেশ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। মাথাপিছু আয় ॥ সবচেয়ে নজরকারা অগ্রগতি হয়েছে মানুষের মাথাপিছু আয় বৃদ্ধিতে। এ আয় যেন সাম্প্রতিক বছরগুলোতে লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে। আট বছরে মাথাপিছু আয় বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি। আট বছর আগে ২০০৯-১০ সালে এ আয় ছিল মাত্র ৭৭৫ মার্কিন ডলার, ২০১৬-১৭ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে এক হাজার ৬১০ ডলার। এ যেন এক অবিশ্বাস্য সাধন! রেমিটেন্স ॥ রেমিটেন্স নিয়ে একটি টানাপোড়েন চলছে। ‘ডিজিটাল হুন্ডি’ এসে হঠাৎ করেই যেন প্রবাসী আয়ের সাজানো সংসার তছনছ করে দিয়েছে। গত দুই বছর ধরেই এই আয়ে একটি স্থবিরতা চলছে। তাই বলে, বিদেশ থেকে টাকা আসার গতি কিন্তু থেমে নেই। তবে আসছে অবৈধ পন্থায় তথা হুন্ডিতে। মোবাইল ব্যাংকিং চালুর পর হুন্ডিবাজরা হাতে অস্ত্র পেয়ে আবার সক্রিয় হয়ে উঠেছে। ফলে বৈধ পথে আসা রেমিটেন্সের একটি অংশ চলে যাচ্ছে অবৈধ পথে। ২০০৮-০৯ সালে প্রবাসী আয়ের প্রবাহ ছিল ৮৫০ কোটি মার্কিন ডলার। আর ২০১৪-১৫ অর্থবছরে দেশে এক হাজার ৫৩১ কোটি ৬৯ লাখ (১৫.৩১ বিলিয়ন) ডলারের রেমিটেন্স আসে। এই ছয় বছরে দেশে রেমিটেন্স বাড়ে ৬৮১ কোটি ডলার। এরপর থেকেই সব হিসেব পাল্টে যায়। রেমিটেন্সে নেমে আসে মন্দাভাব। গত প্রায় আড়াই বছর ধরেই রেমিটেন্স কমছে। সাম্প্রতিক এই রেমিটেন্স উদ্বেগজনক অবস্থায় নেমে এসেছে। মূলত সহজ পন্থা এবং কম খরচের কারণে বিদেশে অবস্থানরত বেশিরভাগ বাংলাদেশীই দেশে টাকা পাঠাচ্ছে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের ‘ডিজিটাল হুন্ডিতে।’ দ্রুত এ ব্যাপারে পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত। কারণ বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের অন্যতম উৎস এই প্রবাসী আয়। এই আয় মোট ঋণ ও বিদেশী বিনিয়োগের চেয়েও বেশি। তবে এভাবে প্রবাসী আয় কমে যাওয়া অব্যাহত থাকলে সামগ্রিক অর্থনীতিতেই এর বিরূপ প্রভাব পড়বে। আমদানি-রফতানি॥ আমদানি-রফতানি কার্যক্রম পর্যালোচনায় দেখা যায়, বিগত আট বছরে প্রবৃদ্ধির দিক থেকে এগিয়ে আছে রফতানি এবং পিছিয়ে পড়েছে আমদানি। ২০০৯-১৭ অর্থবছর পর্যন্ত এ সময়ে রফতানির প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩০ দশমিক ০৭ শতাংশ। আর আমদানি প্রবৃদ্ধি প্রায় ১৭ শতাংশ। যা অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে মোট আমদানি ব্যয় হয়েছিল ২ হাজার ২৫১ কোটি মার্কিন ডলার। আর ২০১৬-১৭ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ৩৫০ কোটি ডলার। অন্যদিকে, ২০০৮-০৯ অর্থবছরে রফতানি আয় ছিল এক হাজার ৫৬৫ কোটি ডলার। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে সেই আয় বেড়ে হয় ৩ হাজার ৪০১ কোটি ডলার। তাজরীন গার্মেন্টসে ভয়ভহ অগ্নি দুর্ঘটনা ও রানা প্লাজা ধসের পর বাংলাদেশের রফতানি আয় হোঁচট খায়নি। বরং প্রবৃদ্ধি ধরে এগিয়ে গেছে। রেমিটেন্সে টানাপোড়েনের কারণে রফতানি আয়ের প্রবৃদ্ধি অর্থনীতির জন্য স্বস্তিদায়ক। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ॥ কোন দেশের অর্থনীতি কতটা শক্তিশালী তা যাচাইয়ের জন্য সাধারণত দুটি সূচকের প্রতি দৃষ্টি দিয়ে থাকেন বিদেশী বিনিয়োগকরীরা। একটি হলো ওই দেশের প্রবৃদ্ধি এবং অন্যটি হলো দেশটির বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি যতটা উৎসাহব্যঞ্জক, রিজার্ভ ততটা বেশি নয়। আর্থিক বৃদ্ধির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এখনও ততটা মজবুত অবস্থায় পৌঁছতে পারেনি। অবশ্য ২০০৯ সাল থেকে রিজার্ভ মোটামুটি দ্রুত গতিতেই বাড়ছিল। গত সাত বছরে রেকর্ডের পর রেকর্ড গড়ে এই রিজার্ভ ছয় গুণ বেড়ে ৩০ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করে গিয়েছিল। কিন্তু হালে এই রিজার্ভের উন্নতিতে শ্লথ গতি দেখা যাচ্ছে। যেখানে বছরে সাড়ে তিন বিলিয়ন ডলার করে রিজার্ভ বাড়ছিল, সেখানে গত এক বছরে রিজার্ভ বেড়েছে মাত্র দুই বিলিয়ন ডলার। গত এক বছর ধরে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩৩ বিলিয়ন ডলারের ঘরেই ঘুরপাক খাচ্ছে। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে- রেমিটেন্স প্রবাহে আশানুরূপ প্রবৃদ্ধি না ঘটা। অবশ্য, ২০০৯ সালে রিজার্ভ ছিল মাত্র ৫০০ কোটি ডলার। তবে স্বস্তির বিষয় হলো, আগে যেখানে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দিয়ে তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোও কষ্টকর ব্যাপার ছিল, এখন আট মাসের আমদানি মূল্য পরিশোধের জন্য যথেষ্ট। আর এই রেকর্ড রিজার্ভের স্থিতি নিয়ে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের পরেই দ্বিতীয় স্থানে উঠে এসেছে। এটা নিঃসন্দেহে বড় অর্থনৈতিক সাফল্য। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশ যে এখন নিজের পায়ের ওপর দাঁড়াতে সক্ষম হচ্ছে, উচ্চমাত্রার বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ তারই প্রমাণ। অর্থনীতির গতি শক্তিশালী হওয়ার ফলেই বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ বা রিজার্ভ বাড়ছে। চলবে... লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক
×