ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

কবে মিলবে স্বীকৃতি

রণাঙ্গনের তিন মুক্তিযোদ্ধা আজও উপেক্ষিত

প্রকাশিত: ০৫:৩৭, ২৫ ডিসেম্বর ২০১৭

রণাঙ্গনের তিন মুক্তিযোদ্ধা আজও উপেক্ষিত

খোকন আহম্মেদ হীরা, বরিশাল ॥ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সারা দিয়ে দেশমাতৃকার টানে নিজের জীবনবাজি রেখে রণাঙ্গনে সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে লাল সবুজের বিজয় পতাকা ছিনিয়ে এনেছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা রতন কুমার সরকার, এমএস মাহামুদ হোসেন ও এইচএম মহিউদ্দিন। স্বাধীনতা যুদ্ধে তারা বিজয়ী হলেও জীবনযুদ্ধে হয়েছেন পুরোপুরি পরাজিত। সকল প্রকার সনদ থাকা সত্তেও দেশ স্বাধীনের দীর্ঘদিন পরও তারা মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হতে পারেননি। তালিকাভুক্ত হওয়ার জন্য তারা বিভিন্নস্থানে ঘুরেও কোন সুফল পাননি। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা হয়েও শেষ পর্যন্ত তারা কি স্বীকৃতি পাবেন এ নিয়ে নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে মুক্তিযোদ্ধাদের মাঝে। জীবনের শেষপ্রান্তে দাঁড়িয়ে ৯নং সেক্টরের যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার সৈয়দ মনিরুল ইসলাম বুলেট ছিন্টু আক্ষেপ করে বলেন, যারা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে সরাসরি মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে যুদ্ধ করেছেন তাদের অনেকের নাম এখনও তালিকাভুক্ত হয়নি। অথচ অনেকেই মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ না করেও জালিয়াতির মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধা হয়েছেন। তিনি উল্লেখিত মুক্তিযোদ্ধাদের গেজেটভুক্ত করার জন্য প্রধানমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্ট উর্ধতন কর্মকর্তাদের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন। রতন কুমার সরকার ॥ দশম শ্রেণীর ছাত্র রতন কুমার সরকার তার গর্ভধারিণী মাকে না জানিয়ে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছিলেন। বরিশালের বাকেরগঞ্জ উপজেলার ভরপাশা গ্রামের মৃত নগেন্দ্র নাথ সরকারের পুত্র রতন কুমার সরকার (৬২) বলেন, ১৯৭১ সালের মে মাসে মাকে না জানিয়ে দেশকে শত্রুমুক্ত করার নেশায় সেদিন মুক্তিযুদ্ধের স্থানীয় বেজ কমান্ডার বজলুর রহমান খান ও সহকারী বেজ কমান্ডার তৎকালীন নৌবাহিনীর কর্মকর্তা আব্দুর রাজ্জাক খানের দলে যোগদান করে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছিলাম। জুন মাসে মুক্তিবাহিনীর পাদ্রীশিবপুর ক্যাম্পে সমবেত হয়ে বিভিন্নস্থানে পাক সেনাদের সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছি। পাকসেনাদের অবস্থান জানার জন্য ক্যাম্প থেকে প্রায়ই আমাকে জীবন বাজি রেখে ছদ্মবেশ ধারণ করে গোয়েন্দার কাজ করতে হয়েছে। নবেম্বর মাসে শ্যামপুর এলাকায় পাক সেনাদের বহনকারী গানবোটে হামলা চালায় মুক্তিযোদ্ধারা। পরবর্তীতে উভয়গ্রুপের মধ্যে সম্মুখযুদ্ধে ছয় পাক সেনা মারা যায়। সেই যুদ্ধে বীরত্বের ভূমিকা পালন করেন রতন কুমার সরকার।মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের নানা কাগজপত্র থাকা সত্তেও অদ্যাবধি তিনি গেজেটভুক্ত হতে পারেননি। একাধিবার গেজেটভুক্ত হওয়ার চেষ্টা করেও তিনি ব্যর্থ হয়েছেন। সর্বশেষ অনলাইনে আবেদনের পর যাচাই-বাছাইয়ে রহস্যজনক কারণে তাকে ‘খ’ তালিকাভুক্ত করা হয়। পরবর্তীতে তিনি জামুকায় আপীল করেছেন। জীবনের শেষপ্রান্তে এসে একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্তি হওয়ার জন্য রতর কুমার সরকার প্রধানমন্ত্রীর আশু হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন। এমএস মাহামুদ হোসেন ॥ মৃত্যুকে ভয় না পেয়ে নিজের জীবন বাজি রেখে মুক্তিযোদ্ধাদের গুপ্তচর হিসেবে কাজ করেছেন বাকেরগঞ্জ উপজেলার ভরপাশা ইউনিয়নের দুধল গ্রামের মৃত আমিন উদ্দিন সিকদারের পুত্র টগবগে যুবক এমএস মাহামুদ হোসেন ওরফে আব্দুল হাই সিকদার (৬৫)। একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা হয়েও নানা কারণে গেজেটভুক্ত হতে না পেরে জীবনের শেষপ্রান্তে এসে ছয় সদস্যের পরিবারের ভরণপোষণের জন্য এখনও তাকে দিনরাত হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করতে হচ্ছে। তিনি জানান, দেশমাতৃকার টানে পরিবারের সদস্যদের না জানিয়ে ১৯৭১ সালের মে মাসে মুক্তিযুদ্ধের স্থানীয় বেজ কমান্ডার বজলুর রহমান খান ও সহকারী বেজ কমান্ডার আব্দুর রাজ্জাক খানের দলে যোগদান করে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছিলাম। পরবর্তীতে আমাকে ছদ্মবেশ ধারণ করে পাক সেনা ও রাজাকারদের অবস্থান কিংবা আগমনের খবরাখবর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে পৌঁছে দেয়ার দায়িত্ব দেয়া হয়। নিজের জীবন বাজি রেখে সেদিন দায়িত্ব পালন করেছি। দেশ স্বাধীনের পর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প থেকে আমার কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ সনদপত্র দেয়া হয়েছে। নানা কাগজপত্র থাকা সত্তেও অদ্যাবধি তিনি মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আজও গেজেটভুক্ত হতে পারেননি। সর্বশেষ অনলাইনে আবেদনের পর যাচাই-বাছাইয়ে তাকে ‘খ’ তালিকাভুক্ত করার পর তিনি জামুকায় আপীল করেছেন। এজন্য তিনি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন। এইচএম মহিউদ্দিন ॥ গৌরনদী উপজেলার দিয়াশুর গ্রামের তালেব আলী হাওলাদারের পুত্র এইচএম আলাউদ্দিন ও এইচএম মহিউদ্দিন মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। এ খবর পেয়ে স্থানীয় রাজাকারদের সহযোগিতায় পাকসেনারা তালেব আলী হাওলাদার ও তার স্ত্রী আছিরোন নেছাকে ধরে নিয়ে সরকারী গৌরনদী কলেজের পাক সেনাদের ক্যাম্পে দীর্ঘ সাত মাস আটকে রেখে অমানুষিক নির্যাতন করেছিল। যুদ্ধ চলাকালে পাক সেনাদের হাতে গুরুতর জখম হয়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধা এইচএম মহিউদ্দিন। দেশ স্বাধীনের পর ছিনতাইকারীদের কবলে পড়ে মুক্তিযুদ্ধের সকল কাগজপত্র খোয়া যায় মহিউদ্দিনের। যে কারণে একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা হয়ে আজও তার নাম তালিকাভুক্ত হয়নি। মহিউদ্দিনের একপুত্র ও দুই কন্যা উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হলেও বাবার মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেটের অভাবে তারা সরকারী চাকরি থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
×