ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ের বিরুদ্ধে সরকারের আবেদন;###; ৯৪টি গ্রাউন্ড তুলে ধরা হয়েছে আবেদনপত্রে

বিচারপতি অপসারণ ক্ষমতা সংসদের হাতে দেয়া হোক॥ রিভিউ আবেদন

প্রকাশিত: ০৪:৫৫, ২৫ ডিসেম্বর ২০১৭

বিচারপতি অপসারণ ক্ষমতা সংসদের হাতে দেয়া হোক॥ রিভিউ আবেদন

স্টাফ রিপোর্টার ॥ উচ্চ আদালতের বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে ফিরিয়ে দিয়ে করা সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন দাখিল করেছে রাষ্ট্রপক্ষ। রবিবার সকালে সুপ্রীমকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় এই আবেদন দাখিল করা হয়েছে। আবেদনে সুপ্রীমকোর্টের ওই রায় বাতিলে ৯৪টি যুক্তি তুলে ধরা হয়েছে বলে জানান এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। নিজ কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, রায়ে যেসব অপ্রাসঙ্গিক পর্যালোচনা এসেছে তা বাতিল চাওয়া হয়েছে। এছাড়া সুপ্রীমকোর্টের বিচারক অপসারণ সংক্রান্ত আইন হওয়ার আগেই আপীলের রায়ে ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করা হয়েছে; যা আমাদের কাছে অপরিপক্ক মনে হয়েছে। রিভিউ আবেদনে আমরা ওই রায় বাতিল চেয়েছি। মাহবুবে আলম বলেন, আশা করি ৯৪টি গ্রাউন্ড বিবেচনায় নিয়ে আপীল বিভাগ রায় পুনর্বিবেচনা করবে এবং সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বহাল থাকবে। উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে ফিরিয়ে দিয়ে ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ সংশোধনের প্রস্তাব সংসদে পাস হয়, যা ষোড়শ সংশোধনী হিসেবে পরিচিত। সুপ্রীমকোর্টের নয় আইনজীবীর এক রিট আবেদনে হাইকোর্ট ২০১৬ সালে সংবিধানের ওই সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেয়। প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন সাত বিচারকের আপীল বিভাগ গত ৩ জুলাই রাষ্ট্রপক্ষের আপীল খারিজ করে দিলে হাইকোর্টের রায়ই বহাল থাকে। ওই রায়ের মাধ্যমে জিয়াউর রহমানের সামরিক শাসনামলে প্রতিষ্ঠিত সুপ্রীম জুডিশিয়াল কাউন্সিল ফিরিয়ে আনে সুপ্রীমকোর্ট। সেই সঙ্গে বিচারকদের জন্য একটি আচরণবিধিও ঠিক করে দেয়া হয় রায়ে। সাত বিচারপতির ঐকমত্যের ভিত্তিতে দেয়া ৭৯৯ পৃষ্ঠার ওই রায়ে তখনকার প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহা নিজের পর্যবেক্ষণের অংশে দেশের রাজনীতি, সামরিক শাসন, নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি, সুশাসন ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতাসহ বিভিন্ন বিষয়ে সমালোচনা করেন। ওই রায় এবং পর্যবেক্ষণ নিয়ে খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও প্রধান বিচারপতির সমালোচনা করেন। রায়ের পর্যবেক্ষণে বঙ্গবন্ধুকে খাটো করা হয়েছে অভিযোগ তুলে বিচারপতি সিনহার পদত্যাগের দাবি তোলেন ক্ষমতাসীন দলের অনেক নেতা। তুমুল আলোচনা-সমালোচনার মধ্যে বিচারপতি সিনহা গত ৩ অক্টোবর থেকে ছুটিতে যান। তিনি দায়িত্বে না ফেরা পর্যন্ত আপীল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি মোঃ আবদুল ওয়াহহাব মিঞাকে প্রধান বিচারপতির কার্যভার দেন রাষ্ট্রপতি। ১৩ অক্টোবর রাতে অস্ট্রেলিয়ার উদ্দেশে দেশ ছাড়েন বিচারপতি সিনহা। ছুটি শেষে ১০ নবেম্বর সিঙ্গাপুর থেকে হাইকমিশনারের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতির কাছে নিজের পদত্যাগপত্র পাঠান বিচারপতি সিনহা। এর আগে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় এবং পর্যবেক্ষণের বিষয়ে আইনী পদক্ষেপ নিতে ১৪ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদে একটি প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেদিন সংসদে বলেন, আদালত তার এখতিয়ারের বাইরে গিয়ে সংসদে আনা সংবিধান সংশোধন বাতিলের ওই রায় দিয়েছে। সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় পর্যালোচনা ও পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন করতে সহকর্মীদের নিয়ে অক্টোবরের শুরুর দিকে ১১ সদস্যের কমিটি করেন এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। এর ধারাবাহিকতায় রবিবার সেই আবেদন জমা দেয়া হলো। রিভিউ আবেদন দাখিলের পর সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে এ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, আপীলের খারিজাদেশ পুনর্বিবেচনা করা হোক এবং আমাদের আপীলের রায়টা বাতিল করে রিভিউ পিটিশনটা গ্রহণ করা হোক, এটা আমরা চেয়েছি। তিনি বলেন, পার্লামেন্ট যে সংশোধন করেছিল অর্থাৎ জিয়াউর রহমানের আমলে মার্শাল ল ফরমান দ্বারা সুপ্রীম জুডিশিয়াল কাউন্সিল নামে সংবিধানে সন্নিবেশন করা হয়েছিল সেটাকে বাতিল করে ১৯৭২ সালের সংবিধানের মূল যে অনুচ্ছেদ তাতে আমরা ফিরে যেতে চেয়েছি। এ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, এখানে অনেকের ধারণা সংসদই তাদের অপসারণ করবে। বিষয়টা তা না। যেকোন বিচারপতি তিনি যদি অসামর্থ্য হন বা তার বিরুদ্ধে যদি অসদাচরণের কোন অভিযোগ ওঠে সে ক্ষেত্রে তার বিরুদ্ধে কিভাবে তদন্ত হবে সেটা উল্লেখিত হবে ৯৬(৩) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী। সেই তদন্ত হওয়ার পর তদন্ত কমিটি যদি মনে করে, তিনি দোষী সে ক্ষেত্রে তদন্ত কমিটি রিকমেন্ডেশন করবে তার অপসাণের জন্য। সেই রিকমেন্ডেশনটি পার্লামেন্টে যাবে এবং দুই-তৃতীয়াংশ ভোটে সমর্থিত হলেই তখন সেটা রাষ্ট্রপতির কাছে যাবে চূড়ান্ত আদেশের জন্য। কাজেই তদন্ত কমিটি কোন বিচারপতিকে দোষী সাব্যস্ত না করেন সেক্ষেত্রে কিন্তু এটা পার্লামেন্টে যাবেই না। কাজেই মুখ্য বিষয় হলো- একজন বিচারপতির বিরুদ্ধে যখন অভিযোগ উত্থাপিত হবে তখন সেটার তদন্ত করার দায়িত্ব কার কাছে থাকবে এবং তদন্তের পদ্ধতিটা কি হবে, তদন্ত কারা কারা করবেন সেটিই হবে মূল বিষয়। রিভিউর গ্রাউন্ড সম্পর্কে তিনি বলেন, আমরা বলেছি, পার্লামেন্ট মেম্বারদের সম্পর্কে যেসব উক্তি করা হয়েছে, পার্লামেন্ট সম্পর্কে যেসব উক্তি করা হয়েছে, পার্লামেন্ট অপরিপক্ক, পার্লামেন্ট সঠিকভাবে কাজ করতে পারছে না বা সংসদ সদস্যরা ব্যবসায়ী, তারা নিজেদের স্বার্থ নিয়ে ব্যস্ত আছেন এবং নারী সাংসদরা যেহেতু নির্বাচিত না, সেহেতু বিচারপতিদের অপসারণের ব্যাপারে তাদের অংশহগ্রহণ করা সঠিক না, এ রকম অনেক পর্যবেক্ষণ বা মন্তব্য যা আমরা সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করে বাতিল চেয়েছি। এত সুনির্দিষ্ট করেছি বলেই গ্রাউন্ডগুলো এত বড় হয়েছে। এজন্যই আমাদের এতদিন পরিশ্রম করতে হয়েছে। তিনি আরও বলেন, সবচেয়ে বড় গ্রাউন্ড যেটা আমি বলতে চাই, যেটা আমার মাথায় এসেছে সেটা হলো, সুপ্রীম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের বিধানে ছিল, কোন বিচারপতির বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ উত্থাপিত হলে প্রধান বিচারপতি এবং তার নিচে দুজন জ্যেষ্ঠতম বিচারপতিকে নিয়ে কাউন্সিল গঠিত হবে। তারা এসব অভিযোগের শুনানি করবেন। সেখানে সংশ্লিষ্ট বিচারপতিকেও সুযোগ দেয়া হবে আত্মপক্ষ সমর্থনের। আমাদের সংবিধানে ৯৬ (৩) এ যেটা আছে, সেটা হলো এ বিষয়ে সরকার আইন প্রণয়ন করবেন। অর্থাৎ সংসদের দুই-তৃতীয়াংশের রেজুলেশন না হলে কোন বিচারপতিকে অপসারণ করা যাবে না। এ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, আরেকটি বিষয় হলো ১৯৭২ সালে যখন সংবিধান হয়, ৯৬(২), (৩) বহাল ছিল ১৯৭৫ এ অবৈধ সামরিক সরকার আসার আগ পর্যন্ত। এই সময়টায় কোন প্রতিষ্ঠান, কোন দল এমনকি সুপ্রীমকোর্টও এই ৯৬(২), (৩) তে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা খর্ব হয়ে গেছে, এমন কথা তো কেউ বলেনি? কাজেই আজকে যখন আমরা মার্শাল ল দ্বারা প্রণীত একটি বিধানকে অপসারণ করে সংবিধানের মূল অনুচ্ছেদ প্রতিস্থাপন করতে চাই তখন এটাকে আদালত কেন অবৈধ ঘোষণা করবে। বর্তমানে সুপ্রীমকোর্টে অবকাশ চলছে। এই অবকাশ শেষে ২ জানুয়ারি আদালত খোলার পর নিয়ম অনুযায়ী সরকারের রিভিউ আবেদন কার্যতালিকায় আসবে। শুনানি কবে হবে তা জানা যাবে তখনই। আপীল বিভাগের যে সাত বিচারপতি ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় দিয়েছিলেন, তাদের মধ্যে বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা অবসরে গেছেন, আর বিচারপতি এসকে সিনহা পদত্যাগ করেছেন। ফলে আপীল বেঞ্চে এখন বিচারক আছেন পাঁচজন। গত অক্টোবরের শেষে এ্যাটর্নি বলেছিলেন, রিভিউ ফাইল করা হলেও নতুন বিচারপতি নিয়োগ না হওয়া পর্যন্ত রিভিউ শুনানি করার সম্ভবনা নেই, এটাই আমি মনে করছি। তবে তার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছিলেন, রিভিউ শুনানিতে সাত বিচারপতি থাকতে হবে সুপ্রীমকোর্ট রুলসে এমন কোন কথা নেই আমার জানামতে। এমন অনেক রিভিউ আছে যেখানে অনেকেই অবসরে গেছেন কিন্তু রিভিউ শুনানি হয়েছে। বিদেশী আইনজীবীর জন্য আবেদনকারীরা দেশদ্রোহী ॥ সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী রিভিউ শুনানির জন্য যারা বিদেশী আইনজীবী চেয়ে বার কাউন্সিলে আবেদন করেছে তাদের দেশদ্রোহী বলে আখ্যা দিয়েছেন এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। রবিবার সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, দেশের প্রতি, বিচার ব্যবস্থার প্রতি তাদের আস্থা থাকলে তারা এ আবেদন করতে পারতেন না। আমাদের ৫০ হাজার আইনজীবী রয়েছে তারা কি এ শুনানির অযোগ্য? প্রশ্ন রাখেন মাহবুবে আলম। ‘রাষ্ট্রের প্রতি, বিচার ব্যবস্থার প্রতি এই আস্থাহীনতা খুবই নিন্দনীয়’ বলেন এ্যাটর্নি জেনারেল। উল্লেখ্য, সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী রিভিউ শুনানিতে বিদেশী আইনজীবী নিয়োগের অনুমতি চেয়ে বার কাউন্সিলে গত ১৮ ডিসেম্বর আবেদন করে বাদীপক্ষ। আইনজীবী একলাছ উদ্দিন ভূঁইয়া ডাকযোগে বার কাউন্সিল চেয়ারম্যান বরাবর এ আবেদন করেন। এতে বলা হয়, সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর রিভিউ শুনানিতে ন্যায়বিচারের স্বার্থে বিদেশী আইনজীবী নিয়োগের অনুমতি দেয়া হোক। আবেদনে ভারতীয় তিন আইনজীবীর নামও সুপারিশ করা হয়েছে।
×