ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

আলাপচারিতায় যুদ্ধশিশু শামা

৪৫ বছর পর জন্মভূমিতে আসতে পেরে নিজেকে গর্বিত ভাবছি

প্রকাশিত: ০৪:৪৫, ২৫ ডিসেম্বর ২০১৭

৪৫ বছর পর জন্মভূমিতে আসতে পেরে নিজেকে গর্বিত ভাবছি

জান্নাতুল মাওয়া সুইটি ॥ ৪৫ বছর আগে তার নাম ছিল মলি। গর্ভধারিনী মা রেখেছিল তার নামটি! বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত এই নারী বাঙালী পরিচয়ে গড়ে উঠতে পারেন নি। জন্মের ঠিক চার মাস পরই নিজের জন্মভূমি ত্যাগ করতে হয়েছে তাকে। কেননা সে যুদ্ধশিশু। ১৯৭২ সালে কানাডার মন্ট্রিয়াল শহরের এক দম্পতি জোয়েল এবং ট্রুডি হার্ট মলিকে দত্তক নেন। এই দম্পতি মলিকে নিজেদের সন্তানের ন্যায় আদর ভালবাসায় বড় করে তোলেন। এরপর তারাই মলির নাম দেন শামা জমিলা মলি হার্ট। সে জানে না তার মা কে! কিন্তু সে বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করেছে। তার গায়ে বাংলাদেশের মাটির গন্ধ রয়েছে। তাইতো সে সুদূর কানাডা থেকে এই বিজয়ের মাসে নিজ মাতৃভূমিতে প্রথমবারের মতো এসেছেন। সঙ্গে এসেছে তার কন্যা সাভানা বোনেল। বর্তমানে শামা নিজেও একজন মা এবং ব্যক্তিগতভাবে একজন প্রতিষ্ঠিত নারী। তিনি একজন স্কুল শিক্ষিকা। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকালে পাকবাহিনী পরিচালিত নৃশংস অত্যাচারের প্রতীক হয়ে আছে যুদ্ধশিশু, যাদের অনেকে বিদেশে বিভিন্ন পরিবারের সদস্য হয়ে নতুন জীবন গড়ে তুলেছেন। ১৯৭২ সালের ১৯ জুলাই বাংলাদেশ থেকে যে ১৪ জন যুদ্ধশিশুকে কানাডায় পাঠানো হয়েছিল তাদের মধ্যে অন্যতম শামা জমিলা হার্ট। তার বাংলাদেশে আসাটা আর দশজন পর্যটকের মতো নয়, রয়েছে নাড়ির টান। রবিবার বিকেল ৪টায় রাজধানীর আগারগাঁও মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর মিলনায়তনে একাত্তরের এই যুদ্ধশিশু শামা তরুণ প্রজন্মের সঙ্গে এক আলাপচারিতায় তার কন্যা সাভানা বোনেলকে নিয়ে অংশগ্রহণ করেন। ‘একাত্তরের যুদ্ধশিশুর সঙ্গে আলাপচারিতা’ শীর্ষক এই অনুষ্ঠানে শহীদ কন্যা ডাঃ নুজহাত চৌধুরী, কানাডা প্রবাসী যুদ্ধশিশু বিষয়ক গবেষক মোস্তফা চৌধুরী উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানে সূচনা বক্তব্য প্রদান করেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি ডাঃ সারওয়ার আলী। একাত্তরের পাক হানাদারের বর্বরতার শিকার এক বীরাঙ্গনার কন্যা শামা। জন্মের চার মাসের মাথায় শামা নিজ জন্মভূমি ত্যাগ করেন। আর কখনই বাংলাদেশে আসা হয়নি তার। মা, মাটি ও মানুষকে নিয়ে তার নেই কোন স্মৃতি। এমনকি বাংলা ভাষাও শিখতে পারেননি। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের আমন্ত্রণে বিজয়ের মাস ডিসেম্বরে বাংলাদেশে এলেন এই বীরঙ্গনা কন্যা। শামা তার আবেগময় বক্তৃতাতে বলেন, আমার হৃদয় চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যায়, কেননা আমি জানি না কে আমার মা কে আমার বাবা! এই দূর দেশে বসে আমার মন উতলা হয়ে যায় দেশের জন্য, আমার হারিয়ে যাওয়া স্বজনের জন্য। আমি আমার কানাডীয় বাবা-মায়ের কাছে জেনেছিলাম আমি একজন বাংলাদেশী এবং মা এখানেই আছেন। আমার মা অসহায় ছিলেন। সে নৃশংসতার শিকার হয়েছিলেন। তার ফলেই মা আমাকে ত্যাগ করেন। যুদ্ধশিশুদের বাংলাদেশের বাইরে দত্তক নেয়ার ব্যবস্থা করার ফলে হয়তো বা আমি বেঁচে গেছি রাষ্ট্রের অবজ্ঞা থেকে। আমার জেনে গর্ব হয়েছে যে, আমার মা একজন বীরাঙ্গনা। ৪৫ বছর আগে মুক্তিযুদ্ধের প্রতি মুহূর্তে ছিল মৃত্যুর হাতছানি। তারপরও আমার মা আমাকে গর্ভে ধারণ করেছেন তখন। যদিও আমি তার আশ্রয়ে বড় হইনি, তবুও তার আশীর্বাদ আছে আমার উপর। আমার শেকড় এখানেই। অনেক দেরিতে হলেও আমি এদেশে আসতে পেরে নিজেকে গর্বিত ভাবছি।’ শামা তার কানাডীয় বাবা-মার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলেন, ‘আমরা একসঙ্গে ৯ ভাই-বোন বড় হয়েছি। এই ৯ জনের মধ্যে মাত্র একজন আমার বাবা-মায়ের নিজের সন্তান। বাকিরা আমার মতোই দত্তক নেয়া সন্তান। সত্যি বলতে কি, কখনও তারা আমাদের ভাই-বোনদের আলাদা চোখে দেখেননি। তারা আমাদেরকে সমানভাবে লালন-পালন করেছেন, যত্ন করেছেন। মানুষের মতো মানুষ করে তুলেছেন। ভাবতে অবাক লাগে, আমি যে দেশে জন্মেছি সে দেশের মানুষ আমাকে দেশে আশ্রয় দেয়নি মানবতার স্বার্থে। কিন্তু ভিন দেশের মানুষ আমাকে কতই না যত্ন সহকারে মানুষ করেছেন। তাদের জন্যই হয়তো আমি বেঁচে আছি। পৃথিবীর আলো দেখছি। আমার বাবা এখন আর বেঁচে নেই। মা আছেন। আমাকে দত্তক নেয়ার পরও তারা বাংলাদেশে অনেকবার বেড়াতে এসেছেন। মা যখন মাইক্রোফোনের সামনে নিজ জীবনের অভিজ্ঞতা তুলে ধরছে মেয়ে সাভানা নির্বাক দৃষ্টিতে মাকে দেখছে। সে খুব অল্প হলেও বাংলাদেশ সম্পর্কে তার মায়ের কাছ থেকে জেনেছে। শামার কন্যা সাভানার বয়স ১৪ বছর। সে সেভেন গ্রেডের ছাত্রী। যদিও সে মাইক্রোফোনের সামনে কোন কথা বলতে রাজি হয়নি। তবুও তার চোখে মুখে উচ্ছলতার ছাপ স্পষ্ট। সে বুঝেছে, যে দেশে সে এসেছে এটি তার মায়ের দেশ। এই দেশকে স্বাধীন করতে গিয়েই তার মায়ের মা কতটা অসহায় হয়ে নিজ সন্তানকে অন্য মানুষের হাতে তুলে দিয়েছিল। যুদ্ধশিশু বিষয়ক গবেষক মোস্তফা চৌধুরী তার অভিজ্ঞতার আলোকে শামা সম্পর্কে বলেন, ‘শামাকে আমি বাংলাদেশ সম্পর্কে বলেছি। তার মায়ের আত্মত্যাগের কথা বলেছি। এরপর থেকেই সে বাংলাদেশে আসার জন্য উতলা হয়ে উঠেছিল। আমার সঙ্গে বারবার যোগাযোগ করেছে বাংলাদেশে আসবে বলে। গত বছরে আসার কথা থাকলেও আমার জন্য সে এবছর পর্যন্ত অপেক্ষা করেছে। শামাও বাকি ১৪ যুদ্ধশিশুর ন্যায় কানাডিয়ান নাগরিক। তারা সকলেই যুদ্ধশিশু। যে শিশুদের জন্ম ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন পাকসেনাদের ধর্ষণের ফলশ্রুতিতে তাদেরকে যুদ্ধশিশু হিসেবে গ্রাহ্য করা হয়। আবার যে সব শিশু যুদ্ধকালে বাবা-মা হারিয়ে অনাথ হয়েছে তাদেরকে অনাথ অথবা যুদ্ধে অনাথ শিশু হিসেবে গণ্য করা হয়। আমি শামার বাবা-মাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম কেন তারা শামাকে দত্তক নিয়েছেন। যদি দত্তক নিতেই হতো তাহলে তো কানাডীয় বাচ্চাকেও নিতে পারতেন। তারা উত্তর দিয়েছিলেন, ‘যদি আমরা কানাডীয় কোন শিশুকে দত্তক নাও নেই অন্য কেউ নেবেন আর তারাও না নিলে সেই শিশুটি কোন চাইল্ড কেয়ার ইনস্টিটিউটে বড় হবে। কিন্তু শামাকে না নিলে সে হয়তো বাঁচতে পারত না।’ একজন যুদ্ধশিশু গবেষক হিসেবে তিনি তার অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বলেন, ‘আমি ১৫ জন যুদ্ধশিশু নিয়ে কাজ করেছি ,কারণ এ ১৫ জনের জন্মসনদ থেকে শুরু করে তাদের ভ্রমণের কাগজে এবং যে শিশুভবন থেকে তাদেরকে দত্তক নেয়া হয় সেই অনাথ আশ্রম এবং শ্রম ও কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের দলিলাদির উপর ভিত্তি করেই গবেষণা করি। বাকি যুদ্ধশিশুদের বিষয়ে ঐতিহাসিক দলিলাদি তেমন কিছুই নেই, তাই আমি শুধু এই ১৫ জন যুদ্ধশিশুর মধ্যেই আমার গবেষণা সীমাবদ্ধ রেখেছি। আমার মনে হয়, কানাডাতে বড় হয়ে তারা শিখেছে জীবনের মূল্য কিসে এবং মানুষ মানুষকে কিভাবে সম্মান করে। পক্ষান্তরে বাংলাদেশে বেড়ে উঠা অজানা যুদ্ধশিশুরা এখনও তাদের আত্মপরিচয় দেয়ার কথা ভাবতেও পারেনা। কারণ বাংলাদেশী সমাজ এখনও তাদেরকে ঘৃণা ও অবহেলার চোখে দেখে। ২০১৪ সালের আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের রায় অনুযায়ী যুদ্ধশিশু ও তাদের বীরাঙ্গনা মায়েদের সম্মান জানানো ও ক্ষতিপূরণ দেয়ার নির্দেশ থাকলেও আজ পর্যন্ত ১ টি যুদ্ধশিশুও বাইরে এসে তাদের আসল আত্মপরিচয় প্রকাশ করেনি। তার মানে তারা নিশ্চিত যে, তারা আরও বেশিভাবে অবহেলিত হবে। তারা আজও তাদের পরিচয় গোপন রেখেছে। ডাঃ নুজহাত চৌধুরী শম্পা বলেন, ‘আমার বাবা শহীদ বুদ্ধিজীবী ডাঃ আলীম চৌধুরী। আমি তার জন্যই এই স্বাধীন দেশে বেঁচে আছি একজন বাংলাদেশী নাগরিক হিসেবে। কিন্তু আমরা এখনও বীরাঙ্গনাদেরকে মেনে নিতে পারিনা। কারণ তারা যুদ্ধশিশুদেরকে জন্ম দিয়েছিলেন। আমাদের দেশের নারী ও কন্যারা এখনও অবেহেলায় বাঁচে। তাদেরকে রুখে দাঁড়াতে হবে অন্যায়ের বিরুদ্ধে। ধর্ষণের কথা চেপে রাখতে হবে এটিই আমাদের সমাজ বলে দেয়। কিন্তু না! আমাদের মুখ ফুটে অন্যায়ের প্রতিরোধ করতে হবে।
×