ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

বড়দিন বড় হওয়ার দিন

প্রকাশিত: ০৪:২৬, ২৫ ডিসেম্বর ২০১৭

বড়দিন বড় হওয়ার দিন

আজ শুভ বড়দিন, যিশু খ্রিস্টের শুভ জন্মদিন। এই দিনে আমরা পালন করি ঈশ্বরপুত্র যিশু খ্রিস্টের মানবরূপে এই পৃথিবীতে জন্মগ্রহণের এক মহোৎসব। যিশু খ্রিস্ট হলেন অদৃশ্যমান ঈশ্বরের দৃশ্যমান রূপ। সাধু আথানাসিউস বলেছেন, ‘ঈশ্বর মানুষ হলেন যাতে আমরা ঈশ্বরতুল্য হতে পারি। শারীরিকভাবে দৃশ্যমান হয়েছেন যাতে আমরা অদৃশ্য পিতা সম্বন্ধে একটা ধারণা লাভ করতে পারি।’ তিনি ঈশ্বর হয়েও মানববেশে এই পৃথিবীতে এলেন যেন আমরা তাকে দেখতে পারি, তাঁকে অনুসরণ করতে পারি, তাঁর আদর্শ বাস্তবায়িত করতে পারি। ২৫ ডিসেম্বর খ্রিস্টানদের জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ এবং আনন্দের দিন। কারণ এই দিনে ঈশ^রপুত্র যিশু খ্রিস্ট জন্মগ্রহণ করেছিলেন। বাইবেলের ভাষায় স্বর্গদূত বলেছেন, ‘আমি এক আনন্দের সংবাদ তোমাদের জানাতে এসেছি। আজ দায়ূদ নগরীতে তোমাদের ত্রাণকর্তা জন্মেছেন। তিনি সেই খ্রিস্ট, স্বয়ং প্রভু (লুক ২:১-১৪)।’ এই দিন বড়দিন কারণ এই দিনে ঈশ্বরপুত্র যিশুখ্রিস্ট আমাদের মতো আকারে-প্রকারে দেহ রক্তের মানুষ হয়ে এ জগতে এসেছিলেন। সেই সর্বশক্তিমান ঈশ্বরকে আমরা আমাদের মাঝে আপন করে, পিতারূপে, বন্ধুরূপে, মুক্তিদাতারূপে অন্তরে পাচ্ছি। ঈশ্বরকে পাওয়ার মাঝে যে আনন্দ তার চেয়ে বড় আনন্দ আর কী হতে পারে? ঈশ্বরের ভালবাসা অসীম, মহান তার করুণা ও মহান তাঁর আত্মদান। তাই বড়দিন আমাদের বড় হওয়ার ডাক দিয়ে যায়। আমরা যেন বড়দিনে যিশু খ্রিস্টের মতো বড় হতে পারি। ঈশ্বরপুত্র যিশু খ্রিস্ট মানুষ হয়ে যেমন তুচ্ছতম মানুষকে বড় করেছেন, মহান করে তুলেছেন, গৌরবান্বিত করেছেন এবং সন্তানরূপে মর্যাদা দিয়েছেন, তেমনি আমরাও যেন আমাদের ভাই-বোনদের মর্যাদা দিই, মহান করে তুলতে পারি এবং গৌরব দান করতে পারি। আমাদের হৃদয়-গোশালায় স্থান দিতে পারি এবং বরণ করে নিতে পারি। বড়দিন বিনম্রতায় বড় হওয়ার দিন বড়দিন উৎসব আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় কুমারী মারিয়ার বিনম্রতা এবং ঈশ্বরপুত্র খ্রিস্টের বিনম্রতা। কুমারী মারিয়া বিনম্রচিত্তে ঈশ্বরের আহ্বান গ্রাহ্য করেছেন। সেই সময় ইহুদী সমাজের কোন নারী কুমারী অবস্থায় গর্ভধারণ করলে তাকে পাথর ছুড়ে মারা হতো। মারিয়া তা জেনেও ঈশ্বরের ইচ্ছাকে বিনম্রচিত্তে গ্রহণ করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘আমি প্রভুর দাসী। আপনি যা বলেছেন, আমার তা-ই হোক।’ অপরদিকে ঈশ্বরপুত্র যিশু খ্রিস্ট ঈশ্বর হয়েও ঈশ্বরত্বকে আঁকড়ে না ধরে বিনম্র হয়ে, আমাদের মতো দেহ রক্তের মানুষ হয়ে সামান্য গোশালায় এবং সাধারণ নারী কুমারী মারিয়ার গর্ভে জন্ম নিলেন। তাই সাধু পল ফিলিপ্পীয়দের কাছে প্রেরিত এক পত্রে উল্লেখ করেছেন যে, ‘তিনি স্বরূপে ঈশ্বর হয়েও ঈশ্বরের সঙ্গে তাঁর সমতুল্যতাকে আঁকড়ে থাকতে চাইলেন না; বরং নিজেকে তিনি রিক্ত করলেন; দাসের স্বরূপ গ্রহণ করে তিনি মানুষের মতো হয়েই জন্ম নিলেন। আকারে-প্রকারে মানুষের মতো হয়ে তিনি নিজেকে আরও নমিত করলেন—-’ (ফিলি ২ : ৬-৮)। বড়দিন আমাদের আহ্বান জানায় আমরাও যেন কুমারী মারিয়া ও যিশু খ্রিস্টের মতো হৃদয়ে বিনম্র হতে পারি। বড়দিন কথায় ও কাজে বড় হওয়ার দিন বড়দিনের এক অনন্য আহ্বান হলো কথায় ও কাজে বড় হওয়া। কুমারী মারিয়া ও সাধু যোসেফ বাধ্যতায় বড় হয়েছেন। ঈশ্বর তাঁর পুত্র যিশুকে রাজা হেরোদের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য কুমারী মারিয়া ও যোসেফকে বেথলেহেম ছেড়ে মিসরে যেতে আদেশ দেন। তারা নীরবে সেই আদেশ পালন করেন। কোন অভিযোগ না করেই অজানা অচেনা স্থানের উদ্দেশে রওনা করেন তারা। তারা শিশু যিশুকে লালন-পালন করেন। নির্দিষ্ট দিনে শিশু যিশুকে মন্দিরে উৎসর্গ করেন, শিশুটিকে ইহুদীদের ধর্ম, নিয়ম-নীতি ও সামাজিক এবং ধর্মীয় রীতিনীতি শেখান। কুমারী মারিয়া ও যোসেফ তারা শুধু কথায়ই হ্যাঁ বলেননি, কাজেও প্রমাণ করেছেন তাদের সেই বাধ্যতা ও বিনম্রতা। তাই বড়দিন আহ্বান জানায়, আমরা যেন মারিয়া ও সাধু যোসেফের মতো কথায় ও কাজে বড় হই। যা বলি কিংবা প্রতিজ্ঞা করি, তা যেন পালন করি। বড়দিন হৃদয়ে বড় হওয়ার দিন কুমারী মারিয়া ও সাধু যোসেফের হৃদয় অনেক বড় এবং ভালবাসায় পূর্ণ ছিল। পূর্ব দেশের তিন প-িত ও রাখালদের হৃদয়ও ভালবাসায় বড়। তারা নিজের কাজ ফেলে রেখে শিশু যিশুকে দেখার জন্য ছুটে আসেন। তারা যিশুকে হৃদয়ে স্থান দিয়েছেন। বয়সে বড় হয়েও শিশু যিশুকে প্রণাম করেন, প-িত হয়েও শিশুর কাছে বিনম্র হয়েছেন। তাদের হৃদয় এত বড় না হলে কেউ এভাবে বিনম্র হতে পারেন না। আমাদের হৃদয়ও তাদের মতো বড় করতে হবে। আমাদের হৃদয়ে সাধু-পাপী, ধনী-গরিব, অসহায়, শত্রু-মিত্র সকলকেই স্থান দিতে হবে। বড়দিনে আমরা যেমন শিশু যিশুকে গ্রহণ করি, চুম্বন করি, আলিঙ্গন করি তেমনি সকল মানুষকে বুকে টেনে নিতে হবে ও আলিঙ্গন করতে হবে শ্রদ্ধার সঙ্গে, ভালবাসার সঙ্গে। বড়দিন ত্যাগে বড় হওয়ার দিন যিশু ঈশ্বরত্বকে আঁকড়ে না ধরে মানুষ হয়ে এ জগতে তাঁর স্বর্গের সিংহাসন এবং সুখের রাজ্য ত্যাগ করে নেমে এলেন। তিনি ভোগ বিলাসের জীবন ত্যাগ করে দীন বেশে গোশালায় জন্ম নিলেন। অপরদিকে কুমারী মারিয়া বিয়ের আগেই গর্ভবতী হয়েছে জেনেও সাধু যোসেফ স্বর্গদূতের আদেশে কুমারী মারিয়াকে ঘরে তুলে নিয়েছেন এবং এভাবে নিজের স্বার্থ ত্যাগ করেছেন। তবু কুমারী মারিয়া নিজের সুনাম-খ্যাতি, আরাম-আয়েশ, সুখভোগ বিসর্জন দিয়ে ঈশ্বরের ইচ্ছাকে গ্রহণ করেছেন। তিনি স্বার্থ ত্যাগ করে ঈশ^রের ইচ্ছাকে গ্রহণ করে মানুষেরই মুক্তির দ্বার খুলে দিয়েছেন। তেমনি আমাদেরও আত্মত্যাগী হতে হবে। আমাদের জন্য শিক্ষা বড়দিন আমাদের বড় হওয়ার জন্য আহ্বান জানায়। ত্যাগ, ক্ষমা, দয়া, দান ও ভালবাসায় বড় হওয়ার আহ্বান জানায়। যিশু খ্রিস্ট আর জীর্ণ গোশালায় জন্ম নেবেন না, তিনি জন্ম নেবেন প্রত্যেক মানুষের হৃদয় গোশালায়। তাই এই বড়দিনে আমাদের হৃদয়-গোশালা পবিত্রতার শুভ্র বসন দিয়ে সাজাতে হবে। এই বড়দিনে নিজেদের বদঅভ্যাস, মন্দ চিন্তা-ভাবনা ত্যাগ করে এবং পাপময় স্বভাব ত্যাগ করতে হবে। আমরা যেন যিশুর চরণে ধূপ, ধুনোর মতো মূল্যবান উপহার দিতে পারি। তাই আসুন, আমরা এই বড়দিনে বিনম্রতায়, হৃদয়ে ও ভালবাসায় বড় হওয়ার সাধনা করি। লেখক : ক্যাথলিক ধর্মযাজক পোপ ফ্রান্সিস কর্তৃক অভিষিক্ত সহকারী পাল-পুরোহিত [email protected]
×