ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বড়দিনের বাণী ॥ কেবল ধর্র্মের ডক্ট্রিন নয় প্রয়োজন মূল্যবোধের ব্যবহার

প্রকাশিত: ০৪:২৪, ২৫ ডিসেম্বর ২০১৭

বড়দিনের বাণী ॥ কেবল ধর্র্মের ডক্ট্রিন নয় প্রয়োজন মূল্যবোধের ব্যবহার

আধ্যাত্মিক তাৎপর্যের আলোকে যিশু খ্রিস্টের জন্মদিনের উৎসব ‘বড়দিন’ কেবল বিশেষ কোন দিন-তারিখের ব্যাপার নয়; তা হৃদয় ও মনের অবস্থার ব্যাপার। Benjamin Franklin-এর কথায় ‘A good conscience is a continual Christmas’ পাপের পঙ্কিলতার অন্ধকারে নিপতিত মানুষের জন্য আশা ও আলোর জীবনের পথরূপে স্রষ্টা সৃষ্টিতে এলেন। খ্রিস্ট বলেছেন, ‘যাহারা আমাকে হে প্রভু, হে প্রভু বলে, তাহারা সকলেই যে স্বর্গরাজ্যে প্রবেশ করিতে পারিবে এমন নয়, কিন্তু যে ব্যক্তি আমার স্বর্গস্থ পিতার ইচ্ছা পালন করে, সেই পাইবে’ (মথি ৭:২১)। ঈশ্বরের ইচ্ছা কি? বাইবেলের পুরাতন ও নতুন নিয়ম উভয় স্থানেই এ প্রশ্নের উত্তরে যা বলা হয়েছে তার মর্মার্থ এই- আমরা যেন আমাদের জীবনের সমস্ত কিছুতেই ঈশ্বরকে সম্মান করি এবং অন্য মানুষকে আত্মতুল্য প্রেম করি। তার অর্থ এই যে, সম্পূর্ণ নম্রতায়, ভক্তিতে অন্তর্যামী যিনি সেই ঈশ্বরকে দেহ, আত্মা, মন ও প্রাণ দিয়ে এবং অন্য সকল মানুষের মর্যাদা ও ন্যায্য অধিকারকে সম্মান করি। কিন্তু লোভ, হিংসা ও অশুভ প্রতিযোগিতার যূপকাষ্ঠে আমাদের সকল মূল্যবোধ আজ ভূ-লুণ্ঠিত। অশান্তি ও অস্থিরতার মধ্যে আমাদের দিন আসে, দিন যায়। লোভ, হিংসা ও অন্যায়-অবিচার নতুন কিছু নয়। কিন্তু আজ গোটা বিশ্বে তার মাত্রা যে বেড়েই চলছে! সবচেয়ে বড় শঙ্কা ও উৎকণ্ঠার বিষয় হচ্ছে ধর্মীয় শিক্ষার অপব্যাখ্যা ও তার অপব্যবহার, এমনকি নিষ্ঠুর জঙ্গীবাদ। মানুষের সবচেয়ে বড় পরিচয় মনুষ্যত্ব। তা দিয়েই আজ মানুষের অন্য মানুষকে বিবেচনা করা জরুরী। দীন-দরিদ্র রাখালদের কাছে সেই প্রথম বড়দিনের রাতে যিশুর জন্মবারতা জানিয়ে স্বর্গদূতেরা এই আনন্দের গান শুনিয়েছিলেন, ‘উর্ধলোকে ঈশ্বরের মহিমা, পৃথিবীতে তাঁহার প্রীতিপাত্র মনুষ্যদের মধ্যে শান্তি।’ দুঃখ-কষ্টে ভরা জীবনযুদ্ধে সর্বস্বান্ত মানুষের জন্য সেদিন স্বর্গের দূতেরা ত্রাণকর্তা খ্রিস্টের শুভ জন্মবারতা শুনালেন। বাইবেলের শিক্ষায় সমস্ত সম্পদ ও সৃষ্টির স্রষ্টা এবং একমাত্র সার্বভৌম মালিক ঈশ্বর, যিনি প্রেমময় ও ন্যায়বান। ‘পৃথিবী ও সমস্ত বস্তু সদাপ্রভুরই; জগত ও তন্নিবাসিগণ তাঁহার’ (গীতসংহিতা ২৪ : ১)। ঈশ্বর চান সকল মানুষই যেন তাঁর সম্পদ ভোগ করতে পারে ও তাঁর প্রশংসা করে। কিন্তু স্বার্থপরতা ও লোভের কারণে মানুষ নিজের এবং অন্যের জন্য দুঃখের কারণ হয়; সবল ও চতুর মানুষ অন্যের অধিকার হরণ করে; সমাজে আসে দারিদ্র্য ও বঞ্চনা। তা থেকে তৈরি হয় বিভেদ ও অশান্তি। বাইবেলের অনেক অংশজুড়েই রয়েছে ন্যায্যতার শিক্ষা। বাহ্যিক আচার-অনুষ্ঠানের চেয়ে ঈশ্বর মূল্য দেন ন্যায্যতাকে ‘ধার্মিকতা ও ন্যায়ের অনুষ্ঠান সদাপ্রভুর কাছে বলিদান অপেক্ষা গ্রাহ্য।’ তিনি চান যারা সমর্থ, সবল ও সক্ষম তারা দুঃখী, দরিদ্র ও দুর্বলের সাহায্যে এগিয়ে আসেন। খ্রিস্টধর্ম দর্শনে মানুষের জীবনের জন্য পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থা দেয়া হয়েছে। মানুষ দেহে, মনে ও আত্মায় পরিপূর্ণ এবং এক সুষম জীবন নিয়ে বেঁচে থাকবে তা-ই প্রেমময় ও ন্যায়বান ঈশ্বরের অভিপ্রায়। যাকোব তাঁর পত্রে বলেছেন, ‘ক্লেশাপন্ন পিতৃমাতৃহীনদের ও বিধবাদের তত্ত্বাবধান করা এবং সংসার হইতে আপনাকে নিষ্কলঙ্করূপে রক্ষা করাই পিতা ঈশ্বরের কাছে শুচি ও বিমল ধর্ম’ (যাকোব ১ : ২৭)। ঈশ্বর সকল নবীর মধ্য দিয়েই বলেছেন যে, প্রকৃত কৃচ্ছ্্র সাধনা ও উপবাস কেবল পানাহার থেকে বিরত থাকাই নয়; বরং তার সঙ্গে থাকা চাই ন্যায্যতার কাজ, দুর্বল-দরিদ্রের আর্থ-সামাজিক মুক্তিদান, যারা সবলের দ্বারা অত্যাচারিত ও শোষিত তাদের আর্থিক কষ্ট দূর করা। ধর্ম-কর্মের প্রকাশ হতে হবে সমাজের সমস্ত কিছুতে ন্যায়বিচারের মধ্যে। আমোষ তাই বলেছেন, ‘বিচার জলবৎ প্রবাহিত হউক; ধার্মিকতা চির প্রবহমান স্রোতের ন্যায় বহুক।’ ধার্মিকতা ও ন্যায়বিচারকে বাইবেলের অনেক জায়গায় একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠরূপে দেখানো হয়েছে। ন্যায়বিচার যেন জলের মতোই বাধাহীন হয়। মীখা নবীর মাধ্যমে ঈশ্বর বলেছেন ঈশ্বর লৌকিক ধর্মকর্মে সুখী নন। তাই বলা হয়েছে, ‘হে মনুষ্য যাহা ভাল, তাহা তিনি তোমাকে জানাইয়াছেন; বস্তুত ন্যায্য আচরণ, দয়ায় অনুরাগ ও নম্রভাবে তোমার ঈশ্বরের সহিত গমনাগমন, ইহা ব্যতিরেকে সদাপ্রভু তোমার কাছে আর কিসের অনুসন্ধান করেন?’ তাই বাইবেলে দরিদ্রদের প্রতি ধনী বা সবল লোকদের সেবা বা প্রেমের কাজ হচ্ছে মূলত ন্যায্যতা ও ঈশ্বরের প্রতি প্রেম এবং নম্রতার প্রমাণ। অত্যাচারী ও শোষকের পতন এবং তার সঙ্গে দুর্বল ও ভাগ্যাহত মানুষের মুক্তি ঈশ্বরের দৃষ্টিতে মহৎ বিষয়। দরিদ্রের পক্ষে বিচার করা খ্রিস্টধর্মের মধ্যে একটি বড় অনুশাসন। গীতসংহিতা ৮২ : ৩-৪-এ বলা হয়েছে, ‘দীনহীন ও পিতৃহীন লোকদের বিচার কর, দুঃখী ও অকিঞ্চনদের প্রতি ন্যায় ব্যবহার কর। দীনহীন ও দরিদ্রকে নিস্তার কর; দুষ্টলোকদের হস্ত হইতে তাহাদিগকে উদ্ধার কর।’ সমাজে সম্পদ ও সুযোগের ন্যায্য বণ্টনের অভাবে এক শ্রেণীর মানুষ সম্পদের পাহাড় গড়ে, অপরদিকে অধিকাংশ মানুষ দারিদ্র্যের কষাঘাতে সীমাহীন দুঃখে জীবনযাপনে বাধ্য হয়। এ সমস্যার সমাধানের জন্য ন্যায়বিচারের কোন বিকল্প নেই। যাকোবের পত্রের শিক্ষায় আমরা তাই দেখতে পাই, প্রেমময় ও ধার্মিক ঈশ্বরে আমাদের বিশ্বাসের বাহ্যিক প্রমাণ হতে হবে অকপট প্রেমের কাজে এবং সেবায়। ‘কোন ভ্রাতা কিংবা ভগ্নি বস্ত্রহীন ও দৈবসিক খাদ্যবিহীন হইলে যদি তোমাদের মধ্যে কোন ব্যক্তি তাহাদিগকে শরীরের প্রয়োজনীয় বস্ত্র না দেয়, তবে তাহাতে কি ফল দর্শিবে? তদ্রপ বিশ্বাসও কর্মবিহীন হইলে আপনি একা বলিয়া মৃত (যাকোব ২:১৫-১৭)। আমরা ধর্মের বাণী সঠিক পালন করি না বলেই পৃথিবীর বর্তমান এই হাল হয়েছে, যেখানে মাত্র ১০% মানুষ পৃথিবীর ৯০% সম্পদ ভোগ করে আর ৯০% মানুষ বাকি ১০% সম্পদ ভোগ করে। ওই ৯০% মানুষের পক্ষে ঈশ্বর কথা বলেন আমাদের বিবেকে। আমাদের ঐকান্তিক কামনা ও চেষ্টা হওয়া উচিত এমন এক সমাজ এবং পৃথিবী গড়া যেখানে প্রতিটি মানুষ মানবীয় সত্তার পরিপূর্ণ বিকাশের জন্য সুন্দর পরিবেশ ও সুযোগ পাবে, পাবে তার ন্যায্য অধিকার, হবে তার সুস্থ দেহ, মন ও অন্তর এবং সকলের জীবনেই হবে স্রষ্টার প্রশংসা। দুই হাজার বছর আগে যিশু খ্রিস্টের জন্মের সময় স্বার্থপরতা ও অহঙ্কারের কারণে গোটা মানবজাতির যে অবস্থা ছিল তা আজও আছে। মানুষের এ ভয়াবহ অবস্থা থেকে উদ্ধারের একমাত্র পথ তার হৃদয়ের পরিবর্তন। সর্বত্রই অশান্তি, হিংসা ও মূল্যবোধের যেন অপ্রতিরোধ্য অবক্ষয়। মানুষে মানুষে, ধনী-নির্ধন, সবল-দুর্বল, ক্ষমতাহীন ও ক্ষমতাপন্ন মানুষে ভেদাভেদ দিনে দিনে আকারে-প্রকারে বেড়ে চলছে। ঈশ্বর মানুষের সমূহ মুক্তির জন্য মানবরূপে খ্রিস্টের মধ্যে নিজের প্রেম, পবিত্রতা, ধার্মিকতা ও ন্যায্যতাকে প্রকাশ করলেন। মানুষের অবস্থাকে নিয়ে তিনি কেবল ভাবেননি, ঈশ্বরবিহীন মানুষের অবস্থাকে নিজে ভোগ করলেন, কারণ তিনি তার বাস্তবতাকে পরিপূর্ণরূপে উপলব্ধি করেছেন। প্রসঙ্গত এ জগতে যিশু খ্রিস্টের আগমনের মূল ঈশতাত্ত্বিক লক্ষ্য কি, আমাদের বোঝার দরকার আছে। কেন তিনি মানুষ হয়ে এলেন? এখানে খ্রিস্টীয় ঈশতথ্যবিদ্ হারম্যান বেভিংকের এই উক্তিটি আসতে পারে, ‘সমস্ত সৃষ্টিই ¯্রষ্টা ঈশ্বরের এক প্রকাশ, তাঁর গুণাবলী ও সিদ্ধতার মুকুর; প্রত্যেক প্রাণী তার নিজ অবস্থানে ও তার নিজ উপায়ে ঐশ্বরিক অভিব্যক্তির একটা প্রতিফলন। কিন্তু সমস্ত সৃষ্টির মধ্যে কেবল মানুষই ঈশ্বরের প্রতিমূর্তি, তাঁর সর্বোচ্চ ও পরিপূর্ণ প্রকাশ এবং তাই সে সমস্ত সৃষ্টির মস্তক ও মুকুট।’ আদি পুস্তকে আমরা দেখি ঈশ্বর মানুষকে তাঁর প্রতিমূর্তিতে সৃষ্টি করেছেন। নতুন নিয়মে খ্রিস্টকে বলা হয়েছে ঈশ্বরের নিখুঁত প্রতিমূর্তি, তিনি অদৃশ্য ঈশ্বরের দৃশ্যমান প্রতিমূর্তি (কলসীয় ১:৫)। সে কারণে মানুষের মধ্যে ঈশ্বরের প্রতিমূর্তি বলতে যা বোঝায় তা জানতে হলে আমাদের প্রথমে খ্রিস্টের দিকে তাকাতে হয়। মানুষের বুদ্ধি বা বিদ্যার বিচারে নয়, তার শ্রেষ্ঠত্ব হচ্ছে তার প্রেমে। অন্য গুণাবলীর সঙ্গে প্রেমই হচ্ছে ঈশ্বরের নৈতিক গুণাবলীর মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ। আমরা খ্রিস্টের মধ্যে ঈশ্বরের প্রেমের চূড়ান্ত প্রকাশ দেখতে পাই। আদি পুস্তকে আমরা জানতে পারি ঈশ্বর মানুষকে তাঁর প্রেমরূপী প্রতিমূর্তিতে নির্মাণ করেছেন। ঈশ্বরের অন্য নৈতিক গুণাবলী, যেমন- পবিত্রতা, বিবেক ও বুুদ্ধি, যুক্তি, ন্যায্যতা ইত্যাদির চেয়ে সবচেয়ে বড় হলো ‘প্রেম’। এই নৈতিক গুণাবলী হেতু মানুষ ঈশ্বরের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতে পারে। মানুষ এক আত্মিক প্রাণী। মানুষে মানুষে যদি ন্যায্যতা ও শান্তি থাকে তাহলেই স্বর্গে ঈশ্বরের গৌরব ও মহিমা হবে। অশান্ত এ পৃথিবীর মানুষ যদি যিশু খ্রিস্টের নিঃস্বার্থ প্রেম এবং জীবন সম্পর্কে তাঁর পবিত্র দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে চলতে চেষ্টা করত তাহলে পৃথিবীর অবস্থা কতই না সুন্দর ও শান্তিময় হতো! জগত আজ কেবল প্রেমহীন ভালবাসার ভাল ভাল কথায় ভরে গেছে, নিষ্ক্রিয় উৎকণ্ঠার ভারে মানুষ নুয়ে পড়ছে। কর্তব্যজ্ঞানহীন উপদেশের বোঝা আজ আর নয়। সর্বস্তরে আজ চাই কথা ও কাজের মিল। বড়দিন এসেছে আমাদের এ আহ্বান জানাতে, যেন আমরা একে অন্যের সঙ্গে শান্তি ও সমৃদ্ধ জীবনের জন্য সচেষ্ট হই, সক্রিয় হই। আমাদের এই চেতনা সকলের মধ্যেই জাগরিত হোক, হোক তা কাজে পরিণত। সনাতন ঈশ্বরের চিন্তা ও বাক্য যেমন খ্রিস্টেতে মানবাকারে মূর্ত হয়েছে, তেমনিই হোক আমাদের সকল সুন্দর কথা এবং চিন্তা জীবনে প্রকাশিত। খ্রিস্টের শিক্ষাÑ ধর্ম মানুষের জন্য, মানুষ ধর্মের জন্য নয়। বড়দিনে আমাদের কাছে খ্রিস্টের আহ্বান এই যেন আমরা ঈশ্বরের পবিত্রতা, প্রেম ও ধার্মিকতাকে বুঝতে চেষ্টা করি এবং ঐশ্বরিক মূল্যবোধে চলার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করি। ঈশ্বরকে সম্মান দেখানোর সর্বোত্তম উপায় মানুষকে, তার অধিকারকে সম্মান করা। আমি যদি কোন মানুষের ইতিবাচক পরিবর্তন করতে চাই তাহলে প্রথমে তাকে ভালবাসতে হবে। এ সত্য ঈশ^র খ্রিস্টের মধ্য দিয়ে চূড়ান্তভাবে দেখিয়েছেন। আমাদের সামগ্রিক মঙ্গল ও কুশলের জন্য প্রেমের অবতার খ্রিস্ট আমাদের মতো মানবদেহে এ জগতে এসে অকাতরে বিলিয়ে দিয়েছেন তাঁর স¦র্গীয় জীবন। ত্যাগ ও প্রেমের গুরু অমৃত পুরুষ খ্রিস্টের জীবন আমাদের জীবনকে আলোকিত করুক। করুক দীক্ষিত। লেখক : খ্রিস্টীয় ঈশতত্ত্বের শিক্ষক
×