ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মনসুর আর নুপূরের বিয়েতে বজরং দলের দৌরাত্ম্য

প্রকাশিত: ১৯:৩৫, ২৪ ডিসেম্বর ২০১৭

মনসুর আর নুপূরের বিয়েতে বজরং দলের দৌরাত্ম্য

অনলাইন ডেস্ক ॥ এখনও শামিয়ানা খোলা হয়নি। গত কাল সকালে ছিল বিয়ের অনুষ্ঠান, সন্ধ্যায় ভোজসভা। আর আজ ৩০ বছরের পাত্র কবিনগরের ছোট অবিন্যস্ত ফ্ল্যাটের বেতের চেয়ারে বসে হাউহাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বললেন— আল্লা দয়াময়! আর কারও শাদি যেন এমন ভয়ঙ্কর না হয়। সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের মনসুর হারাত খান এখন এই শিল্পশহরের বাসিন্দা। আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। এমবিএ। মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির এইচআর ম্যানেজার। তাঁর কান্না দেখে লজ্জায় মাথা হেঁট হয়ে যাচ্ছিল। যুবকটির অপরাধ, তিনি বিয়ে করেছেন ২৮ বছরের এক হিন্দু পাত্রী নুপূর সিঙ্ঘলকে। পাত্রী পেশায় মনোচিকিৎসক। গত কাল বিশেষ বিবাহ আইন অনুসারে গাজিয়াবাদ আদালতে বিয়ের রেজিস্ট্রেশন হয়েছে। সন্ধ্যায় রাজনগরে মেয়ের বাড়িতে ছিল বিয়ের রিসেপশন। প্রথমে প্রেম। তার পর দুই পরিবারের কথাবার্তা। দুই পরিবারের সম্মতি নিয়েই বিয়ে। কোথাও কোনও গোল ছিল না। কিন্তু খোঁজ রাখছিল হিন্দুত্বের স্বনিযুক্ত ঠিকাদাররা। দুপুর বারোটাতেই মেয়ের বাড়ির সামনে বিক্ষোভ শুরু হয়। বজরং দল, হিন্দু রক্ষা দল, ধর্ম জাগরণ মঞ্চ ইত্যাদি নানা গোষ্ঠীর লোকজন তাতে ছিল বলে অভিযোগ। কিন্তু ‘ফ্রিঞ্জ গ্রুপ’-এর দৌরাত্ম্য বলা যাবে না, কারণ তাদের সঙ্গে হাজির ছিলেন বিজেপির গাজিয়াবাদের শহর-সভাপতি অজয় শর্মা। অভিযোগ— ‘লাভ জিহাদ’ চলবে না। জোধা আকবর থেকে হাদিয়া— এই ইতিহাস বদলাতে হবে। এর পর টায়ার জ্বলে, শুরু হয় রাস্তা রোকো। তার পর যুবকটির বাড়ির সামনে বিক্ষোভ। পুলিশের লাঠি চার্জ। মেয়ের বাবা পুষ্পেন্দ্র সিঙ্ঘল গত কাল কবিনগর থানায় এফআইআর করেছেন। আজ পাড়া শান্ত। তবু মনসুর বললেন, ‘‘আজও বিজেপি কর্মীরা বাড়ি এসে বলে গিয়েছে, পুলিশকে দিয়ে ধর্ষণের মামলা করিয়ে দেব। পুলিশও খবরের কাগজের কাছে কথা বলতে বারণ করেছে।’’ পুষ্পেন্দ্র অবশ্য রুখে দাঁড়িয়ে বলছেন, ‘‘কীসের ভয়?’’ ১৯৫৪ সালের বিশেষ বিবাহ আইন অনুসারে মুসলিম ছেলেটি স্থানীয় বিবাহ রেজিস্ট্রারের কাছে বিয়ের অনুমতি চেয়েছিলেন। দুই পরিবারের লিখিত সম্মতি জানানো হয়েছে এক মাস আগেই। আইন অনুসারে সরকার কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে জানতে চেয়েছে, কারও কোনও আপত্তি আছে কি না? কেউ আপত্তি জানাননি। অথচ এখন এই ধুন্ধুমার! গাজিয়াবাদের দূরত্ব দিল্লি থেকে ৪০ কিলোমিটার। মোগল সম্রাটদের বনভোজনের জায়গায় এখন শপিং মল, ঝাঁ-চকচকে রিয়েল এস্টেট। এলাকার সাংসদ বিজেপির কেন্দ্রীয় মন্ত্রী তথা প্রাক্তন সেনাপ্রধান জেনারেল ভি কে সিংহ। হিন্দু জনসংখ্যা ৮০%, মুসলমান প্রায় ১৫%। খ্রিস্টানও আছেন। এই এলাকায় কমপক্ষে ১০টি ছোট-বড় গির্জায় শুরু হয়ে গিয়েছে বড়দিনের উৎসব। কবিনগরের কাছেই আছে জামা মসজিদ। কাকতালীয়, উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ আজ গায়ে-লাগানো শহর নয়ডায়। তিনি কোনও মন্তব্য করেননি। দিল্লিতে বিজেপি মুখপাত্ররা লালুপ্রসাদকে নিয়ে ব্যস্ত। কেউ কেউ ঠোঁট উল্টে বলেছেন, এমন হয়েছে? সত্যি নাকি? এ দিকে কেউ গ্রেফতার হল না। পুষ্পেন্দ্রের প্রশ্ন, বিজেপির শহর-সভাপতি গ্রেফতার হবেন না কেন? স্থানীয় পুলিশ সুপার অশোক তোমর বললেন, ‘‘দু’জনের বাড়ির বাইরে পুলিশ মোতায়েন করেছি। আজ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে।’’ পুলিশ পাত্রীপক্ষের সঙ্গে বজরং দলের নেতাদের বৈঠক করিয়েছে। বিশেষ লাভ হয়নি। যত বলা হয়েছে এ তো দুটো পরিবারের ব্যক্তিগত ব্যাপার, হিন্দুত্ব বাহিনী বলেছে— না, এ হল রাষ্ট্রবিরোধিতা। দিল্লি থেকে নয়ডা মেট্রো রেল চালু করতে প্রধানমন্ত্রী এই এলাকায় আসছেন বড়দিনে। সে দিন অটলবিহারী বাজপেয়ীর জন্মদিনও বটে। গুজরাত দাঙ্গার পরে যিনি নরেন্দ্র মোদীকে রাজধর্ম পালনের পরামর্শ দিয়ে বলেছিলেন, শাসকের কাছে জাতিধর্মের ভেদ হয় না। ফেরার সময়ে রানি ঝাঁসি মার্গের অবস্থা দেখে হাওড়ার জি টি রোডের কথা মনে পড়ছিল। কেশরীমাতার মন্দিরে সন্ধ্যারতি শুরু হয়েছে। দুধেশ্বরনাথ সিদ্ধপীঠের ঘণ্টাধ্বনি শোনা যাচ্ছে। আর এ সবের মধ্যে সদ্য-বিবাহিত আতঙ্কিত দম্পতির চোখের জলের স্মৃতি নিয়ে ফিরছি লুটিয়েন্স দিল্লিতে। মোদীর দিল্লিতে। সূত্র : আনন্দবাজার পত্রিকা
×