ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সুমন্ত গুপ্ত

অগ্রগামী অর্থনীতির একটি বছর

প্রকাশিত: ০৫:৫৩, ২৪ ডিসেম্বর ২০১৭

অগ্রগামী অর্থনীতির একটি বছর

দেখতে দেখতে আমাদের সামনে এসে উপস্থিত হয়েছে নতুন একটি বছর। অর্থনীতির পাল্লায় বছরটি কেমন গেল এই বিশ্লেষণ করতে গেলে আমরা দেখতে পাব বাংলাদেশের অর্থনীতির গতি-প্রকৃতি আসলেই বিস্ময়কর। সাফল্যের এ গল্প ধীরে ধীরে উন্মোচিত হচ্ছে। ১৯৭১ সালের যুদ্ধবিধ্বস্ত অবস্থা থেকে শুরু“করে এখন পর্যন্ত অনেকগুলো সূচকে বাংলাদেশের বড় ধরনের ইতিবাচক পরিবর্তন হয়েছে। স্বাধীনতার প্রথম কয়েক বছর লেগে গেছে অর্থনীতি ঠিক করতে। এরপর যেভাবে ধারাবাহিক প্রবৃদ্ধি হয়েছে, সেটা খুবই উৎসাহব্যঞ্জক। এখন পাকিস্তানের সঙ্গে আমাদের কোন তুলনা চলে না। কারণ, দু-একটা বাদে প্রায় সব অর্থনৈতিক ও সামাজিক সূচকেই পাকিস্তানের থেকে আমরা অনেক ভাল করেছি। আমাদের তুলনা হতে পারে ভারত, শ্রীলঙ্কা বা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্য কোন দেশের সঙ্গে। বিশ্ব গণমাধ্যম এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠান এদেশের উন্নয়নের গতিধারা দেখে বিস্মিত। অর্থনৈতিক সাময়িকী ‘দ্য ইকোনমিস্ট’ জানিয়েছে, বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় (অর্থবছর ২০১৬) ১ হাজার ৫৩৮ মার্কিন ডলার। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো অর্থবছর ২০১৭-এর তথ্য মতে, আমাদের মাথাপিছু আয় ১ হাজার ৬১০ মার্কিন ডলার। মুক্তিযুদ্ধের আগে বাংলাদেশের রফতানি ৩২% ও আমদানির ৩৭% বড় অংশই ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে। তখন দেশে রিজার্ভ ছিল না। খাদ্য ঘাটতি ছিল। মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশকে ভারত রাশিয়া সাধ্যমতো সহযোগিতা করেছে। যুদ্ববিধ্বস্ত একটি দেশে বঙ্গবন্ধুর ডাকে জাতিসংঘ, বিশ্বব্যাংক ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান ত্রাণ ও অবকাঠামোগতভাবে সহযোগিতায় এগিয়ে আসে। বড় বড় পরাশক্তির ধারণা ছিল এদেশ কখনও মাথা তুলে দাঁড়াতেই পারবে না। এখানে যত সাহায্য ঢালা হোক কোন কাজে আসবে না। দেশটিতে মহামারী, দুর্ভিক্ষ দেখা দেবে। কিন্তু ৭২ সালে দেশের বাজেট, উৎপাদন, রফতানি, জিডিপি রেকর্ডসংখ্যক হারে বাড়তে থাকে। আজ আমাদের দেশ উন্নয়নের রোল মডেল। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পরে সে ধারা ব্যাহত হয়েছে। উন্নয়ন এবং গঠনতান্ত্রিক ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ে। ১৯৭৩ সালে যে অর্থনীতির আকার ছিল মাত্র আট বিলিয়ন ডলার আজ তার আকার আড়াইশ’ বিলিয়ন। তখন সঞ্চয়ের হার ছিল ৩ শতাংশ আর আজ সেটা ৩১% তখন আমদানির পরিমাণ ছিল ৩ বিলিয়ন আর এখন ৪৭ বিলিয়ন ডলার। পুরো এক দশক ধরে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে ২০ লাখ। ২০০৯ সালে অর্থনীতির বৃত্ত ভেঙেছে। শিশু মৃত্যুর হার এখন প্রতি হাজারে ৩৫। ২০০৫ সালে তা ছিল ৬৮। মাতৃমৃত্যুর হার কমেছে। শিক্ষার হার বেড়েছে যা এখন ৭২.৩। ২০৩০ সাল নাগাদ এসডিজি পূরণ শেষে উচ্চ মধ্য আয়ের দেশে পরিণত হব। ২০৪১ সাল নাগাদ উন্নত দেশে পরিণত হওয়া। তখন মাথাপিছু আয় হবে ১৬ হাজার ৬০০ মার্কিন ডলার। অর্থনীতির কয়েকটি সূচকের ওপর সম্প্রতি চাপ সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে বন্যা ও রোহিঙ্গা ইস্যুতে মূল্যস্ফীতিতে এক ধরনের চাপ পড়েছে। চালসহ খাদ্যপণ্যের মূল্য বৃদ্ধির কারণে আগামীর দিনগুলোতে মূল্যস্ফীতির হার বৃদ্ধির সম্ভাবনা আছে। পাশাপাশি রেমিটেন্স ও রফতানি আয়ে নিম্নমুখী ও স্থবিরতা এখনও কাটেনি। আগামীতে এ উভয় খাতের প্রবৃদ্ধি না হলে অর্থনীতির ওপর বহির্খাতে চাপ আরও বাড়ার সম্ভাবনা থাকবে। বিশ্ব অর্থনীতির মন্দার কারণে অভিবাসীদের জন্য দুর্দিন চলছে এক দশক ধরে। অভিবাসীদের শ্রমবাজারও সঙ্কুচিত হয়ে পড়ছে। তার পরও বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর বিপুলসংখ্যক শ্রমিক বিদেশে যাচ্ছেন কাজের সন্ধানে। চলতি বছর এ পর্যন্ত ৯ লাখ ৮০ হাজারের বেশি কর্মী কাজের উদ্দেশ্যে বিদেশে গেছেন। বছর শেষে এ সংখ্যা ১০ লাখে পৌঁছাতে পারে বলে আশা করা হচ্ছে। বিদেশে বাংলাদেশীদের শ্রমবাজার সঙ্কুচিত না হলেও নিউইয়র্ক ও লন্ডনে দুজন বাংলাদেশী অভিবাসীর জঙ্গীসংশ্লিষ্টতা বিড়ম্বনা ডেকে এনেছে। বাংলাদেশী অভিবাসীদের ওপর বাড়ছে গোয়েন্দা নজরদারি। বিশ্বে বর্তমানে অভিবাসীর সংখ্যা ২৪ কোটি ৪০ লাখ। এর মধ্যে বাংলাদেশীর সংখ্যা ৭৫ লাখ। বিশ্বে বাংলাদেশী অভিবাসীর সংখ্যা পঞ্চম। ভারত, মেক্সিকো, রাশিয়া ও চীনের পরই বাংলাদেশী অভিবাসীদের স্থান সর্বোচ্চ। রেমিটেন্স আয়ের দিক থেকে বাংলাদেশের স্থান দশম। বৈশ্বিকভাবে রেমিটেন্স এখন সরকারী উন্নয়ন সহযোগিতার তিন গুণেরও বেশি। অভিবাসনের ফলে দক্ষতা, জ্ঞান ও প্রযুক্তি স্থানান্তরের সুযোগ সৃষ্টি করছে, তা উৎপাদন ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে। রেমিটেন্স আয় বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রাণ ভোমরার ভূমিকা পালন করছে। বিশ্ব অর্থনীতির মন্দা সত্ত্বেও বাংলাদেশের অর্থনীতি অস্তিত্ব বজায় রাখতে পেরেছে রেমিটেন্স আয়ের কারণে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে গত সেপ্টেম্বরে ৮৫ কোটি মার্কিন ডলারের রেমিটেন্স আসে। আগস্টে প্রায় ১৪২ কোটি ডলারের রেমিটেন্স আসে। এক মাসের ব্যবধানে কমেছে ৫৭ কোটি ডলার। তবে ২০১৬-১৭ অর্থবছরের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর- এ সময়ের তুলনায় চলতি অর্থবছরের একই সময়ের ৪ দশমিক ৩৭ শতাংশ বেশি আসে রেমিটেন্স। ২০১৭-১৮ অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর (প্রথম প্রান্তিক) রফতানির আয়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়নি। শুধু সেপ্টেম্বরে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কমেছে প্রায় ২৫ কোটি ডলার। অর্থাৎ ২৬ দশমিক ৭২ শতাংশ কম। একমাত্র হিমায়িত মাছ ছাড়া কোন খাতেই লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয়নি। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) হিসাব মতে, প্রথম প্রান্তিকে রফতানি আয় ৮৯১ কোটি ডলারের বিপরীতে ৮৬৬ কোটি ডলার আয় হয়েছে। তবে অভিবাসন ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান হুমকির সম্মুখীন হয়ে পড়েছে বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশীদের এক ক্ষুদ্রাংশ জঙ্গীবাদসহ নানা অপরাধপ্রবণতায় জড়িত হয়ে পড়ার কারণে। বিশেষত যুক্তরাজ্যে প্রধানমন্ত্রী তেরেসা মে’র ওপর হামলার পরিকল্পনা আঁটা এবং নিউইয়র্কে আত্মঘাতী হামলার সঙ্গে জড়িত থাকার দায়ে দুই বাংলাদেশীর গ্রেফতারের ঘটনা ভাবমূর্তির সঙ্কট সৃষ্টি করেছে। অভিবাসন ক্ষেত্রে বাংলাদেশীদের সুনাম অক্ষুণœ রাখতে অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ার বিপদ সম্পর্কে সতর্ক থাকতে হবে। বিশেষত জঙ্গীবাদ নামের যে নোংরা দৈত্য মুসলিম দেশগুলোর সুনামকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে সে সম্পর্কে সর্বাধিক সতর্কতার কোন বিকল্প নেই। রোহিঙ্গা সংক্রান্ত অপ্রত্যাশিত চাপ সৃষ্টির আগে অর্থনীতিতে বড় ধরনের আঘাত আসে দেশব্যাপী ৩২ জেলার বন্যা। এতে কৃষি খাত ও গ্রামীণ অবকাঠামোতে বড় ধরনের ক্ষতি হয়েছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের হিসাবে বন্যায় ১ লাখ ৪ হাজার ৯০০ হেক্টর কৃষি জমি পুরোপুরি ক্ষতি হয়। আংশিক ক্ষতি হয়েছে ৫ লাখ হেক্টর জমি। হাওর অঞ্চলে আগাম বন্যার কারণে ধান উৎপাদন কম হবে ৮ থেকে ১০ লাখ টন। আর পরে স্বাভাবিক বন্যায় ২০ লাখ টন উৎপাদন কম হয়েছে। সব মিলিয়ে ৩০ লাখ টন চালের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। যে কারণে বিদেশ থেকে খাদ্যশস্য আমদানি করা হচ্ছে। চলতি অর্থবছরে ১২ লাখ টন চাল আমদানির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু পরে আরও ৩ লাখ বাড়িয়ে ১৫ লাখ টন চাল আমদানির ঘোষণা দেয়া হয়। মজুদ কমে আসায় সরকারকে এবার প্রচুর চাল আমদানি করতে হবে। বেশি দামে চাল কিনে কম দামে সরবরাহ করতে হবে। শরণার্থীদের জন্য খাদ্য সরবরাহ করতে হবে। সে কারণে এবার খাদ্য খাতে মোটা অঙ্কের ভর্তুকি দিতে হতে পারে সামনের দিনগুলোতে। তাতে বাজেটের ওপর চাপ পড়বে। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, এ বছর কৃষি খাতে ৯ হাজার কোটি টাকাসহ ভর্তুকি খাতে ১৯ হাজার ৪৫৪ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। কিন্তু বছর শেষে এ ভর্তুকির পরিমাণ আরও বাড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এছাড়া বন্যায় গ্রামীণ অবকাঠামোর মধ্যে সাড়ে চার হাজার প্রতিষ্ঠান, সাড়ে ৯শ’ কালবার্ট, ৮৯০ কিমি. রাস্তা ও ১৩২ কিমি. বেড়িবাঁধ এবং ১ লাখ ৪ হাজার ঘরবাড়ি পুরোপুরি ক্ষতি হয়েছে। আর আংশিক ক্ষতি হয়েছে ৬ লাখ ৩৩ হাজার ঘরবাড়ি, ১০ হাজার ৫০০ কিমি. রাস্তা ও ৬৬৪ কিমি. বেড়িবাঁধ। পরিশেষে বলতে পাড়ি ২০৩০ সাল নাগাদ জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (এসডিজি) অর্জন এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উচ্চ আয়ের দেশ হতে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ আছে। এখন যে প্রবৃদ্ধি হচ্ছে তার সুফল সবার কাছে পৌঁছানোটাই বড় চ্যালেঞ্জ। দারিদ্র্য দূরীকরণে সাফল্য এলেও দেখা যাচ্ছে ধনী-গরিবের মধ্যে সম্পদবৈষম্য আগের চেয়ে বেড়েছে। দারিদ্র্য দূরীকরণে বর্তমানের যে গতি, সেটা ধরে রাখতে হবে, সম্ভব হলে তা আরও বাড়াতে হবে। পাশাপাশি অর্থনৈতিক উন্নতি ও প্রবৃদ্ধির সুফল সব মানুষ যাতে সমানভাবে পায়, তা নিশ্চিত করতে হবে। অর্থাৎ দেশের যে উন্নতি হচ্ছে, তার ভাগ সবাইকে দিতে হবে। এটি নিশ্চিত করতে হলে মানসম্পন্ন কর্মসংস্থান বাড়াতে হবে। মানসম্পন্ন কর্মসংস্থান বাড়াতে হলে শিল্পায়নের গতিও বাড়াতে হবে। মূল শ্রমবাজারে নারীদের অংশগ্রহণ এখনও যথেষ্ট নয়, এটি বাড়াতেও যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে।
×