ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ব্যাংকিং খাত নড়বড়ে

প্রকাশিত: ০৫:১৫, ২৪ ডিসেম্বর ২০১৭

ব্যাংকিং খাত নড়বড়ে

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ বিদায়ী বছরে এসে দেশের ব্যাংকিং খাত যেন নড়বড়ে হয়ে পড়েছে। ৪৮টি ব্যাংকের মধ্যে ১৩টির আর্থিক অবস্থা বেশ খারাপ। এসব ব্যাংকের খেলাপী ঋণ অনেক বেড়েছে। সব ব্যাংকেই যেন সুশাসনের অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। নামে-বেনামে ইচ্ছামতো অর্থ তুলে নেয়া হয়েছে। ঋণে বেড়েছে অনিয়ম। সার্বিকভাবে ব্যাংক খাতের ওপর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ ও তদারকি ব্যবস্থা আগের চেয়ে দুর্বল হয়ে পড়েছে। দেশে সরকারী-বেসরকারী-বিদেশী মিলে মোট ৫৭টি ব্যাংক রয়েছে। আর্থিক অবস্থার অবনতি হওয়া ১৩টি ব্যাংকের মধ্যে রাষ্ট্রমালিকানাধীন ও বিশেষায়িত ব্যাংক আটটি। এছাড়া বেসরকারী খাতের একাধিক ব্যাংকের মালিকানা বদল নিয়েও নজিরবিহীন ঘটনা ঘটেছে। সার্বিক পরিস্থিতিতে আমানতকারীদের মধ্যে বড় ধরনের আতঙ্ক বিরাজ করছে। রাষ্ট্রমালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে খেলাপী ঋণের পরিমাণও আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে। ফলশ্রুুতিতে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে অর্থ বরাদ্দ দিয়ে সেগুলো চালু রাখতে হচ্ছে। অন্যদিকে বিদ্যমান বেসরকারী চালু ব্যাংকগুলো যেখানে ভাল চলছে না সেখানে নতুন ব্যাংক অনুমোদনের তোড়জোড় চলছে। খেলাপী ঋণে ঘাটতিতে প্রভিশন ও মূলধন ॥ বছরের শুরু থেকে ব্যাংকিং খাতে লাগামহীনভাবে বাড়ে খেলাপী ঋণ। নিরাপত্তা সঞ্চিতি (প্রভিশন) ও মূলধন ঘাটতিতে পড়ে সরকারী-বেসরকারী কিছু ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংক খাতে ঋণ বিতরণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে সাত লাখ ৫২ হাজার ৭৩০ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপী ঋণের পরিমাণ ৮০ হাজার ৩০৭ কোটি টাকা, যা ১৬ ডিসেম্বর শেষে দাঁড়ায় ৬২ হাজার ১৭২ কোটি টাকা। অর্থাৎ নয় মাসে খেলাপী ঋণ বেড়েছে ১৮ হাজার ১৩৫ কোটি টাকা। সরকারী ও বেসরকারী খাতের সাতটি বাণিজ্যিক ব্যাংক প্রভিশন ঘাটতিতে পড়েছে। সেপ্টেম্বর শেষে এসব ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে আট হাজার ৮৭৬ কোটি টাকা। মোট ঘাটতির সিংহভাগ রাষ্ট্রায়ত্ত তিন ব্যাংকের। সবচেয়ে বেশি তিন হাজার ৪২১ কোটি টাকা ঘাটতিতে রয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত বেসিক ব্যাংকে। প্রভিশন ঘাটতির পাশাপাশি মূলধন ঘাটতিতে রয়েছে আটটি ব্যাংক। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর প্রান্তিক শেষে আট ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১৭ হাজার ৭০০ কোটি টাকা, যার মধ্যে তিনটি রাষ্ট্রীয় মালিকানার বাণিজ্যিক ব্যাংক, তিনটি রাষ্ট্রীয় মালিকানার বিশেষায়িত ব্যাংক এবং তিনটি বেসরকারী খাতের ব্যাংক রয়েছে। নতুন করে যোগ হয়েছে চতুর্থ প্রজন্মের ফারমার্স ব্যাংক। অনিয়ম হলেও শাস্তি হয় না ॥ অনিয়ম হলেও শাস্তি না হওয়ায় বাড়ছে অপকর্ম। প্রায় চার হাজার কোটি টাকার অনিয়ম-দুর্নীতির নেপথ্যে থেকেও ধরাছোঁয়ার বাইরে বেসিক ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান শেখ আবদুল হাই বাচ্চু। বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয় কেউই কোন ব্যবস্থা নিতে পারেনি তার বিরুদ্ধে। অনিয়মের অভিযোগে জিজ্ঞাসাবাদেই দায় সারছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। আর এসব কারণে আর্থিক খাতে বাড়ছে অনিয়ম-দুর্নীতি আর নানা কেলেঙ্কারি। ব্যাংকের পর্ষদ বদল ॥ বছরের শুরুতেই বেসরকারী খাতের অন্যতম ইসলামী ব্যাংকের পর্ষদে বড় ধরনের পরিবর্তন আনা হয়। গত বছরের শুরুতে বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক, চলতি বছরের জানুয়ারিতে ইসলামী ব্যাংক এবং অক্টোবরে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক (এসআইবিএল) পর্ষদে পরিবর্তন আনা হয়। ব্যাংক তিনটির শেয়ার বিক্রি করে মালিকানায় পরিবর্তন আনা হয়। পর্ষদ পরিবর্তনের পর থেকে অস্থিরতা সৃষ্টি হয় ইসলামী ব্যাংকে। এরপর থেকে ব্যাংকটির শেয়ার বিক্রি করতে শুরু করেন বিদেশী উদ্যোক্তা। ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে ব্যাংকটিতে বিদেশীদের হাতে ছিল মোট শেয়ারের ৭১ দশমিক ৬৯ শতাংশ, যা চলতি বছরের ৩০ নবেম্বর শেষে কমে দাঁড়িয়েছে ৪৪ দশমিক ৬৩ শতাংশ। বর্তমানে ব্যাংকটির আর্থিক অবস্থার অবনতি ঘটেছে। কমে গেছে আয় ও আমানতের প্রবৃদ্ধি। এদিকে চলতি বছরের ৩০ অক্টোবর ইসলামী ব্যাংকের কায়দায় পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনায় বড় পরিবর্তন আনা হয় বেসরকারী খাতের সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের (এসআইবিএল)। ব্যাংকটির চেয়ারম্যান রেজাউল হক, নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান আনিসুল হক, এমডি শহীদ হোসেনকে পদ থেকে সরিয়ে দেয়া হয়। নতুন চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আনোয়ারুল আজিম আরিফ। নতুন এমডি হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয় ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের অতিরিক্ত এমডি কাজী ওসমান আলীকে। এছাড়া নির্বাহী কমিটির নতুন চেয়ারম্যান করা হয় এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের ভাইস চেয়ারম্যান বেলাল আহমেদকে। সর্বশেষ বেসরকারী খাতের এ বি ব্যাংকের মালিকানায়ও পরিবর্তন এসেছে। এসব কারণে বেসরকারী ব্যাংকে পরিবর্তন আতঙ্ক বিরাজ করছে। এ বিষয়ে পল্লী কর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) চেয়ারম্যান কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ বলেন, নদী ও চর দখলের মতোই একের পর এক ব্যাংক দখল হচ্ছে, যার কোন বিচার নেই। ফলে তৈরি হচ্ছে অসমতা। বাড়ছে বৈষম্য। তিনি বলেন, টেকসই উন্নয়নের কথা বলা হলেও সেজন্য যে রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি দরকার তার ঘাটতি রয়েছে। ফলে বিভিন্ন খাতে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। এ অবস্থার পরিবর্তন না হলে অর্থনীতি ঝুঁকিতে পড়বে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পদক্ষেপ ॥ বছরজুড়ে ব্যাংকগুলোর পর্ষদ পরিবর্তন ও অনিয়মে প্রায় নিশ্চুপ ছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে নানা অনিয়মের ঘটনায় কিছু কার্যকর পদক্ষেপও নিয়েছে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রক এ সংস্থা। ব্যাংকের পর্ষদ পরিচালনায় ব্যর্থ হওয়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চাপে চেয়ারম্যান পদ ছাড়তে বাধ্য হন ফারমার্স ব্যাংকের চেয়ারম্যান সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর ও এনআরবিসির চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার ফরাসাত আলী। সর্বশেষ ফারমার্স ব্যাংকের এমডি একেএম শামীমকেও সরিয়ে দেয়া হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও অর্থনীতি বিশ্লেষকদের মতামতের তোয়াক্কা না করে রাজনৈতিক বিবেচনায় লাইসেন্স পাওয়া চতুর্থ প্রজন্মের নতুন নয়টি ব্যাংকের নানা অনিয়ম ও আগ্রাসী ব্যাংকিংয়ে জড়িয়ে পড়ায় এসব প্রতিষ্ঠানে বাড়ছে খেলাপী ঋণ। পরিচালকদের ঋণ ভাগাভাগিতে চলছে অসুস্থ প্রতিযোগিতা। এসব অনিয়ম, দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনায় লাভ তো দূরের কথা মূলধনই খেয়ে ফেলছেন তারা। এরপরও নতুন করে তিনটি ব্যাংক অনুমোদনের কথা বলেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গবর্নর খন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, এর আগে যখন নয়টি ব্যাংক দেয়া হয়েছিল তখন আমরা বলেছিলাম বাংলাদেশের অর্থনীতির যে আকার সেখান থেকে আর ব্যাংক দেয়া ঠিক হবে না। তারপরও শুধু রাজনৈতিক বিবেচনায় অনুমোদন দেয়া হয়। ব্যাংকগুলোর এখন নাজুক অবস্থা। তিনি বলেন, ব্যাংকিং খাতে অনিয়ম আর জালিয়াতির যে রীতি চালু হয়েছে, নতুন ব্যাংক এলে তার ক্ষেত্র আরও প্রসারিত হবে। তাই এসব প্রতিরোধে সরকারকে বেশি মনোনিবেশ করা প্রয়োজন। মালিকদের চাপে ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন ॥ মালিকদের চাপে ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এ সংশোধনী চূড়ান্ত হলে কয়েকটি পরিবারের কাছে ব্যাংকের মালিকানা চলে যাবে। কারণ, আইন সংশোধন করে ব্যাংকের পর্ষদে একই পরিবার থেকে চারজন এবং একটানা নয় বছর দায়িত্ব পালনের সুযোগ রাখা হচ্ছে। বেসরকারী ব্যাংকে এক পরিবার থেকে চারজন পরিচালক থাকলে ব্যাংকে সুশাসনের ঘাটতি দেখা দেবে বলে জানিয়েছেন সংসদ সদস্যরা। জাতীয় সংসদে আলোচনায় সংসদ সদস্য নুরুল ইসলাম মিলন বলেন, ব্যাংক খাতে এক লাখ কোটি টাকার বেশি খেলাপী ঋণ। বেশিরভাগ পরিচালক তা ভাগাভাগি করে নিয়ে গেছেন। পুরো ব্যাংক খাত জিম্মি হয়ে আছে ব্যাংকের মালিক-পরিচালকদের কাছে। স্বতন্ত্র থেকে আওয়ামী লীগে যোগ দেয়া এমপি রুস্তম আলী ফরাজী বলেন, সরকারী ব্যাংকের পরিচালকরা বিদেশে টাকা পাচার করছেন। এখন বেসরকারী ব্যাংকেও নিয়ম করা হচ্ছে যে, এক পরিবার থেকে চারজন পরিচালক হবেন। জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদ সংসদে বলেন, ব্যাংক খাতে লুটপাটের রাজত্ব কায়েম হয়েছে। বেসরকারী ব্যাংকে এক পরিবার থেকে চার পরিচালক দেয়ার নিয়ম হচ্ছে, ব্যাংকগুলোতে স্বতন্ত্র পরিচালকও নেই। এভাবে চললে ব্যাংকগুলো মুদির দোকান হয়ে যাবে। ব্যাংকিং খাতের নাজুক অবস্থার বিষয়টি স্বীকার করে সংসদে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছেন, বলা হচ্ছে এ খাতে অযথা ভর্তুকি দিচ্ছি। ব্যাংকিং খাতে কোন ধরনের বিপর্যয় হলে তা সারাদেশের অর্থনীতিকে ধ্বংস করে দিতে পারে। ব্যাংকিং খাতে যখনই কোন অসুবিধা হয় তখনই পদক্ষেপ নিয়ে থাকি আমরা।
×