ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

অপ্রাসঙ্গিক বক্তব্য প্রত্যাহার চেয়ে শীঘ্রই আবেদন করা হবে ॥ এ্যাটর্নি জেনারেল

ষোড়শ সংশোধনী বাতিল ॥ আপীলের রায় রিভিউর প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে রাষ্ট্রপক্ষ

প্রকাশিত: ০৫:০৮, ২৪ ডিসেম্বর ২০১৭

ষোড়শ সংশোধনী বাতিল ॥ আপীলের রায় রিভিউর প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে রাষ্ট্রপক্ষ

আরাফাত মুন্না ॥ উচ্চ আদালতের বিচারক অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে নেয়া সংক্রান্ত সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে আপীলের রায়ের রিভিউ (পুনর্বিবেচনা) করতে প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে রাষ্ট্রপক্ষ। চলতি সপ্তাহেই বহুল আলোচিত এই মামলায় রিভিউ আবেদন দাখিল করা হবে বলে জানিয়েছে এ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয় সূত্র। এ্যাটর্নি জেনারেল অফিস জানায়, ষোড়শ সংশোধনীর রায়টিকে দীর্ঘদিন ধরে চুলচেরা বিশ্লেষণ করে রিভিউ দায়ের করতে সব ধরনের প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছেন তারা। প্রায় ১ হাজার ৪০০ পৃষ্ঠার রিভিউ আবেদনটি বেশ কয়েকটি ভলিয়মে ভাগ করা হয়েছে। হাইকোর্টের রায় বাতিল ও রায়ের মধ্যে উল্লিখিত অপ্রাসঙ্গিক বক্তব্য প্রত্যাহার চেয়ে এই রিভিউ আবেদন দাখিল করা হবে। ষোড়শ সংশোধনীর রায় বাতিলে আইনী পদক্ষেপ হিসেবে ‘রিভিউ’ প্রস্তুতির জন্য ১১ সদস্যের একটি কমিটি করা হয়। আদালতের দৈনন্দিন কাজ শেষ করে প্রতিদিন সন্ধ্যা থেকে রাত প্রায় দশটা, এগারোটা পর্যন্ত এ কমিটি এ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয়ের লাইব্রেরিতে বসে আইনী তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ ও বিশ্লেষণসহ এ সংক্রান্ত কাজ করেছে। এ বিষয়ে এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম জনকণ্ঠকে বলেন, রিভিউ আবেদন প্রায় চূড়ান্ত হয়েছে। আশা করছি শীঘ্রই আমরা দাখিল করতে পারব। সবাইকে জানিয়েছি আলোচিত এই মামলার রিভিউ আবেদন দাখিল করা হবে বলে তিনি জানান। রিভিউ করতে আপনাদের প্রস্তুতি কেমন জানতে চাইলে এ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, নিশ্চয় প্রস্তুত, প্রস্তুত না হলে ২ মাস ধরে কাজ করেছি কেন। যে গ্রাউন্ডে রিভিউ করা হবে সেগুলো আমরা আরও বেশি করে ঘষামাজা করছি। রিভিউ কমিটিতে রয়েছেন এমন একজন জানান, পুরো রায়ে আইনের যে ব্যত্যয় ঘটেছে সেই বিষয়ে বেশি জোর দেয়া হচ্ছে। কারণ আপীল বিভাগ যে রায় দিয়েছেন তা রিভিউ চাইতে গেলে ওই বিষয়গুলোতে বেশি জোর দিতে হবে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, রায়ের সত্যায়িত কপি পাওয়ার আগেই সুপ্রীমকোর্টের ওয়েবসাইট থেকে কপি সংগ্রহ করে বিশেষ কমিটি প্রতিদিন সন্ধ্যায় আলোচনা করেছে। এতে বেশ কয়েকটি গ্রাউন্ড তারা চূড়ান্ত করেছেন যা রিভিউ আবেদনের শুনানিতে তুলে ধরবেন। এর মধ্যে বিচারকদের অপসারণে তদন্তের জন্য আইন করার আগেই ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে দেয়া, সামরিক সরকারের সময়ে করা সুপ্রীম জুডিশিয়াল কাউন্সিল ফিরে আসা, জাতীয় সংসদ সদস্যদের নিয়ে মন্তব্যসহ বিভিন্ন গ্রাউন্ড আছে। ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ের পূর্ণাঙ্গ কপি গত ১ আগস্ট প্রকাশ করে সুপ্রীমকোর্ট। ৭৯৯ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায়ের পর্যবেক্ষণে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা দেশের রাজনীতি, সামরিক শাসন, নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি, সুশাসন ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতাসহ বিভিন্ন বিষয়ে পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেন। ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী আনা হয়, যাতে বিচারক অপসারণের ক্ষমতা ফিরে পায় সংসদ। বিলটি পাসের পর ওই বছরের ২২ সেপ্টেম্বর তা গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়। সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ওই বছরের ৫ নবেম্বর হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন ৯ আইনজীবী। প্রাথমিক শুনানির পর হাইকোর্ট ২০১৪ সালের ৯ নবেম্বর রুল জারি করেন। রুলে ওই সংশোধনী কেন অসাংবিধানিক ঘোষণা করা হবে না তা জানতে চাওয়া হয়। ২০১৬ সালের ৫ মে হাইকোর্ট সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেয়। পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ হয় ওই বছরের ১১ আগস্ট। তিন বিচারকের ওই বেঞ্চের বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি কাজী রেজা-উল হক সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ বলে রায় দেন। অন্য বিচারপতি আশরাফুল কামাল তাতে ভিন্নমত জানিয়ে আলাদা রায় দেন। রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ আপীল করলে গত ৮ মে আপীল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে ওই আপীল আবেদনের শুনানি শুরু হয়। সব মিলিয়ে ১১ দিন রাষ্ট্র ও রিট আবেদনকারীর বক্তব্য শোনেন প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহাসহ সর্বোচ্চ আদালতের বিচারপতিরা। পাশাপাশি এ্যামিকাস কিউরি হিসেবে সুপ্রীমকোর্টের ১০ আইনজীবীর বক্তব্যও শোনে আপীল বিভাগ, যাদের একজন বাদে অন্য সবার কথায় হাইকোর্টের রায়ের পক্ষে অবস্থান প্রকাশ পায়। গত ২ জুলাই হাইকোর্টের রায় বহাল রেখেই রায় দেয় আপীল বিভাগ। এ রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশ পায় গত ১ আগস্ট। প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে বেঞ্চের অপর সদস্যরা হলেন বিচারপতি মোঃ আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞা, বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, বিচারপতি মোহাম্মদ ইমান আলী, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ও বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার। পূর্ণাঙ্গ অনুলিপিতে দেখা যায়, রায়ের আদেশের অংশে আপীল বিভাগের বিচারপতিরা সর্বসম্মত হলেও পর্যবেক্ষণের বিষয়ে সর্বসম্মত হতে পারেননি। ওই রায়ের পর্যবেক্ষণে প্রধান বিচারপতি অনেক অপ্রাসঙ্গিক মন্তব্য তুলে ধরেন। জাতীয় সংসদ ও নির্বাহী বিভাগের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান নিয়ে সমালোচনা করা হয় সুপ্রীমকোর্টের এই রায়ে। মামলার বিবেচ্য বিষয় নয় বলে প্রধান বিচারপতির লেখা পর্যবেক্ষণের সঙ্গে সরাসরি দ্বিমত করে রায় লিখেছেন আপীল বিভাগের ওই বেঞ্চের দুই বিচারপতি। ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে দেয়া ৭৯৯ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায়ের পর্যবেক্ষণে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা দেশের রাজনীতি, সামরিক শাসন, নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি, সুশাসন ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতাসহ বিভিন্ন বিষয়ে পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেন। সুপ্রীমকোর্টের এই রায় প্রকাশের পর প্রধান বিচারপতির লেখায় অংশ নিয়ে সরকারদলীয় নেতাকর্মীদের পাশাপশি সাধারণ জনগণের মধ্যেও ক্ষোভ প্রকাশ পায়। সাবেক প্রধান বিচারপতি ও আইন কমিশনের চেয়ারম্যান এবিএম খায়রুল হক প্রধান বিচারপতির রায়কে ভ্রমাত্মক বলেও মন্তব্য করেছেন। জাতীয় সংসদেও এ রায়ের সমালোচনা করা হয়। ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় এবং তার কিছু পর্যবেক্ষণের বিষয়ে আইনী পদক্ষেপ নিতে জাতীয় সংসদে একটি প্রস্তাবও গ্রহণ করা হয়। ওই প্রস্তাব পাসের আগে সংসদে আলোচনায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, আদালত তার এখতিয়ারের বাইরে গিয়ে সংসদে আনা সংবিধান সংশোধন বাতিলের এই রায় দিয়েছে। সংসদ ও গণতন্ত্রকে প্রশ্নবিদ্ধ করে এই রায় দেয়ার উদ্দেশ্য নিয়েও প্রশ্ন তোলেন সরকার প্রধান। রায় নিয়ে সমালোচনার মুখে প্রধান বিচারপতি সিনহা আদালতে শুনানিতে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফকে অযোগ্য ঘোষণা করে সেদেশের সুপ্রীমকোর্টের রায় দেয়ার পরের পরিস্থিতির দিকে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেছিলেন, বিচার বিভাগ যথেষ্ট ধৈর্য ধরেছে। পাকিস্তানের সঙ্গে তুলনা করায় নতুন করে সমালোচনার প্রেক্ষাপটে পরে এক অনুষ্ঠানে বক্তব্যে তিনি বলেন, তাকে মিসকোট করে প্রকাশিত বক্তব্যের কারণে তাকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয়। ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় নিয়ে তোপের মুখে থাকা প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা ছুটি নিয়ে দেশত্যাগের ২৮ দিনের মাথায় সিঙ্গাপুরে বাংলাদেশের হাইকমিশনে ১০ নবেম্বর রাষ্ট্রপতি বরাবর পদত্যাগপত্র জমা দেন। পরে রাষ্ট্রপতি এস কে সিনহার পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেন। গত ১৬ আগস্ট ডেপুটি এ্যাটর্নি জেনারেল একরামুল হক টুটুল সাংবাদিকদের জানান, রায়ের পূর্ণাঙ্গ সার্টিফায়েড কপি (সত্যায়িত) চেয়ে আবেদন করেছে রাষ্ট্রপক্ষ। এরপর গত ১০ আগস্ট সংবাদ সম্মেলন করে আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন আইনমন্ত্রী এ্যাডভোকেট আনিসুল হক। গত ১৮ আগস্ট রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন করতে সরকার প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে জানিয়েছিলেন তিনি। মন্ত্রী বলেছিলেন, রায়ের সত্যায়িত কপির জন্য আবেদন করা হয়েছে। রায় ভালভাবে পড়া হচ্ছে, পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হচ্ছে। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেই রিভিউ আবেদন করা হবে।
×