ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সেমিনারে আহ্বান

আর নয় ধ্বংস দেশের ঐতিহ্য ও স্থাপত্য নিদর্শন রক্ষা করুন

প্রকাশিত: ০৪:৪১, ২৪ ডিসেম্বর ২০১৭

আর নয় ধ্বংস দেশের ঐতিহ্য ও স্থাপত্য নিদর্শন রক্ষা করুন

স্টাফ রিপোর্টার ॥ শত বছর পূর্বে রাজধানীর খামারবাড়ির দ্বিতল ভবনে গড়ে উঠেছিল দেশের কৃষি গবেষণার প্রথম ল্যাবরেটরি। কৃষিতে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার শুরু হয় সেখান থেকেই। দেশ যে বর্তমানে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ অর্থাৎ কৃষিক্ষেত্রে যে বিপ্লব তার সূতিকাগার ছিল ভবনটি। নির্মাণশৈলীতেও অনন্য। কিন্তু হাইকোর্টে নিষেধাজ্ঞার পরও এ বিষয়ে শুনানির আগেই তড়িঘড়ি করে সম্প্রতি ধূলিসাত করে দেয়া হয়েছে ১০৮ বছরের ঐতিহ্যবাহী কৃষি গবেষণাগার। শুধু এই স্থাপনা নয় বিনোদ বিবির মন্দির, লালবাগ কেল্লাসহ রাজধানীতে আছে এরকম ৯৫টি স্থাপনা। এদেশের সুপ্রাচীন সভ্যতার ঐতিহ্য ঔপনিবেশিক আমল থেকে সংরক্ষণের অভাবে ধ্বংস বা পাচার হচ্ছে আমাদের এই মহামূল্য সম্পদ। এ বিষয়ে গৃহীত পদক্ষেপও নিতান্ত অপ্রতুল। এ অবস্থায় প্রাচীন ঐতিহ্য ও প্রত্নসম্পদ সংরক্ষণের জন্য একটি বাস্তবধর্মী নীতিমালা, টেকসই আইনী ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর মাধ্যমে জরুরী ও দীর্ঘমেয়াদী পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন বলে জানিয়েছেন দেশের বিশিষ্টজনরা। শনিবার সকালে রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে ‘স্বাধীনতা, ঐতিহ্য ও স্থাপত্য’ শীর্ষক এক গোলটেবিল আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। স্বাধীনতা, ঐতিহ্য ও স্থাপত্য শীর্ষক এ আলোচনার আয়োজন করে বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স ও বাংলাদেশ ইতিহাস সম্মিলনী। অনুষ্ঠানে বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ বাংলাদেশের ঐতিহ্য ও স্থাপত্য নিদর্শনের প্রতি আলোকপাত করেন এবং আগামীদিনের সম্ভাবনা ও সীমাবদ্ধতার আলোকে ঐতিহ্য ও স্থাপত্য সংরক্ষণে দেশের মানুষের করণীয় নিয়ে আলোচনা করেন। আলোচনায় মুখ্য উপস্থাপক ছিলেন অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন। আমন্ত্রিত অতিথিদের মধ্যে ছিলেন বরেণ্য শিল্পী হাশেম খান, সাংবাদিক স্বদেশ রায়, নাট্যকার নাসির উদ্দিন ইউসুফ, মোবাশ্বের হোসেন প্রমুখ। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন ইমেরিটাস অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন কাজী এম এ আরিফ। ‘জাতির অস্তিত্ব রক্ষায় ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও ইতিহাস রক্ষা করার আহ্বান জানিয়ে রফিকুল ইসলাম বলেন, এক সময় এদেশ ছিল মূলত কৃষিনির্ভর, তখন আমরা দোচালা ছনের, মুলিবাঁশের ঘরে বাস করতাম। প্রথম মহাযুদ্ধের সময় যখন পাটের চাহিদা বেড়ে গেল, তখন মূল বালির বস্তার দরকার ছিল, যুদ্ধের জন্য পাটের বস্তার দরকার। তখন টিনের ঘর, দোচালা, চৌচালা, আটচালা, বাংলাঘর মোগলদের শীষ মহল, ব্রিটিশদের বাংলোতে পরিণত হলো। কোথায় আমার বাংলাঘর আর কোথায় ব্রিটিশদের বাংলো। ঐতিহ্য তো এভাবেই সম্প্রসারিত হয়। ঔপনিবেশিক আমলের স্থাপনা ভেঙ্গে ফেলা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এই যে একটা কথা শুনলাম কলোনিয়াল যুগের স্থাপনা ভেঙ্গে ফেলতে হবে। কোনটা কলোনিয়াল যুগ? পাকিস্তানটা, ইংরেজ আমল? তাহলে মোগল আমল কেন নয়? মোগলরা কি এদেশের বাসিন্দা ছিল? তারা কি দিল্লী থেকে এসে আমাদের শাসন করত না, তাদের সুবেদাররা কি দিল্লী থেকে আসত এবং চলে যেত না। তারও আগে সুলতানী যুগের কথা যদি ধরি, আফগান পাঠান কি এদেশের মানুষ ছিল। তার আগে যদি তুর্কীদের কথা বলি এরা কি বাঙালী ছিল? সুতরাং কোনটাকে আমরা কলোনিয়াল যুগ বলব? তাহলে তো সব কিছু ভেঙ্গে ফেলতে হয়, কোন কিছুই থাকে না। ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, সবকিছু ভেঙ্গে ফেলে শুধু ডেভেলপারদের হাতে ছেড়ে দেন। তারা অট্টালিকা তৈরি করুক এবং ইংরেজীতে নামফলক বসিয়ে যাক। এমনকি বাংলা নাম হলেও সেটা রোমান হরফে বসিয়ে যাক। আজ এমন একটা অবস্থার আমরা সম্মুখীন হয়েছি। ১৫ বছর আগে যারা আশুলিয়া দেখেছেন, কী চমৎকার জলাশয়! আর এখন শুধু ক্যাটা পিলার, দখলদারিত্ব ও নতুন রাস্তা হয়ে গেছে। কোথায় তুরাগ, তুরাগ তো নর্দমায় পরিণত হয়েছে, বালি, বুড়িগঙ্গা? সব তো শেষ হয়ে গেল! কোন কিছুই তো আমরা রক্ষা করতে পারলাম না। এখন এসেছে কলোনিয়াল যুগের সব স্থাপনা ভেঙ্গে ফেলতে হবে। আমি জানি না কাদের উদ্ভট মস্তিষ্ক থেকে এ সব ধ্বংসাত্মক পরিকল্পনা আসে। মনে হয়, আমরা মহা ভূমিকম্পের অপেক্ষায় আছি। যে ভূমিকম্প এসে আমাদের সব ধ্বংস করে দেবে। যেমন সম্প্রতি ঘটে গেল নেপালে। দৈনিক জনকণ্ঠের নির্বাহী সম্পাদক স্বদেশ রায় বলেন, ইতিহাস সংরক্ষণে তরুণ ইতিহাসবিদ, স্থপতি ও প্ল্যানার্সদের এগিয়ে আসতে হবে। আমাদের এই শহরটাকে রক্ষা করতে হবে। অতীত, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির ধারক-বাহক হিসেবে কাজ করে বিভিন্ন সময় নির্মিত ঐতিহাসিক স্থাপনা ও নিদর্শনগুলো। কিন্তু যথাযথ সংস্কার ও সংরক্ষণের অভাবে ইতোমধ্যে আমাদের দেশের অনেক পুরাকীর্তি ও ঐতিহাসিক স্থাপনা বিলীন হয়ে গেছে। এখনও যেগুলো আছে, সেগুলোও বিলীন হওয়ার পথে। টিডিআরের (ট্রান্সফার ডেভেলপমেন্ট রাইট) এর মাধ্যমে আমরা আইন প্রয়োগ করে সহজে ওসব ভবন রক্ষা করতে পারি। তবে আশার কথা হচ্ছে, রাজধানীর প্রত্ন তাত্ত্বিক স্থাপনাগুলো সংরক্ষণে পদক্ষেপ নিতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউটের সাবেক সভাপতি আবু সাঈদ আহমেদ বলেন, সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হচ্ছে বিল্ডিংয়ের কালার নিয়ে। লাল বিল্ডিং। যেটা হচ্ছে ঔপনিবেশিক। আমাদের দেশে যত কিছু আছে ইসলামিয়াল, কলোনিয়াল, মোগল, বৌদ্ধিস- সব আমাদের দেশে এসে বাঙালী স্থাপনায় পরিণত হয়। সব কিছুতে আমাদের ম্যাটারিয়াল। বাঙালী স্থাপত্যের সুতার মতো গাঁথা এই একটা স্থাপত্য বাদ দিলে আমাদের ঐতিহ্য হারিয়ে যাবে। বাঙালীর ম্যাটারিয়াল লাল ব্রিক দিয়ে এসব তৈরি হয়েছে। ঘরে বসে তালিকা করে এটাকে ঝুঁকিপূর্ণ বলা হয়েছে। এই সব বিল্ডিং লায়ন্স দিয়ে তৈরি, সিমেন্ট নয়। লায়ন্স থেকে সিমেন্ট ঝুঁকিপূর্ণ। লায়ন্স যত পুরনো হয়, ততো টেকসই হয়। শিল্পী হাশেম খান বলেন, ‘একটি দেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্য তুলে ধরতে প্রাচীন পুরাকীর্তি ও প্রত্ন সম্পদ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অথচ দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা মসজিদ-মন্দির-প্রাসাদসহ বিভিন্ন প্রাচীন স্থাপনা সংরক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বরাবরই উদাসীন থেকেছে। এটা খুবই পীড়াদায়ক। এই নির্লিপ্ততা চলতে থাকলে অযত্ন-অবহেলা আর দখল-দুর্বৃত্তায়নের কবলে পড়ে অদূর ভবিষ্যতেই হারিয়ে যাবে কালের সাক্ষী আমাদের সমৃদ্ধ ইতিহাস ঐতিহ্যের স্মারক স্থাপনাগুলো। স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন বলেন, টিডিআর-এর মাধ্যমে আইন প্রয়োগ করে সহজে ওই ভবনগুলো রক্ষা করা যেতে পারে। কলোনিয়াল পিরিয়ডের সকল ভবন ভাঙ্গা প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশে কি কলোনিয়াল বিল্ডিং হয়েছে, না কলোনিয়াল পিরিয়ডের বিল্ডিং হয়েছে, সেটি আগে জানতে হবে। যারা এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ তাদের এ কাজে সম্পৃক্ত করতে হবে। দেশের মানুষ একতাবদ্ধ হয়ে এদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়ে মুনতাসীর মামুন বলেন, ‘এটা কিন্তু ঢাকা নয়, বাংলাদেশ ধ্বংসের পরিকল্পনা। বাংলাদেশকে ধ্বংসের হাত থেকে যদি রক্ষা করতে হয় তাহলে এই নিত্যনতুন ধ্বংসাত্মক যেসব পরিকল্পনা আসছে এগুলোকে আমাদের অবশ্যই রুখতে হবে।’ অবশ্যই সবাইকে এর বিরুদ্ধে সম্মিলিত ভাবে দাঁড়াতে হবে। দল বা মতের কথা নয়, এটা আমাদের অস্তিত্বের প্রশ্ন। আমাদের অস্তিত্ব যদি রক্ষা করতে হয়, আমাদের ঐতিহ্য রক্ষা করতে হবে। আমাদের সংস্কৃতি রক্ষা করতে হবে। আমাদের ইতিহাসকে রক্ষা করতে হবে। এবং সেই আলোকে আমাদের বর্তমান এবং ভবিষ্যত গড়ে তুলতে হবে। সরকারের কাছে প্রস্তাব তুলে ধরে অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন বলেন, দক্ষিণ এশিয়ার এই ছোট দেশটির গৌরব ও ঐতিহ্য রক্ষার প্রশ্নেই এগুলোর সংরক্ষণ জরুরী। এসব হারিয়ে গেলে, বিলুপ্ত হয়ে গেলে বাঙালীর ঐতিহ্যও শেষ হয়ে যাবে। সরকারের প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতর এই পুরাকীর্তি দেখভালের দায়িত্বে আছে, যদিও তাদের সীমাবদ্ধতা অনেক। দেশের ঐতিহ্যের উপরে শুধু সরকারের নয়, দেশের মানুষ ও বিশ্ব মানবের একটা অধিকার আছে। যে কারণে আমরা বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতাকে বিশ্ব ঐতিহ্যের অন্তর্গত করেছি, শীতল পাটিকে করেছি। সে কারণে আমরা সরকারকে বলব আমাদের স্বাধীনতা, ঐতিহ্য এবং প্রত্ন স্থাপত্য সম্পদ রক্ষায় আমরা যে উদ্যোগের কথা বলেছি সেটাতে পরিপূর্ণ সায় দেয়ার জন্য। আয়োজক তিন প্রতিষ্ঠানের প্রতি তিনি প্রস্তাব রেখে বলেন, এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের নিয়ে অবিলম্বে একটি সভা আহ্বান করা। যাতে স্বাধীনতা, ঐতিহ্য এবং প্রত্ন স্থাপত্য সম্পদ রক্ষায় আন্দোলনের রূপ দেয়া যায় কিনা। একটা হেরিটেজ কাউন্সিল গঠন করা যায় কিনা সে বিষয়েও প্রস্তাব রাখেন তিনি। তিনি বলেন, অবিলম্বে গেজেট প্রকাশ করা, নতুন যে গেজেট করা হয়েছে সেটি প্রত্যাহারের আহ্বান আমরা এই সভা থেকে করছি। ঢাকা শহর বিশেষ একটি গোষ্ঠীর অধিকারে না দিয়ে এখানে জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবি জানান। যতই ফ্লাইওভার করা হোক ঢাকা শহরের এই দুরবস্থা যাবে না। কারণ ঢাকা শহর গ্রাস করেছে চারটি ক্যান্টনমেন্ট। যেসব এলাকায় জনগণের প্রবেশাধিকার সংরক্ষিত। পুরাতন জেলখানা সংরক্ষণ, তিন শ’ ফুট রাস্তার খাল খননসহ বিভিন্ন প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগকে তিনি অভিনন্দন জানান।
×