ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সিডনির মেলব্যাগ ॥ ডামাডোলের সমাজে তালহীন তারুণ্যের ভবিষ্যত

প্রকাশিত: ০৪:১৪, ২৪ ডিসেম্বর ২০১৭

সিডনির মেলব্যাগ ॥ ডামাডোলের সমাজে তালহীন তারুণ্যের ভবিষ্যত

রংপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন নিয়ে আমরা যখন মুখরিত তখন খবরে দেখলাম এক তরুণের ফিরে আসা। আমরা যখন মেয়র নিয়ে মাতম করছি তখন ফিরে এসেছেন এক অধ্যাপক। কে, কোথায়, কেন যাচ্ছে আবার ফিরে আসছে তা কেউ জানে না। এদিকে বিএনপি তাদের নেতা ও কর্মীরা নিয়ম করে গাড়ি ভাঙচুর করছে। শিক্ষা নিয়ে উদ্বেগ আর মন্ত্রীর কথায় চলছে হৈচৈ। এই ডামাডোলে কেমন আছে তারুণ্য? আজকাল পত্রিকা খুললেই যেসব খবর দেখি তাতে মন খারাপ ছাড়া ভাল হবার কিছু থাকে না। একটা সময় ছিল যখন আমরা মানুষের মায়া আর ভালবাসার উজ্জ্বলতায় বড় হয়েছি। একথা বলি না এখন ভালবাসা নেই। এখনও ভালবাসা আছে বলেই ষোলোকোটি মানুষের দেশে কারও জন্মগ্রহণের মতো আনন্দ সংবাদ আর কিছু নেই। এখনও মানুষ সন্তান হবার আনন্দে বিভোর। মা হবার স্বপ্নে বড় হয়ে ওঠা আমাদের কন্যারা ভাবতেও পারবে না উন্নত দেশ নামে পরিচিত এই দেশগুলোতে মেয়েরা সন্তান নিতেই চায় না। আমার দেখা অস্ট্রেলিয়ার অন্যতম সেরা রাজনীতিবিদ ছিলেন কিম বিজলী নামের এক ভদ্রলোক। তখন লেবার দল গদিতে ছিল না। তিনি ছিলেন বিরোধী দলের নেতা। জনপ্রিয়তা ও বাগ্মিতায় শীর্ষে থাকা এই মানুষটি আর কোনদিনও এদেশের প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না। কারণ যখন হবার কথা তখন তিনি দুটো সাংঘাতিক বিষয়ে মুখ খুলেছিলেন। যার একটি মেধাভিত্তিক সমাজ, আরেকটি বিবাহবন্ধনের ওপর গুরুত্বারোপ। তিনি বলেছিলেন এদেশে আরও অনেক মেধার দরকার। ভারতের কাছে অঙ্ক বা কম্পিউটার, চীনের কাছে বাণিজ্য, আমেরিকার কাছে শক্তি বন্ধক দিয়ে কোন জাতি স্বাবলম্বী হতে পারে না। ব্যস! এদেশের ভোটাররা আমাদের মতো হৈচৈ করে না। ব্যানার ফেস্টুন বা মাইকিং নেই এদেশে। জনসভা? নৈব নৈব চ:। ফলে নীরব ভোটে তারা জানিয়ে দিয়েছিল তারা আয়েশী সুখের জীবন ছেড়ে অতশত পড়াশোনায় রাজি না। আর একটি কারণ, তিনি তারুণ্যকে বলেছিলেন দায়িত্ব নিতে। তাঁর মতে এই লিভ টুগেদার আর যৌনতা উপভোগের বন্ধনহীন জীবন কোন জাতিকে মজবুত করে না। বিয়ে করে সংসারী না হওয়া বা সন্তান হলে দায়দায়িত্ব না নেয়ার জন্য একা থাকা মূলত একটি উপসর্গ। তাঁর এই কথা তারুণ্যের হয়তো মনে ধরেনি। এবং তিনিও আর কোনদিন সেদেশের প্রধানমন্ত্রী হতে পারেননি। এদিক থেকে আমাদের সমাজ ও দেশ অনেক মানবিক। এখনও ফেসবুক জুড়ে বা মিডিয়ায় বিয়ের চোখ জুড়ানো ছবি আর ঘটা দেখে বোঝা যায় মেয়েদের অন্তরে সংসার কতটা প্রোথিত। ছেলেরাও চায় সুখী হতে। বাদ সাধছে কে? তার আগে বলি, আমি নিজে যেহেতু যন্ত্র ও আবিষ্কারে বিশ্বাসী তাই ঢালাওভাবে কোন সামাজিক মিডিয়াকে দোষ দেব না। কিন্তু মানতে হবে, সবাই যে বিষয়ে প্রস্তুত না সেটা হঠাৎ খুলে গেলে অসুবিধা হবেই। আকর্ষণ বিষয়টা এমন, যতটা গোপন ততটাই রঙিন। আমাদের যৌবনে, এমনকি সেদিনও ছবি দেখে পাত্রী পছন্দ করে বিয়ে হতো। ছবিতে কত দোষ কত ত্রুটি চাপা পড়ে যায় তবু মানুষ সেটাই বিশ্বাস করে জীবনসঙ্গী বেছে নিত। অথচ সে সময়কার বিয়েগুলো ছিল অটুট ও দীর্ঘমেয়াদী। এর কারণ বিবাহের পর বা বিবাহোত্তর প্রেম। কারণ প্রেমই হচ্ছে একমাত্র শক্তি যা মানুষের বন্ধনকে টিকিবে রাখে। অবাধ মেলামেশা বা বন্ধুত্ব এক বিষয় আর সেখান থেকে সবকিছু পাবার পর কাউকে জীবনসঙ্গী করে নিলে অচিরেই গাইতে হয়, ‘পুরনো জানিয়া চেয়ো না আমারে আধেক আঁখির কোণে...।’ বলছিলাম এই অবাধ অবাধ খেলায় বাংলাদেশ যতটা এগিয়ে আছে সিডনি ততটা না। আমাদের ধারণা শ্বেতাঙ্গ নারী মানেই খোলামেলা। এ যে কতবড় ভুল এদেশে না এলে আমি জানতামই না। আমার দু’গালে সহস্র চুম্বনের দাগ আছে বা স্মৃতি আছে। এর একটাতেও যদি কাম থাকতো আমাকে এদ্দিনে হয় দেশ ছাড়তে হতো নয়তো সাজা পেয়ে মুখ লুকানোর বিকল্প থাকত না। আমরা যেমন করমর্দন করি বা হাত মেলাই চুম্বন এখানে তেমনি একটি শারীরিক ভাষা। এর সঙ্গে আবেদনের কোন সম্পর্ক নেই। অথচ আমাদের কোমলমতি ছেলেমেয়েরা ভাবে চুমু মানেই মিলনের ইঙ্গিত। এই বদ বা ভুল ভাবনাগুলো ভালবাসার জায়গাকে আজ নষ্ট করে চলেছে। একটা সময় ছিল যখন আমরা কল্পনা আর বাস্তবতা মিলিয়ে প্রেমিকা নির্মাণ করতাম। সাধ্য সাধনা করে দেখা হবার মজা ছিল আলাদা। যেটুকু হতো সবটাই সলিড। এখন এত সস্তা আর এত ভুয়া যা আসল বিষয়টার মাজেজাই শেষ করে দিয়েছে। আনোয়ার উদ্দিন খান নামে একজন গায়কের বেশ কটা গান খুব জনপ্রিয় ছিল একসময়। তার একটা গানের কথা ছিল, একটি মেয়েই আমি দেখেছি সেদিন, এলোচুলে জানালায় দাঁড়িয়ে ছিল...। আজকের তারুণ্য যাকে চায় তাকে দেখে বায়বীয় জানালায়। এই বায়বীয় জানালায় কে যে মুখ রাখে আর কে দেখে কেউ জানে না। আজ যদি হয় রীতার সঙ্গে প্রেম, তো কাল আসছে সীতা। মামুম কোন মুন আর রহিম কখন রাম কেউ জানে না। এই বায়বীয় বাস্তবতা ভালবাসার আসল বিষয় ও মধুরতাকেই শেষ করে দিয়েছে। ধরুন যখন আমরা চিঠি লিখতাম, কত ধৈর্য আর কতদিন পর একেকটি চিঠির উত্তর আসত। সে স্বপ্ন আর প্রহরের ভেতরেই তারুণ্যের জীবনে আসতো কবিতা-নাটক-গান বা শিল্পবোধ। এখন যখন চটজলদি পাওয়া আর পেয়ে হারানোর রেইস বা দৌড়, সেখানে কোথা থেকে ভাল শিল্পের জন্ম হবে? যে কারণে ভালোবাসার নাম এখন দৌড় প্রতিযোগিতা। মানুষের জীবনে ভালবাসা কেবল নারী পুরুষে সীমাবদ্ধ হলে আমাদের সমাজ এতটা এগুতে পারত? যারা এদেশের জন্য প্রাণ দিয়েছিলেন তাদের ভেতর প্রচ- ভালবাসাবোধ ছিল। সামান্য একটু মারামারি দেখলে আমরা পালিয়ে ভাগি। আর এরা নিজের জীবনকে তুচ্ছ করে গুলির মুখে বুক পেতে দিয়েছিল কিভাবে? দেশের জন্য মাটির জন্য ভালবাসা ছিল বলে। আজ সে ভালবাসা কোথায়? আগামী দিনের কা-ারী হিসেবে দেশ ও সমাজের সামনে যাদের তুলে ধরা হচ্ছে তাদের কেউই দেশে থাকে না। ভালবাসার আরেকটা রূপ ছিল মায়া। এমন মায়ার সংসার ও সমাজ আর কোথাও নেই। এখনও মায়েরা সন্তানের জন্য না খেয়ে থাকেন। এখনও বাবার জুতার তলা ছিঁড়ে যায় কন্যার বিয়ের টাকা যোগাড় করতে। এমন দেশের মানুষ কি করে একজন আরেকজনকে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে গিয়ে খুন করে? কি করে পারে একটি তরুণ আরেকটি তরুণকে বেধড়ক মারতে। কি করে সম্ভব সে দৃশ্য ভিডিও করে আরও গোটাকয় সমবয়সী? এরা কি একবারও ভাবে না যে তরুণীর জন্য এতসব সে আসলে একজন মা। তার ভেতরের জননী এই দৃশ্য নিতে পারবে না? এই বোধহীন সমাজের দায় শুধু রাজনীতির ওপর চাপালে চলবে না। এর সঙ্গে আছে বিশ্বাস আর ধর্মের নামে উগ্রতার যোগ। আছে সবাই মিলে পিছে যাবার দুষ্ট কারণ। সব মিলিয়েই আমাদের সমাজে ভালবাসা এখন প্রায় উধাও। প্রায়ই দেখি সমস্যা আর সমস্যার চাপে মুখথুবড়ে পড়া মিডিয়ায় কিছু মানুষ বকছেন। কি বলছেন কেন বলছেন কেউ জানে না। আপনারা একলাখ কথা বলে একজন রোহিঙ্গাকে ফেরত নেয়াতে পারবেন? আপনাদের মুখ গোমড়া কঠিন ভাষা সুচি বা মিয়ানমার বোঝে? আপনারা মাঠে যান আমাদের তারুণ্যকে জানান তাদের দেশে এখন সমস্যার চাপ। তাদের গড়ে তুলুন যাতে নিজের দেশ ও সমাজকে ভালবাসতে জানে। সবাই মিলে তাদের কাঁধে পিঠে ভারি পুস্তকের বোঝা আর জিপিএ পাবার লোভ তুলে দিলে তারা সমাজ ও দেশকে ভালবাসবে কিভাবে? ভালবাসার বিকল্প নেই আজ। কেবল ফেব্রুয়ারি মাসের এক বিশেষ দিনে ভালবাসা হবে আর বাদবাকি সব সময় আমরা ঝগড়া কলহে থাকব? অন্তত একটি লেখা, একটি কথা, একটি কাজে প্রতিদিন আমরা যেন আমাদের দেশ, তারুণ্য ও মানুষকে ভালবাসার কথা জানাই। মনে রাখতে হবে, ভালবাসা ছাড়া দুনিয়ায় কোন বড় কাজ হয়নি। হবেও না। ভালবাসা ফিরে আসলে অনেক সমস্যা এমনিতেই কমে যাবে। তারুণ্যকে ভালবাসায় আনার জন্য বই আর শিল্পের কাছে নেয়ার কাজটি আদৌ শুরু হবে কি?
×