ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ভাগ্যের সন্ধানে বিদেশে যাচ্ছেন নারী শ্রমিক,দূর হচ্ছে অভাব

প্রকাশিত: ০৭:২৪, ২৩ ডিসেম্বর ২০১৭

ভাগ্যের সন্ধানে বিদেশে যাচ্ছেন নারী শ্রমিক,দূর হচ্ছে অভাব

জান্নাতুল মাওয়া সুইটি ॥ গাজীপুরের মেয়ে রোজিনা খাতুন (৩৫)। তিন বছর আগে ৩০ হাজার টাকা খরচ করে জর্দানে গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করতে যান তিনি। রোজিনা বর্তমানে সেখানে একটি বাড়িতে গৃহকর্মী হিসেবে নিযুক্ত আছেন। চলতি বছর তিন মাসের ছুটিতে বাংলাদেশে এসেছেন তিনি। ছুটি প্রায় শেষের দিকে। নতুন ভিসায় তিনি আবার দুই বছরের জন্য ফিরে যাচ্ছেন জর্দানে। রোজিনা জনকণ্ঠকে জানান, ‘তিন বছর আগে পাড়ি জমিয়েছি জর্দানে। সেখানকার কর্মপরিবেশ খুবই ভাল। এজন্য টিকে আছি। যে বাসায় কাজ করি সেখানকার ম্যাডাম ও স্যার খুবই ভাল মানুষ। আমিও তাদের সঙ্গেই থাকি। প্রথমে যখন নতুন একটি দেশে গেলাম তখন একটু ভয় করত। এখন সবই পরিচিত। বাসার কাজকর্ম করতে হয়। তারা আমাকে বাড়ি আসার জন্য ছুটি দিয়েছেন; এজন্যই তো আসতে পেরেছি। আমি সেখানে খুব ভাল আছি। বাড়িতে প্রতিমাসে সময়মতো টাকাও পাঠাই। স্বামী ছেড়ে যাওয়ার পর এক মেয়ে নিয়ে বিপাকে পড়ে যান রোজিনা। অবশেষে জনশক্তি রফতানিকারকদের স্থানীয় প্রতিনিধির সাহায্যে সরকারীভাবে প্রশিক্ষণ নিয়ে সার্টিফিকেট প্রাপ্তির পর জর্দানে পাড়ি জমান তিনি। তার অনুপ্রেরণায় এলাকার অন্যান্য নারীও বিদেশে যাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করেছেন বলে জানালেন রোজিনা। সংসারে আর্থিক সচ্ছলতা ফেরাতে শত প্রতিকূলতার পরও আয়েশার মতো অনেক নারীই বিদেশগামী হচ্ছেন। ১৯৯১ সাল থেকে শুরু করে ২০১৭ সালের নবেম্বর পর্যন্ত এই আড়াই দশকে বিদেশ পাড়ি দিয়েছেন ছয় লাখ ৮৭ হাজার ৮৪ নারী। যার মধ্যে এ বছরের নবেম্বর পর্যন্ত বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন এক লাখ ১৩ হাজার ৯ জন। ২০১৬ সালের নবেম্বর পর্যন্ত এ সংখ্যা ছিল ১ লাখ ৮ হাজার ৭৬৯ এবং ২০১৫ সালে ছিল এক লাখ ৩ হাজার ৭১৮ জন; যাদের অনেকেরই ভাগ্য বদলেছে। আবার অনেকেই খালি হাতে প্রাণ নিয়ে ফিরে এসেছেন। তারপরও বাংলাদেশের কর্মঠ নারী শ্রমিক তাদের ভাগ্যের সন্ধানে প্রতিদিনই বিদেশে পাড়ি দিচ্ছেন। তাদের সহযোগিতায় এগিয়ে আসছে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়সহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠান। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কর্মরত ছয় লাখ ৭৬ হাজার ৮ প্রবাসী নারীকর্মী বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিরাট অবদান রাখছেন। বিদেশে বাংলাদেশের নারীকর্মীর কাজের দক্ষতার কারণে অনেক দেশই অধিক সংখ্যক নারীকর্মী নিয়োগে আগ্রহ প্রকাশ করছে। সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) বাস্তবায়নে প্রবাসী নারীকর্মী যাতে আরও অবদান রাখতে পারেন সে লক্ষ্যে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। জনশক্তি, প্রশিক্ষণ ও কর্মসংস্থান ব্যুরোর (বিএমইটি) সাম্প্রতিক তথ্যে দেখা গেছে, চলতি বছর জানুয়ারি থেকে নবেম্বর পর্যন্ত সৌদি আরবসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এক লাখ ৯৭ হাজার ৭৮৫ নারীকর্মী গমন করেন। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক ৭৬ হাজার ৪১০ নারীকর্মী গেছেন সৌদি আরবে। এছাড়া জর্দানে গেছেন ১৯ হাজার ১২, ওমানে আট হাজার ৬৮৬ নারীকর্মী। গত বছর এক লাখ ১৮ হাজার ৮৮ নারীকর্মী বিদেশে যান। বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছয় লাখ ৭৬ হাজার ৮ নারীকর্মী কাজ করছেন। বিশেষ করে পোশাক শিল্প ও গৃহকর্মে নিয়োজিত থেকে বাংলাদেশের নারীকর্মী প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা দেশে প্রেরণ করে অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিরাট অবদান রাখছেন। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ, জাপান, রাশিয়া, মরিশাস, অস্ট্রেলিয়া, মালদ্বীপ, হংকংসহ কয়েকটি দেশে নারীকর্মী পাঠানোর উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এসব দেশ বাংলাদেশ থেকে নারী গৃহকর্মীসহ দক্ষ ও আধাদক্ষ কর্মী নেয়ার ব্যাপক আগ্রহ প্রকাশ করেছে। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক রেখা সাহা জানান, ২০১৬ সালে অভিবাসী শ্রমিকরা ১৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারেরও বেশি আয় করেছেন। জনশক্তি, প্রশিক্ষণ ও কর্মসংস্থান ব্যুরোর এক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, বিদেশে যেসব নারীগৃহকর্মী হিসেবে কাজ করতে যাবেন তাদের ন্যূনতম বেতন হবে ১৬ হাজার টাকা। ওভারটাইমসহ বেতন ২০ হাজার টাকায় দাঁড়াতে পারে। চাকরির মেয়াদ গণনা করা হবে দুই বছর। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে মোবাইলের মাধ্যমে সব সময় যোগাযোগ রাখতে পারবেন। এছাড়া বিদেশে কর্মীদের পাঠানোর আগে যে প্রশিক্ষণ দেয়া হবে তার খরচ সরকারই বহন করবে। ইতোমধ্যেই বিদেশগামী নারীর সংখ্যা অনেকটাই বেড়েছে অতীতের তুলনায়। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব নমিতা হালদার জানান, বিশ্বের বিভিন্ন দেশ বাংলাদেশের নারীকর্মী নেয়ার বিষয়ে ব্যাপক আগ্রহ প্রকাশ করেছে। ইতোমধ্যে জাপানের সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনার জন্য প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের একটি প্রতিনিধি দল জাপান সফর করেছেন। নারীকর্মী প্রেরণসংক্রান্ত বিষয়ে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি দল রাশিয়াসহ অন্যান্য দেশও সফর করছেন।
×