ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

সেই ফুটবলার রাকিব এখন হোটেলের রুম এ্যাটেনডেন্ট!

প্রকাশিত: ০৬:১৪, ২৩ ডিসেম্বর ২০১৭

সেই ফুটবলার রাকিব এখন হোটেলের রুম এ্যাটেনডেন্ট!

রুমেল খান ॥ মানুষ ভাবে এক, আর হয় আরেক। তার জীবনের চলার পথ কখনই মসৃণ নয়। প্রতিটি বাঁকেই রয়েছে বিপদ, সমস্যা আর বাধা। এই যেমন রাকিব হাসান। বিকেএসপি থেকে পাস করে বের হওয়া রাকিব একসময় ছিল একজন প্রতিভাবান ফুটবলার। বছর চারেক আগে খেলেছে বাংলাদেশ অনুর্ধ-১৬ জাতীয় ফুটবল দলে। তার যে প্রতিভা (প্লেয়িং পজিশন লেফট ব্যাক), তাতে করে অনায়াসেই সে জায়গা করে নিতে পারতো প্রিমিয়ার ফুটবল লীগের যে কোন দলে। অথচ গত তিন বছরে তার ভাগ্যটা দেখুন, ২০১৪ ও ২০১৬ সালে অনুশীলন করতে গিয়ে একই জায়গায় দু’বার ইনজুরিতে পড়ে সে (বাঁ পায়ের লিগামেন্ট ছিঁড়ে যায়)! দরিদ্র পরিবারের সন্তান হওয়াতে কোনবারই সে চিকিৎসার খরচ জোগাতে পারেনি। এক্ষেত্রে তাকে সাহায্য নিতে হয় নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ক্রীড়া অন্তঃপ্রাণ বিশিষ্ট ব্যক্তির। কিন্তু এত চেষ্টার পরও ভাগ্যদেবী সুপ্রসন্ন হয়নি তার প্রতি। যার হওয়ার কথা ছিল ফুটবলার, সে কি না এখন হোটেলের রুম এ্যাটেনডেন্ট। একেই বলে ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস। ডাক্তার পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছেনÑ পুরোপুরি ভাল হয়নি পা। যদি আবারও খেলার চেষ্টা করা হয় এবং আবারও চোট পায় তাহলে আর খেলতেই পারবে না। একেবারেই পঙ্গু হয়ে যাবে। ‘এটা শুনে তো আমার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো।’ রাকিবের হাহাকার যেন এখনও যায়নি। সে আরও জানায়, ‘তারপরও ক্ষীণ হলেও আশা আছে। ডাক্তার বলেছেন, বিদেশে গিয়ে যদি উন্নত চিকিৎসা করানো যায় তাহলে পাটা ভালমতো সারবে, এমনকি তখন ফুটবলও খেলতে পারবো। কিন্তু আমি জানি এই ভাগ্য আমার আর হবে না।’ গত ১৪ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার রাকিবের সঙ্গে দেখা হয় বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে। চট্টগ্রাম আবাহনী বনাম আরামবাগ ম্যাচটা দেখতে এসেছিল সে। খেলা দেখার ফাঁকে ফাঁকেই কথা হয় তার সঙ্গে। জানতে চেষ্টা করি তার জীবনের গতিপথ বদলে গেল কিভাবে। আগামী জানুয়ারিতে ২০ বছর পূর্ণ হবে রাকিবের। ফুটবলার হবার সুনীল স্বপ্ন জলাঞ্জলি দিয়ে ফেলেছে এই তরুণ। বনানীর একটি হোটেলের রুম এ্যাটেনডেন্ট হিসেবে চাকরি করছে গত দুই মাস ধরে। বেতন ১৪ হাজার টাকা। এখানে অবশ্য প্রমোশনের সুযোগ আছে। রাকিব জানায়, ‘আমার এই চাকরির কথা শুধু জানে মা-বাবা। বিকেএসপির কেউই জানে না। চাকরিটা পাই নাফিস আহমেদ মমিন নামের একজন এজেন্টের মাধ্যমে।’ সপ্তাহে ছয়দিন ডিউটি করে রাকিব। সময় সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত। বৃহস্পতিবার ছুটি। সেদিনও অবসর নেয়ার ফুরসত পায় না সে, ‘ওইদিন পড়াশোনা করি রাত ৭টা থেকে দেড়টা পর্যন্ত। বেশি রাত জাগতে পারি না। কারণ তাহলে সকালে ঘুম ভাঙ্গতে দেরি হলে ডিউটিতে সময়মতো যেতে পারব না।’ বাড্ডায় রহমতউল্লাহ বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্সে রাকিব ভর্তি হয়েছে সমাজবিজ্ঞান বিষয় নিয়ে। তার ইচ্ছে ছিল স্পোর্টস অব সায়েন্স নিয়ে পড়ার। কিন্তু ইচ্ছের সলিল সমাধি হয়েছে। চট্টগ্রাম আবাহনী-আরামবাগ ম্যাচ দেখতে দেখতে রাকিবের উচ্চারণ, ‘এই দুই দলের কিছু প্লেয়ার আছে, যারা আমার বিকেএসপির ক্লাসমেট। এমন আরও অনেকেই আছে যারা এখন বিপিএল ফুটবলে বিভিন্ন ক্লাবের হয়ে খেলছে। দেখে ওদের জন্য গর্ব হয়। আবার খুব কষ্টও লাগে। কারণ আমি তো খেলতে পারব না কোনদিন। জানেন, আমি এই ফুটবলার ক্লাসমেটদের সঙ্গে যোগাযোগ করাও বন্ধ করে দিয়েছি। বলতে গিয়ে চোখ দুটো ছলছল করে ওঠে রাকিবের। একটু পরেই দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, ‘এই স্টেডিয়ামে আমি ম্যাচ খেলেছি। ২০১৩ সালে সাফ অ-১৬ আসরে অংশ নেয়ার জন্য বাংলাদেশ অ-১৬ জাতীয় ফুটবল দলের হয়ে ৪টা অনুশীলন ম্যাচ খেলেছিলাম আরামবাগ ক্রীড়াচক্র (কোচ কালা ভাই), আরামবাগ ফুটবল একাডেমি (সাধারণ সম্পাদক শাহাদাত হোসেন জুবায়ের) এবং আরামবাগের আরও দুটি স্থানীয় ক্লাবের সঙ্গে।’ এরপর এএফসি অ-১৬ আসরেও খেলার কথা ছিল। কিন্তু ট্যুরই বাতিল হয়ে যায়। ভিসা সমস্যার জন্য পুরো দলেরই ভিসা বাতিল হয়ে যায়। ওই সময়ই মোহামেডানের হয়ে খেলার জন্য প্রস্তাব পেয়েছিল রাকিব। ‘খন্দকার জামিল উদ্দিন স্যার প্রস্তাব করেছিলেন। তিনি তখন মোহামেডানের পরিচালক। কথাবার্তাও এগিয়েছিল কিছুদূর ম্যানেজার আমিরুল বাবুর মাধ্যমে। কিন্তু তারপরই তো সেই সর্বনাশা ইনজুরির ছোবল।’ রাকিবের স্মৃতিচারণ। বাবা মোজাহার আলী সবজি বিক্রেতা। মা মিরিনা বেগম গৃহিণী। ৩ ভাই, ১ বোনের মধ্যে রাকিব তৃতীয়। ২০১১ সালে রাকিব ভর্তি হয় সাভারে বিকেএসপিতে। এরপর ২০১৩ সালে বগুড়া ফুটবল লীগের ১টি ম্যাচে (ফাইনাল) খেলা। অনুর্ধ-১৬ জাতীয় দলে ডাক পাওয়া ওই বছরই। সেবারই বয়সিভিত্তিক সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ খেলতে যায় নেপালে। বাংলাদেশ সেমি পর্যন্ত খেলে। সে আসরে দলের ৪ ম্যাচের ৩টিতেই খেলে রাকিব। তার পজিশন লেফট ব্যাক ও মিডফিল্ড। প্রিয় ফুটবলার দেশে আতিকুর রহমান মিশু, জাহিদ হোসেন, ওয়ালী ফয়সাল ও মামুনুল ইসলাম। বিদেশে ক্রিস্টিয়ানো রোনাল্ডো এবং মার্সেলো। বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম থেকে বিদায় নেয়ার সময় বারবার ঘাড় ফিরিয়ে ছলছল চোখে মাঠের দিকে তাকাচ্ছিল রাকিব। কি ভাবছিল সে? অঙ্কুরেই বিনাশ হয়ে গেল যে প্রতিভা, তা যেন জীবনের নির্মম-রূঢ় এক অধ্যায়, যে অধ্যায়ে না জানি আরও এ রকম কত রাকিবেরই স্বপ্ন ভেঙ্গে হয়ে গেছে চৌচির।
×