অভিমত বাংলাদেশ অ-১৫ জাতীয় মহিলা ফুটবল দলের কোচ গোলাম রব্বানী ছোটনের, সাফ অ-১৫ মহিলা চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালের আগে নিজেদের ঝালাই করে নিচ্ছে মারিয়া-মনিকা-আঁখিরা, তহুরা-সাজেদার চোট নিয়ে সংশয়
স্পোর্টস রিপোর্টার ॥ ‘লক্ষ্য ছিল ফাইনালে ওঠা। লক্ষ্য পূরণ হয়েছে। এখন ফাইনাল বাকি। নিজেদের স্বাভাবিক খেলাটা খেলে এবং দর্শকদের আনন্দ দেয়া অব্যাহত রেখে আমরা এখন ফাইনাল ম্যাচটাও জিততে চাই।’ কথাগুলো যার তিনি গোলাম রব্বানী ছোটন। সাফ অ-১৫ মহিলা চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনাল আগামী রবিবার। কমলাপুর স্টেডিয়ামে দুপুর আড়াইটায় ফাইনালে স্বাগতিক বাংলাদেশ মুখোমুখি হবে ভারতের। এ লক্ষ্যে নিজেদের অনুশীলনে ঘাম ঝরিয়ে নিজেদের ঝালাই করে নিচ্ছে ছোটনবাহিনী।
শুক্রবার সকালে বাফুফে আর্টিফিসিয়াল টার্ফে প্র্যাকটিস করে বাংলাদেশের মেয়েরা। তারপর আলাপনে ছোটনকে স্মরণ করিয়ে দেয়া হয় ফাইনালের আগে তিনটি ম্যাচে বাংলাদেশ জিতলেও প্রচুর গোলের সুযোগ নষ্ট করেছে। এ প্রসঙ্গে ছোটনের ভাষ্য, ‘হ্যাঁ, আমাদের ফিনিশিংয়ে কিছুটা সমস্যা আছে। বক্সে ঢুকে মেয়েরা তাড়াহুড়া করে, একটু বেশি ড্রিবলিং করে। এ নিয়ে কাজ করছি। আশাকরি ফাইনালে এমনটা অনেক কম হবে।’ ছোটন আরও যোগ করেন, ‘এ পর্যন্ত দল যে স্টাইলে খেলে এসেছে, ফাইনালেও সেই একই স্টাইলে খেলবে। দলও অপরিবর্তিত থাকবে।’ তবে লীগ ম্যাচে ভারতের বিপক্ষে সাজেদা খাতুন এবং ভুটানের বিরুদ্ধে তহুরা খাতুন চোট পাওয়াতে ফাইনালে তাদের খেলা নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে। ছোটন বলেন, ‘সাজেদা-তহুরা চিকিৎসকদের পর্যবেক্ষণে আছে। এখনও হাতে একদিন সময় আছে। আমরা শনিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত অপেক্ষা করব। যদি তারা ফিট না হয় তাহলেও উদ্বেগের কিছু নেই। কারণ আমাদের ভাল বিকল্প খেলোয়াড় আছে।’
লীগ ম্যাচে নেপালকে ৬-০, ভুটানতে ৩-০ এবং ভারতকে ৩-০ গোলে হারিয়েছে বাংলাদেশ। এখনও অপরাজিত থাকার পাশাপাশি একমাত্র দল হিসেবে কোন গোলও হজম করেনি তারা। তাই বলে এই কৃতিত্বে মোটেও আত্মতুষ্টিতে ভুগছেন না ছোটন, ‘আমাদের পা মাটিতেই আছে। সতর্ক আছি।’ ইতোমধ্যেই টিম মিটিংয়ে বিষয়টি নিয়ে খেলোয়াড়দের সঙ্গে কথা বলেছেন ছোটন। সবাইকে উজ্জীবিত করার চেষ্টা করেছেন।’ ফাইনালে স্টেডিয়ামে প্রচুর দর্শক সমাগম ঘটতে পারে। এতে করে মেয়েরা আবার ¯স্নায়ুচাপে ভুগবে না তো? ‘মোটেও না। মেয়েরা ফাইনালে ভাল খেলতে মুখিয়ে আছে। প্রত্যাশার চাপ তাদের ওপর নেই।’
এর আগে কোচ ছোটনের অধীনে এএফসি অনুর্ধ-১৪ বালিকা চ্যাম্পিয়ন (আঞ্চলিক) আসরে দু’বার (২০১৫ ও ২০১৬) চ্যাম্পিয়ন, একবার তৃতীয় হয়ে ফেয়ার প্লে ট্রফি লাভ (২০১৩) এবং এএফসি অনুর্ধ-১৬ আসরের (২০১৬) আঞ্চলিক বাছাইপর্বে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল বাংলাদেশ মহিলা ফুটবল দল।
এছাড়া সিনিয়র দলের কোচ হিসেবেও সফল ছোটন। তার অধীনে সাফ মহিলা চ্যাম্পিয়নশিপে একবার রৌপ্যপদক অর্জন (২০১৬), দু’বার সেমিফাইনালিস্ট (২০১০ ও ২০১৪)। এসএ গেমস ফুটবলে দু’বার তাম্রপদক (২০১০ ও ২০১৬) অর্জন করেছে বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা ফুটবল দল।
তিনটি বয়সভিত্তিক দল নিয়ে কাজ করেছেন ছোটন? সেরা দল কোনটি? একটু ভেবে ছোটনের উত্তর, ‘এ পর্যন্ত এজ লেভেলে যে তিনটি দল নিয়ে কাজ করেছি, সেগুলোর মধ্যে বর্তমান অ-১৫ দলটাকেই বেশি ভাল মনে হচ্ছে। কারণ এই দলের খেলোয়াড়দের স্কিল, ফিটনেস, স্ট্যামিনা, এটিচ্যুড, স্কোরিং এ্যাবিলিট খুবই প্রশংসনীয়।’
বলা হয়ে থাকে ফুটবলে অধিনায়ক কেবল নামেই অধিনায়ক, আসলে তিনি খেটে খাওয়া শ্রমিক ছাড়া কিছুই নন। আসল অধিনায়ক যদি কাউকে বলতে হয় তাহলে তিনি হচ্ছেন কোচ। তার দিক-নির্দেশনায়, পরিচালনায়-পরিকল্পনায় দলের জয় বা ড্র নির্ধারিত হয়। ফুটবল দলকে যদি একটা জাহাজের সঙ্গে তুলনা করা হয তাহলে নিঃসন্দেহে সে জাহাজের ক্যাপ্টেন হচ্ছেন কোচ। শিপ ক্যাপ্টেন এবং ফুটবল কোচের মধ্যে আরেকটি মিল আছে। জাহাজডুবি হলে দায়ী করা হয় ক্যাপ্টেনকে।
কোচ গোলাম রব্বানী ছোটন। তাকে অনায়াসেই অভিহিত করা যায় বাংলাদেশ মহিলা ফুটবলের ‘ইতিহাস সৃষ্টিকারী কোচ’ হিসেবে। নিজে একসময় ছিলেন কৃতী ফুটবলার। ১৯৮৮-২০০২ পর্যন্ত খেলেছেন আরামবাগ, ফকিরেরপুল, ওয়ারী ও বিআরটিসির হয়ে। অধিনায়কত্বও করেছেন প্রতিটি দলেরই। মজার ব্যাপার খেলোয়াড়ী জীবন চলাকালেই কোচিং ক্যারিয়ার শুরু করেন তিনি। গল্পটা এরকম ১৯৯৩ সালে যখন ওয়ারীর হয়ে খেলতেন তখন থাকতেন মতিঝিলের টিএ্যান্ডটি কলোনিতে। সেখানকার টিএ্যান্ডটি ক্লাব সেবার প্রথমবারের মতো অংশ নেয় পাইওনিয়ার ফুটবলে। কলোনির মুরুব্বী ও বড় ভাইয়েরা চেপে ধরলেন, এলাকার ক্লাবটির কোচ হতেই হবে ছোটনকে। কি আর করা, অনুরোধে ঢেঁকি গিলতেই হলো। কোচিংয়ের কোন পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই, অথচ ছোটনের অধীনে সে বছর টিএ্যান্ডটি ক্লাব পাইওনিয়ার লীগে চ্যাম্পিয়ন হয়। সেই থেকে শুরু। তারপর ১৯৯৬ সালে টিএ্যান্ডটি ক্লাবকে তিনি শিরোপা পাইয়ে দেন তৃতীয় বিভাগ ফুটবলেও। ২০০৬ সালে বাফুফেতে কোচ হিসেবে চাকরি হয় তার। ২০০৮ সালে মারদেকা কাপে জাতীয় ফুটবল দলের সহকারী কোচের দায়িত্ব পালন করেন। ২০১০ এসএ গেমসে তাম্রপদক জেতা বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা দলেরও সহকারী কোচ ছিলেন ছোটন। মেয়েদের বয়সভিত্তিক দলগুলোর কোচ হিসেবে আছেন ২০০৯ সাল থেকে। এখন দেখার বিষয়, মেয়েদের বয়সভিত্তিক ফুটবলে চতুর্থ সাফল্য অর্জন করে দ্রোণাচার্য ছোটন আরেকবার মেতে উঠতে পারেন কি না বিজয়ের উল্লাসে।