ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

রংপুরে নৌকার পরাজয় হয়নি, হয়েছে ব্যক্তি ঝন্টুর

প্রকাশিত: ০৪:৫৯, ২৩ ডিসেম্বর ২০১৭

রংপুরে নৌকার পরাজয় হয়নি, হয়েছে ব্যক্তি ঝন্টুর

শাহীন রহমান/আবদুর রউফ সরকার ॥ কি বার্তা দিয়ে গেল রংপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন। নির্বাচনের জয়পরাজয় নিয়ে চলছে নানা হিসাব-নিকাশ। বিশেষ করে আওয়ামী লীগের প্রার্থী সরফুদ্দিন আহমেদ ঝন্টুর পরাজয় নিয়েই বেশি আলোচনা সমালোচন চলছে। তার এ পরাজয়কে অনেকেই জাতীয় পর্যায়ে আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তার মাপকাঠিতে বিচার করতে ছাড়ছে না। তবে ফল বিশ্লেষণে ভিন্ন পর্যবেক্ষণ উঠেছে এসে। মেয়র পদে আওয়ামী লীগের প্রার্থী পরাজিত হলেও কাউন্সিলর পদে আওয়ামী লীগের প্রার্থী সর্বোচ্চ ১৫টিতে জিতেছে। সেখানে জাতীয় পার্টি জিতেছে মাত্র ৮টিতে। স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা প্রার্থী বাছাইয়ে ভুলকে রংপুরে পরাজয়ের কারণ হিসেবে দেখছেন। তবে রংপুর সিটি নির্বাচনের তুলনামূলক বিশ্লেষণে দেখা গেছে দলীয় ইমেজের পাশাপাশি ব্যক্তি ইমেজও ভোট পাওয়ার ক্ষেত্রে বড় বিষয় হিসেবে কাজ করেছে। রংপুরে জাতীয় পার্টির ভোট ব্যাংক হিসেবে এমনিতেই মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফার পাল্লা আগে থেকেই ভারী ছিল। তাছাড়া তার ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তাও বেশ। এলাকার মানুষের কাছে একজন ভদ্র মানুষ হিসেবেই অধিক পরিচিত। গত বারের নির্বাচনে প্রায় ৮০ হাজার ভোট পেয়ে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে তুলেছিলেন। পরাজিত হওয়ার বেদনা থেকেও এবার ভোটাররাও তার দিকেই বেশি ঝুকেছে। দলীয় প্রভাবের দিক দিয়ে তিনি সব সময় এগিয়ে ছিলেন। অপরদিকে সরফুদ্দিন আহমেদ ঝন্টু ছিলেন এ সিটির সদ্য সাবেক মেয়র। দায়িত্ব পালনকালে তার বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ উঠেছে। এছাড়া সিটিং মেয়র হিসেবে স্বভাবতই জনপ্রিয়তার কিছুটা ঘাটতি থাকে যা ঝন্টুর ক্ষেত্রে হয়েছে। ঝন্টুর বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় যে ফ্যাক্টর কাজ করেছে তা হলো তার আচার ব্যবহার। দলীয় নেতাকর্মী যারাই তার সঙ্গে মিশেছেন তারাই ঝন্টুর প্রতি বিরাগভাজন হয়েছেন। তাকে একরোখা স্বভাবের লোক বলেও চিহ্নিত করেছেন। যার বহিঃপ্রকাশ নির্বাচনের মাধ্যমে ঘটেছে। ভোটার এবং আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাকর্মীরা আগে থেকেই সরফুদ্দিন আহমেদ ঝন্টুর পরাজয়ের যথেষ্ট আশঙ্কা করছিলেন। তবে তাদের মতে এমন শোচনীয় পরাজয় প্রত্যাশিত ছিল না। এ পরাজয় নৌকার হয়নি। হয়েছে ব্যক্তি ঝন্টুর। তারা মনে করেন রংপুর জাতীয় পার্টি অধ্যুষিত এলাকা হলেও আওয়ামী লীগের অবস্থানও এখানে যথেষ্ট ভাল। জনগণের সঙ্গে ঝন্টুর দূরত্ব, গতবারের অধিকাংশ নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পূরণ না করা, দলীয় নেতা-কর্মীদের মূল্যায়ন না করা, দলীয় কর্মকা-ে অংশ গ্রহণ না করা, মানুষের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করা ইত্যাদি কারণে সাবেক মেয়র ঝন্টুর ওপর অসন্তুষ্ট ছিলেন সিটিবাসী এবং আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা। এ কারণগুলো তাঁর পরাজয়ের অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি আতাউজ্জামান বাবু বলেন, আওয়ামী লীগের ইমেজ ব্যবহার করে গত নির্বাচনে ঝন্টু মেয়র হয়েছিলেন। কিন্তু মেয়র হওয়ার পর থেকে তিনি দলের সঙ্গে সম্পর্ক রাখেন নি। দলীয় কর্মসূচীতে তেমন একটা অংশ নেন নি। দলীয় নেতা-কর্মীদের সঙ্গে তার তেমন সম্পর্ক ছিলনা। জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এ্যাডভোকেট আনারুল ইসলাম মনে করেন, ‘নির্বাচনকে নিয়ে দল আর প্রার্থীর মধ্যে সমন্বয়ের অভাব ছিল। তাছাড়া সিটি এলাকার ভোটার আর সাধারণ মানুষের সঙ্গে প্রার্থীর যে সম্পর্ক থাকা প্রয়োজন, তা ছিল না। এগুলোই আসলে এই নির্বাচনে তার (ঝন্টু) পরাজয়ের প্রধান কারণ। বিগত সময়ের উপজেলা, পৌরসভা এবং ইউনিয়ন পরিষদের ফল বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে রংপুরে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরাই বেশি সাফল্য পেয়েছেন। জাতীয় পার্টির ভোট ব্যাংক থাকলেও এই জেলায় তারা এসব নির্বাচনে ভরাডুবির শিকার হয়েছে। মেয়র নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর ভরাডুবি হলেও কাউন্সিলর পদে জনগণ ঠিকই আওয়ামী লীগের প্রার্থীকেই বেদে নিয়েছে। অপরদিকে ভোটের হিসাব-নিকাশে এই জেলায় বিএনপির আগে যে অবস্থা ছিল বর্তমানেও প্রায় তাই রয়েছে। অনেকে মনে করছেন এবারে প্রার্থী বাছাইয়ে ভুলের কারণেই আওয়ামী লীগের এই পরাজয়। অপরদিকে জাতীয় পার্টির দলীয় ইমেজের পাশাপাশি এলাকার জনগণের কাছে প্রার্থীর অসম্ভব জনপ্রিয়তা ভোটের এই ব্যবধান গড়ে দিয়েছে। অনেকেই মনে করছেন রংপুরে ঝন্টু প্রভাবশালী হলেও কেন্দ্রে তার কোন প্রভাব নেই। এ কারণে দলের অনেকেই তার প্রতি শক্ত অবস্থান নেননি। অনেকেই মনে করেন এবার ঝন্টুকে প্রার্থী দেয়া ঠিক হয়নি। তাই ওপরে সবাই ঝন্টুর পক্ষে কাজ করলেও নির্বাচনী প্রচারে গা ছাড়া ভাব লক্ষ্য করা গেছে। দলীয় নেতাকর্মীরা শক্ত অবস্থান না নেয়ায় সাধারণ মানুষ প্রার্থীর কারণে নৌকা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন বলেও মনে করেন। নির্বাচনী ফল বিশ্লেষণে দেখা গেছে আওয়ামী লীগের ভোট আগের তুলনায় অনেক কমেছে। প্রথমবার আওয়ামী লীগের সমর্থন নিয়ে ঝন্টু ভোট পেয়েছিলেন এক লাখ ৬ হাজারের কিছু বেশি। সেখানে এবার কমেছে প্রায় ৪৪ হাজার। এত ভোট কমে যওয়ার কারণেই এই নির্বাচন নিয়ে শুরু হয়েছে নানা বিশ্লেষণ। কেউ একে জাতীয় পর্যায়ের ভোটের সঙ্গে তুলনা করেছেন। কিন্তু ফল বিশ্লেষণে দেখা গেছে কাউন্সিলর পদে ৩৩টির মধ্যে আওয়ামী লীগ প্রার্থী সবচেয়ে বেশি ১৫টিতে জয়লাভ করেছেন। অপরদিকে জাতীয় পার্টির প্রার্থীরা কাউন্সিলর পদে জিতেছেন মাত্র ৮টিতে। এক্ষেত্রে জাতীয় পার্টির পাশাপাশি অবস্থানেই রয়েছে বিএনপি। কাউন্সিলর পদে বিএনপি পেয়েছে ৬টি। বিভিন্ন মহল থেকে এ নির্বাচনের ফলকে জাতীয় নির্বাচনের সঙ্গে তুলনা করা হলেও আওয়মী লীগ একে গণতন্ত্রের এবং রাজনৈতিক বিজয় হিসেবে চিহ্নিত করছে। বিশেষ করে এই নির্বাচন প্রমাণ করছে জাতীয় সংসদ নির্বাচনও অবাধ ও সুষ্ঠু করা সম্ভব। তাই আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মন্তব্য করেছেন রংপুর সিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক বিজয় হয়েছে। নির্বাচনের ফলকে গণতন্ত্রের বিজয় হিসেবে উল্লেখ করেছেন তিনি। তবে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে রংপুর সিটি নির্বাচনকে আঞ্চলিক নির্বাচন হিসেবেই দেখা হচ্ছে। তারা মনে করছে এই নির্বাচনের সঙ্গে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কোন সম্পর্ক নেই। এই নির্বাচনের প্রভাব জাতীয় নির্বাচনেও পড়বে না বলে মনে করছে তারা। আওয়ামী লীগের অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত শুক্রবার সিলেটের এক অনুষ্ঠানে মন্তব্য করেছেন রংপুর সিটি নির্বাচনে জাতীয় পার্টির প্রার্থীর কাছে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর পরাজয়ের প্রভাব জাতীয় নির্বাচনে পড়বে না। তিনি বলেন স্থানীয় সরকার নির্বাচনের সঙ্গে সংসদ নির্বাচনের কোন সম্পর্ক নেই। এছড়াও তিনি উল্লেখ করেন রংপুরে জাতীয় পার্টি খুবই জনপ্রিয়। এদিকে প্রথম থেকেই রংপুর সিটি নির্বাচন নিয়ে বিএনপি সোচ্চার থাকলেও নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী কাওসার জামান বাবলা কোন প্রতিদ্বন্দ্বিতাই গড়ে তুলতে পারেননি। আগের নির্বাচনেও বিএনপি প্রার্থীর প্রাপ্ত ভোট ছিল প্রতিদ্বন্দ্বিতার অনেক বাইরে। দুই নির্বাচনে তুলনামুলক বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে ভোটের হিসাবে রংপুরে বিএনপির আগেও তেমন অবস্থান ছিল না। এবারেও নেই। জাতীয় পার্টির প্রার্থী যেখানে ভোট পেয়েছে ১ লাখ ৬০ হাজারের উপরে সেখানে বিএনপি প্রার্থী মাত্র ৩৫ হাজার ভোট পেয়েছেন। এবারে ভোট আগের তুলনায় বাড়লেও উল্লেখ করার মতো কিছু নয়। তাদের প্রার্থীর প্রাপ্ত ভোট প্রতিদ্বন্দ্বিতার অনেক বাইরে। নির্বাচন স্মরণকালের অবাধ সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ হলেও বিএনপি তা মানতে নারাজ। বৃহস্পতিবার নির্বাচন নিয়ে কয়েক দফায় দলের পক্ষ থেকে সংবাদ সম্মেলন করে দলীয় নেতাকর্মীদের ভয়ভীতি এবং এজেন্টদের বের করে দেয়ার অভিযোগ করা হয়েছে। অথচ কুমিল্লা সিটি নির্বাচনের চেয়েও এই নির্বাচন ছিল শান্তিপূর্ণ। নির্বাচন চলার সময়ে বিএনপি প্রার্থীর পক্ষ থেকে কোন অভিযোগ করা হয়নি। তবে নির্বাচন শেষে দলীয় প্রার্থী কাওসার জামান বাবলা। কারচুপির অভিযোগ আনেন। এদিকে দলীয় প্রতিক্রিয়ায় দলের পক্ষ থেকে ভিন্ন সুর পাওয়া গেছে। নির্বাচন শেষে এক প্রতিক্রিয়ায় রিজভী উল্লেখ করেন রংপুরে ইসি সুষ্ঠু নির্বাচন করতে ব্যর্থ হয়েছে। নির্বাচনে ভোটাদের উপস্থিতিও কম ছিল। কিন্তু নির্বাচনের একদিন পরেই দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর রংপুর সিটি নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, সুষ্ঠু হলেও ইসির প্রতি আস্থা সৃষ্টি হয়নি বিএনপির। রংপুর সিটি নির্বাচন যত ভালোই হোক নির্বাচন কমিশনের প্রতি আমাদের কোন আস্থা নেই বলে উল্লেখ করেন। নব গঠিত রংপুর সিটির প্রথম নির্বাচন হয় ২০১২ সালে। সে নির্বাচনে দলীয় প্রতীক না থাকলেও নির্বাচনে ভোটের ফলাফলে দলীয় পরিচয় প্রধান ভূমিকা পালন করে। গত নির্বাচনে সরফুদ্দিন আহমেদ ঝন্টু ১ লাখ ৬ হাজার ২৫৫ ভোট পেয়ে মেয়র নির্বাচিত হন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী মোস্তাফিজ রহমান মোস্তফা পেয়েছিলেন ৭৭ হাজার ৮০৫ ভোট। তৃতীয় অবস্থানে ছিলেন অপর জাপা নেতা আব্দুর রউফ মানিক। তিনি পেয়েছিলেন ৩৭ হাজার ২০৮ ভোট। অর্থাৎ জাপার দুই প্রার্থী মোস্তফা এবং মানিকের মোট ভোট ঝন্টুর প্রাপ্ত ভোটের চেয়ে বেশি। সে ক্ষেত্রে জাপার একক প্রার্থী থাকলে জয়ের সম্ভবনা ছিল। কাওসার জামান বাবলা গত নির্বাচনে পেয়েছিলেন ২১ হাজার ২৫৩ ভোট এবং ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলনের রংপুরের আমীর এটিএম গোলাম মোস্তফা ১৫ হাজার ৬১৮ ভোট।
×