ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ৩০ মার্চ ২০২৪, ১৬ চৈত্র ১৪৩০

সম্পর্কে নতুন স্তরে উন্নীত

রোহিঙ্গা ইস্যুকে কেন্দ্র করে ঢাকা-আঙ্কারা সম্পর্কে সুবাতাস

প্রকাশিত: ০৪:৫৬, ২৩ ডিসেম্বর ২০১৭

রোহিঙ্গা ইস্যুকে কেন্দ্র করে ঢাকা-আঙ্কারা সম্পর্কে সুবাতাস

তৌহিদুর রহমান ॥ রোহিঙ্গা সঙ্কটের প্রেক্ষিতে ঢাকা-আঙ্কারা সম্পর্কের সুবাতাস বইছে। যুদ্ধাপরাধীর বিচার কেন্দ্র করে প্রায় দুই বছর ধরে তুরস্কের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের টানাপোড়েন চলে আসছিল। তবে রোহিঙ্গা ইস্যুকে কেন্দ্র করে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী বিনালি ইলদিরিম ইতোমধ্যেই ঢাকা সফর করেছেন। তিনি রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান না হওয়া পর্যন্ত আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও জাতিসংঘকে বাংলাদেশের পাশে থাকতে আহ্বান জানিয়েছেন। এছাড়া ব্যবসা-বাণিজ্য, বিনিয়োগ, প্রতিরক্ষা, শিক্ষা, পর্যটন ও যোগাযোগের মতো বিষয়ও দুই প্রধানমন্ত্রী আলোচনা করেছেন। একই সঙ্গে বাংলাদেশ ও তুরস্কের মধ্যে দুটি সমঝোতা স্মারকও সই হয়েছে। তবে বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরুর পর থেকেই তুরস্ক এই বিচার প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। বিশেষ করে জামায়াতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামীর ফাঁসির পর দেশটির প্রেসিডেন্ট তাইয়েপ এরদোয়ান তীব্র প্রতিক্রিয়া জানায়। তার আগে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে জামায়াত নেতা গোলাম আযমের বিচার প্রক্রিয়া শুরু হলে তা বন্ধ করতে তুরস্ক আনুষ্ঠানিকভাবে চিঠি দিয়েছিল। ২০১১ সালে সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনির সঙ্গে তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এক বৈঠকেও যুদ্ধাপরাধ বিচার বন্ধ করার জন্য আহ্বান জানিয়েছিল দেশটি। বাংলাদেশ তার অবস্থান থেকে সরে আসবে না বলেও তুরস্ককে জানানো হয়েছিল। গত বছর জামায়াতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামীর মৃত্যুদ-ের পর ঢাকা-আঙ্কারার মধ্যে পাল্টাপাল্টি অবস্থান নেয়। ঢাকা থেকে তুরস্কের তৎকালীন রাষ্ট্রদূত ডেভরিম ওয়াসতুর্ককে আঙ্কারায় ডেকে নেয়ার পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে তুরস্কে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত আল্লামা সিদ্দিকীকে ঢাকায় ডেকে আনা হয়েছিল। তখন প্রায় তিন মাস আল্লামা সিদ্দিকী ঢাকায় অবস্থান করেছিলেন। পরে তিনি তুরস্কে বাংলাদেশ মিশনে ফিরে যান। আর বাংলাদেশে নিযুক্ত তুরস্কের তৎকালীন রাষ্ট্রদূত ডেভরিম ওয়াসতুর্কও ঢাকায় ফিরে আসেন। যুদ্ধাপরাধীর বিচার ঘিরে দুই বছর ধরেই ঢাকা-আঙ্কারা সম্পর্কে টানাপোড়েন চলে আসছিল। গত ২৫ আগস্ট রাখাইনে মিয়ানমার বাহিনী রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন ও গণহত্যা শুরু করলে সরব হয়ে ওঠে তুরস্ক। বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের আসা অব্যাহত থাকায় তুরস্ক আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ফোরামেও বিষয়টি তুলে ধরে এর সুষ্ঠু সমাধান প্রত্যাশা করে। রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতনের তীব্র নিন্দা জানিয়ে একাধিকবার বিবৃতি দেন তুর্কী প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান। তিনি একে গণহত্যা বলেও উল্লেখ করেন। বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদকে ফোন করে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রোহিঙ্গাদের আশ্রয়ের ব্যাপারে বাংলাদেশকে সহায়তার অঙ্গীকারও করেন। তিনি মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর আউং সান সুচিকে কঠোর হুঁশিয়ারও করেন। তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী বিনালি ইলদিরিমের ঢাকা সফরের প্রেক্ষিতে পররাষ্ট্র সচিব এম শহীদুল হক বলেছেন, কিছুদিন ধরেই আমরা দেখছি বাংলাদেশ ও তুরস্ক আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে, বিশেষ করে সেটা জেরুজালেম, ওআইসি, সিরিয়া, লিবিয়া বা ইরাক ইস্যু হোক; বাংলাদেশ ও তুরস্ক একই ধরনের নীতিগত অবস্থান নিয়ে আছে। এতে দুই দেশের সম্পর্কে একটা ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে বলে মনে করেন তিনি। তিনি বলেন, আমি মনে করি, বাংলাদেশের সঙ্গে তুরস্কের সম্পর্কের একটা বড় ধরনের অগ্রগতি হচ্ছে। যেটা আমার কাছে মনে হয় যে বাংলাদেশের জন্য, সরকারের জন্য ও বাংলাদেশের জনগণের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ছিল। আমি মনে করি, সকল বিবেচনায় সম্পর্কটা একটা নতুন স্তরে উন্নীত হচ্ছে। সূত্র জানায়, বিনালি ইলদিরিমের ঢাকা সফরকালে রোহিঙ্গা সমস্যা বিষয়ে বাংলাদেশের নীতির সঙ্গে তুরস্কের প্রবল সমর্থন থাকায় ইস্যুটি বিশেষ গুরুত্ব পায়। বাংলাদেশে অবস্থিত সব রোহিঙ্গার প্রত্যাবাসন, রাখাইনে নিরাপদ পরিবেশ এবং কোফি আনানের নেতৃত্বে গঠিত রাখাইন পরামর্শ কমিশনের পূর্ণ বাস্তবায়ন দেখতে চায় বাংলাদেশ। এই তিনটি বিষয়ে তুরস্কের পূর্ণ সমর্থন রয়েছে। সে কারণে ঢাকা-আঙ্কারা সম্পর্কে ইতিবাচক প্রভাব পড়ছে। এছাড়া মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে তুরস্কের প্রভাব অনেক বেশি। বিশেষ করে তুরস্ক ন্যাটোর সদস্য। তাই রোহিঙ্গা সঙ্কটের প্রেক্ষিতে তুরস্কের সহযোগিতা নিতেও আগ্রহী বাংলাদেশ। তুরস্কের প্রধানমন্ত্রীর ঢাকা সফরের আগে দেশটির ফার্স্ট লেডি এমিনে এরদোয়ান ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেগলুত কাভাসগলু বাংলাদেশ সফর করেছেন। সে সময় তারা রোহিঙ্গাদের অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্র পরিদর্শন করেন। এছাড়া তুরস্কের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও সহযোগিতা বিষয়ক সংস্থার সমন্বয়ক আহমেদ রফিক সম্প্রতি ঢাকা সফর করেছেন। সে সময় বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া এক লাখ রোহিঙ্গা নাগরিকের জন্য তুরস্ক আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করে দেবে বলেও জানান তিনি। এসব মিলিয়ে দুই দেশের সম্পর্কে এখন সুবাতাস বইছে।
×