ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

কুটুম্বিতায় যান্ত্রিকতা একদন্ড ফুরসত নেই কারও

প্রকাশিত: ০৪:১৮, ২৩ ডিসেম্বর ২০১৭

কুটুম্বিতায় যান্ত্রিকতা একদন্ড ফুরসত নেই কারও

কুটুম্ব এসেছে। আত্মীয় এসেছে। অতিথি এসেছে। সঙ্গে পরিবারের সদস্য। ঘরে সুখের পরশ, আনন্দের ঢেউ। ছোটদের উচ্ছ্বাস। বাড়ির কর্তা ও গৃহিণীর ‘অতিথি নারায়নে’ আপ্যায়নের কত আয়োজন। কুটুম্বকে সঙ্গে নিয়ে ঘুরে বেড়ানো। দর্শনীয় স্থান দেখা। কখনও নৌকায় চড়ে উদ্দেশ্যহীন ভ্রমণ। প্রকৃতির সান্নিধ্য পাওয়া। দিনা কয়েক থেকে কুটুম্বের ফিরে যাওয়ার পালায় অশ্রুর ধারা। ফিরতি নিমন্ত্রণ। বাঙালীর জীবনের এমন কুটম্বিতা আজ দূর অতীত। এই তো নিকট অতীতে.....শীত মৌসুমের কিছুটা আগেই সামাজিক যোগাযোগের ‘লাইভ’ অধ্যায় শুরু হয়ে যেত। আত্মীয় স্বজন কখন কে কার বাড়িতে কুটুম্ব হয়ে দিনা কয়েকের জন্য যাবে তার আয়োজনের ধূম। প্রোগ্রামের চিঠি আদান। যানবাহনের জোগার ও প্রস্তুতি। ময়রার দোকানে রসগোল্লা বানানোর হিড়িক। সেই মিষ্টি বয়ে নেয়ার জন্য কুমোরের বাড়িতে মাটির পাতিলের অর্ডার। কুটুম্বিতার সে এক মহা কর্মযজ্ঞ। সেই আয়োজনের পালাগুলো দিনে দিনে প্রায় বিলুপ্তই হয়ে গিয়েছে...। ঢাকা মহানগরীতে কুটুম্বিতা পালিয়েছে সেই কবে। ফ্ল্যাট বাড়ির কোন তলায় কে থাকে তার খবর কেউ রাখে না। ধানম-ি আজ আর আবাসিক এলাকা নয়। বাণিজ্যিক এলাকা হয়ে ঘিঞ্জি। একই অবস্থা বনানী গুলশানের। বারিধারা ডিপ্লোমেটিক জোন। লালমাটিয়া, মোহাম্মদপুর, শ্যামলী, মগবাজার, মালিবাগ, মীরপুর মহাখালী, খিলগাঁ, বাসাবো, শাজাহানপুর, সূত্রাপুরসহ চারধারে কংক্রিটের বন আর জনঅরণ্য। সহমর্মিতা দূরে থাক, কেউ কারও খবর রাখে না। মনে হবে লাখো বিচ্ছিন্ন দ্বীপ। দেশের অন্যান্য নগরীতে পাড়া পড়শীদের মুখ দেখাদেখি পর্যন্তই। খুব বেশি হলে একটু হাসি বিনিময়। পরিচিতজনের সঙ্গে কালেভদ্রে দেখা হলে কেমন আছেন। এমন প্রশ্নের উত্তরে সার্বজনীন উত্তর ‘ভাল’। কে যে কত ভাল আছে সেই খবর নেয়ারও একদ- ফুরসত নেই। জীবন অস্থির। একটু সুখ খুঁজে নিতে প্রাণের কতই না আকুলতা। কোন ছন্দ নেই। ভাবের আদান প্রদান নেই। সময় কোথায়! মনে হবে জীবনের মধ্যে একটি সফটওয়্যার। অটো কন্ট্রোলে চলছে। সকাল হয়। তারপর কখন য়ে দ্রুত সময় গড়িয়ে সন্ধ্যা, তারপর রাত। এমনি করেই দিন মাস বছর যুগ চলে যায়। মনে হবে এই তো সেদিন! এই সেদিন কতদিন তার হিসাব করলে দীর্ঘশ্বাস। টাইম এ্যান্ড টাইড ওয়েট ফর নান (সময় ও ¯্রােত কারও জন্য অপেক্ষা করে না)। একটা সময় পারিবারিক বন্ধনে এক অপরের বাড়িতে দিনা কয়েকের জন্য বেড়াতে যাওয়া ছিল সামাজিক বন্ধনের একটি বড় অংশ। আত্মীয়স্বজন দেশের যে প্রান্তেই থাক এমন বন্ধন টিকে রাখত। আজ সেই বন্ধন ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন। সেদিনের কিছু দৃশ্য ছিল এমন- ট্রেনে ও বাসে চেপে, তারপর গরুর গাড়ি, ঘোড়ার গাড়িতে (টমটম) চড়ে কুটুম্ব আঙিনায় পৌঁছাতেই গৃহকত্রী, ছেলেমেয়ে পড়শীরা তড়িঘড়ি গিয়ে অতিথি বরণে ব্যস্ত। বাঙালীর সমাজ জীবনে নিকটজনের সঙ্গে দিনা কয়েকের জন্য মিলিত হয়ে একসঙ্গে থাকা চিরন্তন এক মধুময়তা। যা হৃদয়ের গভীর থেকে উৎসারিত। ভালবাসার আবেগের এক ধরনের হৃদস্পন্দন। ঘর হয়ে ওঠে সেই স্বপ্নময় রাজ্য। যেখানে হৃদয় ছোঁয়া কতই না কথা মালার গাঁথুনি। সে-ই কুটুম্বিতা আজ আর নেই। বর্তমানে যে কুটুম্বিতা আছে তার মাত্রা অনেকটাই ভিন্ন। অতি বয়স্করা যেমন ভুলো মনের হয়, সহজে চিনতে পারে না, কোন জিনিস কোথায় রেখেছে তা সহজে মনে করতে পারে না, অনেক সময় চেনা পথ হারিয়ে ফেলে বর্তমানে কুটুম্বিতা এমনই। কেউ আর কারও খোঁজ রাখে না। সবই এখন প্রযুক্তিতে ঢুকে পড়েছে। ল্যাপটপ, ট্যাব, স্মার্ট ফোনের মনিটরে আত্মীয়-স্বজন বন্ধুজন দূর থেকে উপগ্রহ হয়ে আকাশ পথে ভেসে আসে। ভিডিও কনফারেন্সে যান্ত্রিক লাইভ কথা হয়। ঘরদোর দেখা হয়। মুভির মতো দৃশ্য এগিয়ে যায়। শুধু থাকে না প্রাণের উচ্ছ্বাসের কথা। পঞ্চাশের দশকের মধ্যভাগে একান্নবর্তী পরিবারগুলোয় যখন খ-িত হওয়ার পালা শুরু হলো তখন কুটুম্বিতার গাঢ় প্রকাশ ঘটতে থাকে। খন্ডিত পরিবারের সদস্যরা তখন বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে। বনেদী পরিবার ও মধ্যবর্তী পরিবারের সদস্যদের অনেকে চাকরি নিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে যেতে থাকে। সরকারী চাকুরেদের বদলিজনিত কারণে ঘুরতে হয় দেশের বিভিন্ন স্থানে। সম্পর্ক ঠিক রাখতে চিঠি অনুঘটকের দায়িত্ব পালন করে। মাধ্যম হয় পোস্ট অফিস। চিঠি পাওয়ার পর শুরু হয় কাউন্ট ডাউন (ক্ষণ গণনা)। আত্মীয়-স্বজন বেড়াতে আসার কথা শোনার পরই পরিবারের শিশু কিশোরদের সে কি আনন্দ। পরিবার কর্তাকত্রীর প্রস্তুতি নেয়ার পালা শুরু। কে কোথায় কোন ঘরে থাকবে। কুটুম্ব বেশি এলে ফ্ল্যাট বিছানারও আয়োজন করা হয়। খাবার দাবারের মেনু একেক দিন একেকটা। মাছ গোশত পোলাও কোর্মা থাকে মেন্যুতে। কাছে পুকুড় থাকেল মাছ ধরা। শীতের সময় পিঠাপুলি বানিয়ে সকলে একসঙ্গে বসে খাওয়া। কুটম্বরা যে শুধু বসে থাকবে তাও নয়। রান্নাবান্নায় সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়। কাছে নদী থাকেল নৌকা ভ্রমণ। আশপাশে বেড়ানোর জায়গা থাকলে সকলে মিলে ঘুরে আসা। কেরাম লুডু ব্যাডমিন্টন কানা মাছি লুকোচুরি খেলা কোনটিই বাদ যায় না। পরিবারের সদস্যদের কেউ গান জানলে উঠানে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা। সেই অনুষ্ঠানে পড়শীদের আমন্ত্রণ জানানো। কুটুম্বিতার আনন্দগুলো ভাগাভাগি করে নেয়া। কতই না মধুর দিন ছিল...। দিনা কয়েক মহাআনন্দের পর একপর্যায়ে চলে আসে ফিরে যাওয়ার ক্ষণ। শিশু কিশোররা লুকিয়ে কাঁদতে থাকে। বড়দেরও চোখের কোণে নেমে আসে জল। সেই ক্ষণে একে অপরকে জড়িয়ে দু’ফোটা চোখের জল ফেলা। প্রতিশ্রুতি নিয়ে যায় ফিরতি কুটুম্বিতার। দিনা কয়েকের হৈ হুল্লোরের রেশ সহজে কাটে না। বাড়িটি ফাঁকা মনে হয়। তারপর নিয়মের আপন গতিতে সব ঠিক হয়ে যায়। ইংরেজীর সেই কথার মতো- টাইম হিলস অল সরোজ (সময় সকল দুঃখ ভুলিয়ে দেয়)। আজকের দিনে সেদিনের সেই কুটুম্বিতা নেই। আছে ভিন্নভাবে। প্রযুক্তির দ্রুত অগ্রযাত্রায় সেই কুটুম্বিতার সময় বা কোথায়! কোচে ট্রেনে নিজেদের গাড়িতে আত্মীয় স্বজনের বাড়িতে বেড়াতে যাওয়া হয় তবে অনুষঙ্গ হয়ে থাকে কোন কাজ। কাজও হয়। দু’য়েক দিন থাকা হয়। এই থাকা যান্ত্রিক জীবনের পার্ট। সময় করে ঘুরে বেড়ানোর সময় বুঝি এখন আর নেই। আত্মীয়তার বন্ধনও এখন অনেক শিথিল। -সমুদ্র হক, বগুড়া অফিস
×