ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

কাব্যনাট্য কারিগর সৈয়দ শামসুল হক -স. ম. শামসুল আলম

প্রকাশিত: ০৬:২৯, ২২ ডিসেম্বর ২০১৭

কাব্যনাট্য কারিগর সৈয়দ শামসুল হক  -স. ম. শামসুল আলম

(পূর্ব প্রকাশের পর) ঘাড় ভাংগি পড়িয়া সে যন্ত্রণায় ছটফট করে কিছুক্ষণ, তারপর হঠাৎ মস্তক তুলি, নিলক্ষার পানে দৃষ্টি করিয়া স্থাপন, বাপজান, বাপ মোর, ভাগাড়ে অন্তিমকালে পশুর মতন, ডাক ভাংগি উঠিল হাম্বায়। মানুষ উঠিল ডাকি পশুর ভাষায়। স্তব্ধ মারি শকুন তাকায়। মাথার উপরে সূর্য অগ্নি ঢালি যায়। মৃত নূরলদীন যেভাবে জীবন্ত হয়ে উঠেছিল, নাটকের পরিসমাপ্তিতে আবার সেভাবেই সে লাশ হয়ে যায়। মাঝখান থেকে আমরা জেনে নিলাম সেই ইতিহাস যা আজও আমাদের অনুপ্রেরণা যোগাতে পারে। সৈয়দ হকের হাতে সৃষ্টি আরও একটি কীর্তির নাম ‘গণনায়ক’। সবিনয় নিবেদনে তিনি লিখেছেন, ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’ কাব্যনাট্যটি লিখে ফেলবার পর ‘গণনায়ক’ লেখা আমার পক্ষে অনিবার্য হয়ে পড়ে। ব্যক্তিগতভাবে আমিও মনে করি তাঁর অনিবার্য লেখাটি আমাদের জন্য অবশ্যই অনিবার্য। গণনায়ক নাটকটিতে রাজনীতির ভেতর-বাহির প্রকাশ করা হয়েছে। শুধু উত্থান-পতন নয়, দম্ভ-অহংকার কতটা ক্ষতিকর তা জীবন দিয়েও উপলব্ধি করা যায় না কখনো সখনো সে বিষয়টিও তুলে ধরা হয়েছে। ক্ষমতা আঁকড়ে থাকা বা ক্ষমতাপিপাসু লোকের মধ্যে যে প্রতারণা থাকে সেটাও জানান দেয়া হয়েছে। খুব কাছের মানুষ দ্বারা একজন রাষ্ট্রপতি কিভাবে হত্যা হতে পারে তার বর্ণনা চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে এই নাটকে। আবার প্রতারণার ফলে ক্ষমতাধর ব্যক্তিকে পালিয়ে বেড়াতে হয় তারও নজির আছে এখানে। এমন অবস্থা যুগে যুগে কালে কালে হয়ে আসছে তা প্রমাণিত। সেই অম্লমধুর ইতিহাস আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে সুনিপুণভাবে উপস্থাপন করেছেন সৈয়দ হক। একটি রাজনৈতিক ঘটনাকে কেন্দ্র করে এমন একটি রচনা কাব্যে প্রকাশ করা দুঃসাধ্য মনে হলেও সৈয়দ হক তাঁর লেখনী শক্তি দিয়ে সফলকাম হয়েছেন। স্ত্রীর নিষেধ ও মিনতি অমান্য করে রাষ্ট্রপতি ওসমান সংসদ ভবনে যেতে আগ্রহ দেখায়। তার একটি সংলাপ এরকম: কাপুরুষ মৃত্যুর আগে বার বার মরে। বীর শুধু একবার। দীর্ঘ এ জীবনে আমাকে অবাক করে দিয়ে যায় শুধু এই আবিষ্কার যে, মৃত্যুই নিশ্চিত তবু মৃত্যুকেই লোকে ভয় পায় ভয়াবহভাবে। মৃত্যু আসে, যখন সে আসে। ওসমান অবশ্য একসময় না যাবার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু যখন প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে কাছের অনেক লোক হুমায়ুন, সানাউল্লাহ প্রমুখ এসে তাকে আমন্ত্রণ জানায় তখন সে সংসদ ভবনে যায় এবং ঐ লোকগুলির ছুরিকাঘাতেই তার মৃত্যু হয়। এরকম প্রতারণার ঘটনা থেকে রাজনীতি এখনো বের হতে পারেনি। এমনকি সমাজেও এই ঘটনা প্রভাব বিস্তার করেছে। যে হুমায়ুন একদিন সানাউল্লাহকে সঙ্গে নিয়ে ওসমানকে হত্যা করেছিল সেই হুমায়ুনকে আবার একদিন সানাউল্লাহ হত্যা করে। সবশেষে আকবরের সংলাপটি অনেক অর্থবহ: বাঁশিতে কোনো ছিদ্র নেই। আমার দুঃস্বপ্নে দেখা রক্তহীন সেই বাঁশি পড়ে আছে দাবানলে দগ্ধ এক ভয়াবহ প্রান্তরে একাকী। ‘এখানে এখন’ কাব্যনাট্যে সৈয়দ হক মানুষের ব্যবহৃত হওয়ার বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়েছেন। আমরা ব্যবহৃত হচ্ছি রাজনৈতিক রোষানলে বা স্বার্থের জন্য কোনো না কোনোভাবে। এবং এভাবে ব্যবহৃত হওয়ার ফলে আমাদের দেশ এখন বিভক্ত হয়ে পড়ছে একাধিক শ্রেণীতে। নাটকে সাদা বেশধারী দুজন প্রথমে যে সংলাপ নিয়ে হাজির হয় তার শেষাংশ এরকম: এখানে এখন মানুষকে মানুষেরই মুখ চিনতে হলে অন্য কোনো আলোকের দরকার হয় মানুষকে মনুষেরই স্বর শুনতে হলে কোনো এক প্রলয়ের দরকার হয়। নাটকের গভীরে ডুবে যাবার আগেই শাদা বেশধারীর কথায় অনেক প্রয়োজনীয় তথ্য জানা হয়ে যায় যার মধ্যে মানুষ ও জীবনবোধের ব্যাখ্যাও রয়েছে। ‘হঠাৎ বাতাসে নদী যেভাবে কুঁচকে যায়, স্তব্ধতাও যেন ঠিক সেইভাবে তখন কুঞ্চিত হয়ে গিয়েছিল’ এমন জীবনবোধের কথা সৈয়দ শামসুল হকই বলতে পারেন। মানিকগঞ্জে রেল বসাবার ব্যবসায়িক চিন্তাকে আনন্দ দিলেও এখানে একটি অপরাজনীতির ইঙ্গিত আমরা পেয়েছি। ব্যবসায়িক চিন্তা বা স্বপ্নের চেয়ে জীবনের স্বপ্ন নিয়েও অনেক দূরদর্শী ভাবনার কথা এই নাটকে স্থান পেয়েছে। মিনতির একটি সংলাপের মধ্যে আছে: যেমন ধরুন স্বপ্নে আমি ছোটবেলা থেকে প্রায় প্রতি পূর্ণিমার রাতে নিজেকেই দেখতে পেতাম ঘন নীল কি সুন্দর শাড়ি পরে মাঠের ভেতর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি কতদূর দিগন্তের দিকে, হাঁটছি না ভেসে যাচ্ছি সবুজ ঘাসের ঢেউ ছুঁয়ে ছুঁয়ে। বাতাস ছাড়াও বুকের বাতাসে ঘাসে ঢেউ তোলা সম্ভব তা সৈয়দ হক বুঝিয়ে দিতে সক্ষম। কাব্যের দ্যোতনা যেমন মুগ্ধ করে তেমনি কাহিনীবিন্যাসেও অন্য এক ভালো লাগা ও চেতনার জন্ম দেয় এমনই একটি নাটক ‘এখানে এখন’। ‘ঈর্ষা’ নাটকে কুশীলব মাত্র তিনজন প্রৌঢ়, যুবতী ও যুবক। প্রৌঢ়ের তিনটি এবং যুবতী ও যুবকের দুটি করে সংলাপ অর্থাৎ মাত্র সাতটি দীর্ঘ সংলাপে নাটকটি রচিত হয়েছে। সৈয়দ হকের মুন্সিয়ানা শুধু লেখার নয়, নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার কাজ তিনি করেছেন। বিদেশী নাটকের ধাঁচ রপ্ত করে তিনি দেশীয় উপাদানে নাটক সমৃদ্ধ করতে পেরেছেন দক্ষতার সঙ্গে। তার একটি প্রমাণ ঈর্ষা। ঈর্ষার সবিনয় নিবেদনে তিনি লিখেছেন, ‘আমার এমত মনে হয়, ঈর্ষা হয় এক বিস্ময়কর পরিস্থিতি; ঈর্ষা হয় একই সঙ্গে পাশবিক ও মানবিক একটি অনুভূতির সাধারণ নাম যার মূল ক্ষেত্র প্রেম কিংবা দেহ-সংসর্গ; হয় বিস্ময়কর, মানবের বেলায়, এ কারণে যে, যে-মানুষ নিজের সীমা ও ভর সম্পর্কে সচেতন থেকে জীবনের অপর সকল প্রসঙ্গে আজীবন ঈর্ষাহীন, প্রেম বা দেহ-সংসর্গের অনুষ্ঠানে সেই মানুষটিই নিজেকে হতে দেয় ঈর্ষাদষ্ট, পূর্বের আত্মচেতনা প্রয়োগ করতে সে হয় বিস্মৃত।’ প্রৌঢ় চিত্রশিল্পী যুবতীর ন্যুড ছবি এঁকেছিলেন যুবতীকে মডেল বানিয়ে। কিন্তু যুবতী বিয়ে করে আরেক শিল্পী যুবককে। প্রৌঢ় তাতে ক্রোধ প্রকাশ করলেও যুবতী স্পষ্ট জানায় এটা ক্রোধ নয়, ঈর্ষা। যুবকেরও প্রৌঢ়ের প্রতি ঈর্ষা যে যুবতী কেন সিটিং দিল তার চিত্রকর্মের জন্য। একসময় সে মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গ তুলে আনে। সে সময় একভাবে নারীর গোপন রত্ন লুট হয়েছিল, অন্যভাবে প্রৌঢ় এই কাজটি করেছেন। যুবক মুক্তিযুদ্ধে যাবার কারণে তার বাবার চোখ উপড়ে ফেলা হয়েছিল এবং বোনকে আত্মহত্যা করতে হয়েছিল। ঈর্ষা নিয়ে প্রৌঢ়ের সংলাপের একটি অংশ এরকম: একটা কথা কি বিশ্বাস করবে? এতদিন জানতাম, প্রেমিকের হৃদয় যদি পোড়ে তো একমাত্র ঈর্ষার আগুনেই পোড়ে, এতকাল জানতাম ঈর্ষায় যে পোড়েনি, প্রেম সে হৃদয় ধরেনি; আজ আমি জেনেছি, ঈর্ষা এক ঠা-া নীল আগুন, ঈর্ষা বস্তুতপক্ষে ক্রোধের বরফ ঈর্ষায় একমাত্র প্রেমহীন পোড়ে। যুবতী তার শিল্পী হয়ে ওঠা এবং প্রৌঢ়ের সামনে শরীর মেলে ধরার ঘটনা বর্ণনা করে চলে যায় এই বলে যে, একই সঙ্গে অনেককে ভালোবাসা যায়। উদাহরণ হিসেবে সে চারজনকে ভালোবাসার কথা বলে। জয়নুল ও কামরুলকে শুধু শিল্পী হিসেবে, প্রৌঢ়কে শিল্পী ও মানুষ হিসেবে এবং যুবককে স্বামী হিসেবে। কিন্তু তার চলে যাবার পর প্রৌঢ় আত্মপোলদ্ধির কথা জানান। শেষ দৃশ্যে যুবতী এসে প্রৌঢ়ের কাঁধে হাত রাখলে অবশ্যই চমকে উঠতে হয়। আর যদি যুবতীর চুলে পাক ধরে তবে তো কথাই নেই। প্রথমে ধাক্কা খেয়েছিলাম যে সৈয়দ হক কেন অন্দর মহলের নারীদের নিয়ে ‘নারীগণ’ লিখতে গেলেন। পরে বুঝতে পারলাম হীরাঝিল প্রাসাদের জেনানা মহলের কথাগুলো সকল মহলের নারীদের জন্য কতটা ভয়াবহ বার্তা। পুরুষের লোভ যেমন এই নাটকে প্রকাশ পেয়েছে তেমনি নারীতে নারীতে দ্বন্দ্বের জায়গাটিও বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে। নবাব শিরাজদৌলার জেনানা মহলের ইতিহাস রচনা করতে গিয়ে নারীজগতের ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন সৈয়দ হক। শিরাজদৌলার মৃত্যুর পর বন্দীদশায় থাকেন তাঁর মা আমিনা বেগম, নানি শরিফুন্নেসা ও স্ত্রী লুৎফুন্নেসাসহ দাস-দাসীরা। প্রহরীরা বাঁদীদেরকে খাঁচাগাড়িতে তুলে দেবার সময় হাত ধরে বাঁদীদেরকে অসম্মানিত করায় তারা কেউ কাঁদে, কেউ হাত-পা ছোঁড়ে, কেউ নীরবে সহ্য করে। এক প্রহরীর ভাষা এরকম : হাত ধরে খাঁচায় উঠাই! খাবার হুকুম নাই ছোঁয়াও নিষেধ? ছুঁয়ে সুখ করি, ভাই! এই ছুঁয়ে সুখ করার তাৎপর্য অনেক। আবার নারীদ্বন্দ্বের কথা এসেছে খুবই সরলভাবে। বাইজি যখন লুৎফার নাম উচ্চারণ করে তখন শরিফুন্নেসা উত্তেজিত হয় এই বলে যে বাংলার বেগমকে কেন শুধু লুৎফা বলে সম্বোধন করল একজন নটি। লুৎফাও বাইজিকে তিরস্কার করে কঠিন ভাষায়। শরিফ তাকে বেশ্যা বলেও অপমানিত করেন। তখন বাঈজি বলে আমি তো বেশ্যাই বটে, কিন্তু কী জানেন, আমাদেরও প্রাণ আছে। নিশ্চয় বেশ্যারা দেহ বিক্রি করে থাকে, লোকে শুধু দেহটাই কেনে! প্রাণ তার বিক্রিযোগ্য নয়! প্রাণ বিক্রি সে করে না। তাই সে হলেও বেশ্যা, দেহে শুধু, দেহে! প্রাণে সে জগৎ সতী-সাবিত্রীর মতো। এরপরও সে লুৎফাদেরকে প্রাণে বাঁচাতে চায় এবং বলে যে তার কাছে ছাড়পত্র আছে বাঈজিরা নিরাপদে চলে যেতে পারবে। তাদের সঙ্গে বোরকা পরে গেলে কেউ তাদের চিনবে না এবং প্রাণে বেঁচে যাবে। এককথায় আরও উত্তেজিত হয় তারা এই ভেবে যে বাঈজি মীরনের গুপ্তচর কিনা। তাছাড়া নবাবের বংশধর নারীগণ কী করে বাঈজি সেজে পালাবে। এ যে অনেক বড় অপমান। আবার, গুপ্তচর বলায় বাঈজি কেঁদে ফেলে এবং প্রহরীদেরকে দেখে দৌড়ে পালিয়ে যায়। তখন ঘসেটি বেগমকে বন্দী অবস্থায় দেখা যায় এবং সে লুৎফাকে মীরনের প্রস্তাবে রাজি হতে বলে। অর্থাৎ মীরনের সঙ্গে বিয়ে করতে বলে যে মীরজাফর আর কদিন? মীরনের সঙ্গে বিয়ে হলে বাংলার সিংহাসনে দেখবে নতুন স্বামীকে। শেষ মুহূর্তে জবাবে লুৎফা বলে আমি রাজহস্তীর রমণী। হস্তীতে অভ্যাস যার গর্ধভের কাছে যাওয়া অসম্ভব তার। সুতরাং তাদেরকে প্রহরীদের সঙ্গেই চলে যেতে হয়। আনন্দ-বেদনার কাব্যনাট্য ‘নারীগণ’ সৈয়দ শামসুল হকের আরেকটি অনবদ্য সৃষ্টি। পল্লীকবি জসীমউদ্দীনের বেদের মেয়ে নাটকটি একটু ভিন্ন মাত্রায় সৃষ্টি করেছেন সৈয়দ হক যার নাম ‘চম্পাবতী’। চম্পাবতী কাব্যনাট্যে কিছু গান সংযোজন করেছেন তিনি যা আমাদের আঞ্চলিক টানকেও অতিক্রম করে অন্য অঞ্চলে প্রেরণযোগ্য। সৈয়দ হক তাঁর সবিনয় নিবেদনে বলেছেন অগ্রজ কবি জসীমউদ্দীনের নাটকটিতে যে পঙ্গুতা লক্ষ্য করেছেন সেটা কাটিয়ে দেয়াই তাঁর উদ্দেশ্য ছিল এবং এ বিষয়টি নিয়ে তিনি কবির সঙ্গে আলাপও করে নিয়েছিলেন। বেদের মেয়ের অনুরূপ কাহিনী চম্পাবতীর শেষ দৃশ্য বেশ বেদনাদায়ক। সাপে কাটা গয়া বাইদ্যার বিষ যখন নামান যাচ্ছিল না তখন বেদেরা বলছিল আর কি কোন মন্তর নাই যে গয়া বাইদ্যা বাঁচে? তখন চম্পা বলে একটা মন্তর আছে গো-সেই বিষম মন্তর খান একজনের প্রাণ কাইড়া নিয়া আরেকজনের প্রাণ। (চলবে)
×