ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

মধ্যাহ্ন, অপরাহ্ণ! -আলী যাকের

প্রকাশিত: ০৬:২৬, ২২ ডিসেম্বর ২০১৭

মধ্যাহ্ন, অপরাহ্ণ!  -আলী যাকের

(পূর্ব প্রকাশের পর) গোয়ালন্দ থেকে আরিচা পাড়ি দিতে দু’ঘণ্টা লেগেছিল আমাদের। ভারি সুন্দর লেগেছিল ওই পথটুকু পেরুতে। রোদের আলোয় চক্চক্ করছে নদীর পানি। মাঝে মাঝে জেগে উঠেছে একটি, দুটি সোনালি চর। হঠাৎ হাওয়ায় বালুর ঘূর্ণি উঠছে ওই চরগুলোর মধ্যখানে। আমরা আস্তে আস্তে এগিয়ে চলি অভীষ্ট গন্তব্যের দিকে। আরিচা ঘাটটিও বোমার আঘাতে উড়ে গিয়েছে যুদ্ধের সময়। অতএব ঘাট থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার দূরে নদীর ধারে আমাদেরকে নামিয়ে দেয়া হলো। আমরা হেঁটে চলি সামনে। একদিকে নদী, আর অপর দিকে নানা ধরনের শস্যের ক্ষেত। সে এক নয়নাভিরাম দৃশ্য। সেদিন ফিরতে ফিরতে যা কিছু দেখছিলাম, তা-ই ভাল লাগছিল আমার। এ যেন এক নতুন দেশ আবিষ্কার করছি আজ। দেশের প্রতিটি মানুষ আমাদের স্বাগত জানাচ্ছে। মনে পড়ে, আরিচার অদূরে একটি গ্রামের কোল ঘেঁষে আসার সময় দুজন গ্রামবাসী অ্যালুমিনিয়ামের কলসি নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল পথচারীদের পানি খাওয়াবার জন্য। ঠিক একই দৃশ্য প্রত্যক্ষ করেছিলাম যখন দেশ ছেড়ে ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করি। পথে আমাদের থাকা খাওয়ার কোন ঠিক ছিল না। দেশের মানুষ আমাদের খেতে দিয়েছে, থাকতে দিয়েছে। সকল মানুষ এমন সংবেদনশীল ছিল তখন। আরিচা থেকে একটি যুৎসই বাস খুঁজে পেতে আমাদের বেশ সমস্যাই হলো। বেলা তিনটার দিকে একটা মুড়ির টিনের মতো বাসে আমরা ৩০ জন এবং সেই সঙ্গে আরো কিছু যাত্রী কোন মতে গাদাগাদি হয়ে বসে ঢাকার পথে রওনা হলাম। আরিচা যে থানার অন্তর্গত, সেই শিবালয় থানার সঙ্গে আমার অল্পবিস্তর পরিচয় ছিল। এখানে পথের ধারে একটি সরকারী বাংলো আছে, ছোট নদীর ধারে, সেখানে আমাদের এক বন্ধু সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় পাস করার পর সেটেলমেন্টের প্রশিক্ষণ নেয়ার জন্য এসেছিল কয়েকদিন। অতি সুন্দর, প্রায় ছবির মতো দেখতে বাংলোটি। আমরা প্রায়ই সপ্তাহান্তে দিন এবং রাত কাটাতে আমাদের এই বন্ধুর কাছে চলে আসতাম। মাঝে মধ্যে নদীতে নৌকা ভাসিয়ে সারাদিন এদিক সেদিক ঘুরে বেড়াতাম। সেই বাংলোটি বাসের জানালা দিয়ে চোখে পড়ল। এখনও অটুট আছে। বুঝলাম এখানেও নিশ্চয়ই পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ক্যাম্প ছিল এবং তারা একটু বিলম্বেই এই বাংলো ছেড়ে গেছে। সে কারণেই বাংলোটি বিধ্বস্ত হয়নি। আমি পরে লক্ষ্য করেছি, যে সকল সরকারী ভবনে পাকিস্তান সেনাবাহিনী আসন গেড়ে বসেছিল এবং শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অবস্থান নিয়েছিল, সেই ভবনগুলো ক্ষত-বিক্ষত হয়নি। এই ভবনগুলো আরও বেশি বোঝা যেত এই কারণে যে, ওগুলোর সামনে পেছনে বালুর বস্তা দিয়ে এক ধরনের বাঙ্কার তৈরি করা হতো, যেখানে অস্ত্রধারী সৈনিকরা দিনরাত দাঁড়িয়ে ভবনটিকে পাহারা দিত। আরিচা থেকে মানিকগঞ্জ হয়ে ঢাকার দিকে ছুটে চললাম। মানিকগঞ্জের অদূরে তরাঘাটে আমাদের আরও একটি ফেরি পার হতে হল। কেননা তখনও ওখানকার মহাসড়কের সেতুটি নির্মাণ করা হয়নি। আবারও বাসের ভেতরে বসে আমরা বাসের ঝাঁকুনির সঙ্গে সঙ্গে সমস্বরে গাইতে লাগলাম বিভিন্ন দেশ-গান। ঢাকা যতই এগিয়ে এলো কাছাকাছি ততই আমাদের চোখ বাষ্পাকুল হয়ে উঠল। কী রোমাঞ্চ যে লাগছিল তখন, তা ভাষায় প্রকাশ করা প্রায় অসম্ভব। ঢাকায় পৌঁছলাম আমরা সন্ধ্যা ৬টায়। বাস এসে থেমেছিল একেবারে নিউমার্কেটের পাশে। ঢাকা শহরে প্রবেশের পর আমরা কেউই অশ্রু সংবরণ করতে পারিনি। আমাদের মধ্যে মেয়েরা অনেকেই একেবারে হাঁউমাউ করে কেঁদে ফেলেছে। নিউমার্কেটে নেমে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার মধ্য দিয়ে ব্যাগ হাতে আমি হেঁটে চলেছি। আমার গন্তব্য ঢাকার নারিন্দায়। যেখানে আমার ভাই এবং ভাবি থাকে। অবাক হয়ে গেলাম দেখে যে, সন্ধ্যার আধো আলো, আধো অন্ধকারের মধ্যেও ঢাকা শহরের রাস্তা লোকে লোকারণ্য। হঠাৎ মনে পড়ল আজ ১০ জানুয়ারি। আজই বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানী জেল থেকে লন্ডন এবং দিল্লী হয়ে ফিরে এসেছেন তার প্রিয় বাংলাদেশে। পথে অজ¯্র নারী-পুরুষের সমাগম। সবাই তাদের নেতাকে এক নজর দেখতে নেমে এসেছে শহরের রাস্তায় রাস্তায়। এই দৃশ্য দেখে আমার মনে হলো যে ঢাকা শহরে এত নারী ছিল তা তো কখনও কল্পনাও করিনি! আরও একটি বিষয় মনে হলো যে, যখন পরাধীনতার শৃঙ্খল যায় ছিঁড়ে, ঔপনিবেশিকের অত্যাচারের শঙ্কা আর থাকে না, তখন এক নতুন প্রাণে সঞ্জীবিত হয়ে ওঠে গণমানুষ। আজ কারও মাঝেই কোন দ্বিধা নেই, সঙ্কোচ নেই। তারা সবাই হাসছে, হাতে হাত ধরে এদিক থেকে সেদিক ঘুরছে ফিরছে। পথে অনেকের হাতে ছোটখাটো আগ্নেয়াস্ত্রও দেখলাম। উস্কখুস্ক চুল, দাড়ি-গোঁফ গজিয়ে গেছে। পরনে আধা ময়লা কাপড়। বুঝলাম এরা সবাই মুক্তিযোদ্ধা। আরও একটা বিষয় লক্ষ্য করলাম, অনেক তরুণ একে অন্যকে সম্ভাষণ জানাচ্ছে ‘জয় বাংলা’ বলে। এই তো আমার বাংলাদেশ। যে দেশের জন্য দীর্ঘ নয়টি মাস নিপীড়িত হয়েছে সাধারণ মানুষ, যুদ্ধ করেছে অস্ত্র হাতে, জীবন বিসর্জন দিয়েছে অবলীলায়। সেই নিউমার্কেট থেকে ব্যাগ হাতে হাঁটতে হাঁটতে কখন যে ওয়ারীতে এসে পড়েছি লক্ষ্য করিনি। আর সামান্য দূরেই নারিন্দা, যেখানে ভাইয়া-আমার বড় ভাই, সস্ত্রীক এবং সদ্যোজাত কন্যা সন্তানকে নিয়ে বাস করেন। হাটখোলা রোডে পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গেই এক রিক্সাওয়ালা আমায় জিজ্ঞেস করল রিক্সায় চড়ব কি না। আমার পকেটে বেশি টাকা পয়সা ছিল না। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, কত নেবেন? জবাবে রিক্সাওয়ালা বললেন, ‘আপনার যা খুশি দিয়েন। কোথায় যাবেন?’ আমি রিক্সায় চড়ে বসলাম। বললাম, ‘নারিন্দা যাব’। নারিন্দায় নির্দিষ্ট গলির ভেতরে ঢুকে রিক্সাওয়ালার হাতে ভারতীয় দুটি টাকা দিয়ে বললাম, আমার কাছে পয়সা খুবই কম। সে একগাল হেসে রিক্সা নিয়ে দ্রুত অন্যদিকে চলে গেল। সামনেই ভাইয়ার বাড়ি। একটি দ্বিতল ভবনের দোতলায় ওরা থাকেন। তখন রাত ৮টা। সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে দোতলার দরজায় করাঘাত করলাম। ভাইয়া নিজেই দরজা খুললেন। আমাকে দেখে কয়েক মুহূর্তের জন্য একেবারে স্থানু হয়ে গেলেন। তারপর জড়িয়ে ধরলেন দীর্ঘদিন পরে, শত অনিশ্চয়তা কাটিয়ে দুই ভাই আলিঙ্গনাবদ্ধ হলাম। আমাদের দু’জনেরই চোখ দিয়ে তখন বাঁধভাঙা অশ্রু ঝরছে। ভাবি, আমার ভাতিজিকে কোলে নিয়ে এগিয়ে এলেন। ওর নাম রাখা হয়েছে তিথি। আমি ভাবিকেও জড়িয়ে ধরলাম। ভাবি বললেন, ভেতরে এসে আগে বোস, তারপর দেখা যাবে। রাত ১০টার দিকে রাতের খাবার পরিবেশন করা হলো। আমি এবং ভাইয়া দু’জনের মুখেই কথার ফুলঝুরি ছুটছে। নানা জনের খবর নিচ্ছি তখন। কে কোথায় আছে, কেমন আছে ইত্যাদি। আমাদের কথা যেন ফুরোতেই চায় না। সেই আমার মায়ের সংসারে যেমন হতো, খাবার টেবিলে সবাই বসে খাওয়া শেষ হয়ে যাবার পরও আড্ডা চালিয়ে যেতাম। এঁটো হাত শুকিয়ে যেত কিন্তু আড্ডা থামত না। রাত ১১ টায় আবার কেন যেন ঢাকার রাস্তায় নামার নেশা আমাকে বাইরে টেনে আনল। ভাইয়ার কাছ থেকে কিছু পয়সা নিয়ে ঢাকার রাস্তায় নেমে পড়লাম। হাঁটতে লাগলাম। এবারে টিপু সুলতান রোড হয়ে নবাবপুরের দিকে। দেখলাম পথে অনেক বিধ্বস্ত দোকানপাটও খোলা রয়েছে তখন। সবাই হাসি মুখে গল্প করছে। হাঁটতে হাঁটতে চলে এলাম সদরঘাট। এখানেও জনারণ্য। সদরঘাট থেকে একটি রিক্সা ধরে পাটুয়াটুলী এবং ইসলামপুর হয়ে আরমানিটোলা। সেখান থেকে বংশাল, নবাবপুর হয়ে আবার গুলিস্তান। রাত তিনটা পর্যন্ত স্বাধীন বাংলাদেশের গন্ধ শরীরে মেখে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ালাম। সে যে কী আনন্দ তা ভাষায় বর্ণনা করা যায় না! এক অপার শান্তিতে মন ভরে গেল। এরপর আমার গন্তব্য মগবাজার মোড়ে ক্যাফে তাজ। সেখানে একা একা বসে স্বাদু মোরগ পোলাও খেলাম। ক্যাফে তাজ থেকে বেরিয়ে এসে দাঁড়ালাম উন্মুক্ত অকাশের নিচে। হঠাৎ উত্তর থেকে বয়ে আসা কনকনে ঠান্ডা বাতাসে কাঁপন লাগল যেন শরীরে। এলোমেলো নানা চিন্তা ভিড় করে আসে মনে। এত মানুষের এত ত্যাগ, এত সম্ভ্রমহানি, এত আত্মাহুতি, যার ফসল আমার এই বাংলাদেশ। সব ঠিক থাকবে তো? অভীষ্ট লক্ষ্যের দিকে আমরা এগিয়ে যেতে পারব তো? যে আদর্শ এবং চেতনা নিয়ে, পূর্বাপর কোন কিছু না ভেবেই যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম, সেই চেতনা অটুট থাকবে তো? তারপর একটা খালি রিক্সায় উঠে বসলাম আমার গন্তব্য নারিন্দায় যাওয়ার জন্য। পর্ব -১ সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে আমার জীবনের দ্বিতীয় পর্ব শুরু হলো অবশেষে। সারা জীবন সবাই মিলে একসঙ্গে হৈ-হুল্লোড় করে দিন কেটেছে আমাদের। এর বেশিরভাগই কেটেছে পরিবারের সবার সঙ্গে। বস্তুতপক্ষে এই পরিণত বয়সে এসে পেছন ফিরে তাকালে বুঝতে পারি আমাদের সকল আনন্দ-উদ্দীপনা, সকল আবেগ-আতিশয্য পরিবারকে কেন্দ্র করেই। সেই উনিশ শ’ ঊনসত্তরে আমার নানা-নানীর বিবাহবার্ষিকী পালন করেছিলাম। আমরা, সংখ্যাগরিষ্ঠ মামাত এবং খালাত ভাই-বোনেরা কলকাতায় তখন এক হয়েছিলাম নানাবাড়িতে। সেই সময় গুনে দেখেছিলাম যে শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে আমার নানার বংশোদ্ভূত আপন মামাত-খালাত ভাই- বোনের সংখ্যাই ছিল তেতাল্লিশ। অতএব, সেই হিসেবে আমরা, সাক্ষাত মামাত-খালাত ভাই-বোনেরা, সংখ্যায় তখনই ছিলাম প্রায় সাড়ে তিন প্ল্যাটুন সামরিক বাহিনীর সমান। আমরা সবাই ছিলাম, কথ্য ভাষায় যেমন বলা হয়ে থাকে, মায়ের দিকের ফার্স্ট কাজিনস্। আগেই বলেছি যে আমি যখন যুদ্ধ থেকে ফিরলাম, ভাইয়া, অর্থাৎ বড় ভাই-ভাবি তাদের প্রথম কন্যা সন্তানকে নিয়ে তখন নারিন্দার একটি দুই কামরার বাসায় থাকেন। এর আগে আমি কখনও এই পাড়ায় থাকিনি। এখানে আমার বড় ভাইয়ের শ্বশুর-শাশুড়ি থাকতেন। পুরান ঢাকায় যেমন হয় অপ্রশস্ত গলি এবং তার দুই পাশে গায়ে গায়ে লাগানো সব বাড়ি। তবে এই ধরনের পাড়ারও একটা স্বকীয়তা আছে। প্রত্যেক পরিবার তাদের পড়শীদের চেনেন এবং তাদের সুখে-দুঃখে স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে এগিয়ে আসেন। দেশে ফেরার পর প্রথম কয়েকদিন আমি সদ্য স্বাধীন বাংলার নতুন আস্বাদন গ্রহণ করতে ব্যস্ত ছিলাম। তখনও কি করব সেই সিদ্ধান্ত নেইনি। (চলবে)
×