ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বই ॥ দীর্ঘশ্বাসের শব্দ -নাজনীন বেগম

প্রকাশিত: ০৬:২৪, ২২ ডিসেম্বর ২০১৭

বই ॥ দীর্ঘশ্বাসের শব্দ  -নাজনীন বেগম

কাদের পলাশের ‘দীর্ঘশ্বাসের শব্দ গল্পগ্রন্থটি প্রকাশ পায় ২০১৭ সালের ভাষার মাসে ‘দেশ পাবলিকেশন্স’-এর প্রকাশনায় বইটির প্রচ্ছদ এঁকেছেন হিমেল হক। স্ত্রীকে উৎসর্গ করা গ্রন্থটি গোছানো হয়েছে ২২টি ছোট গল্পের হরেক রকম অনুভবের শৈল্পিক শৈলীতে। ছোট গল্পের আঙ্গিক আর বৈশিষ্ট্যকে গুরুত্ব দিয়ে প্রতিটি গল্পের পরিসর হয়েছে সীমাবদ্ধ। অল্প কথায় গভীর তাৎপর্যে গল্পের কুশীলবরা পাঠকের দৃষ্টিতে পড়ে যায় সাবলীলভাবে। অনাড়ম্বর ভাষায় গভীর জীবন বোধ গল্পের নান্দনিক বোধকে যে মাত্রায় নিয়ে যায় তা যেমন আকর্ষণীয় একইভাবে জীবন ঘনিষ্ঠও বটে। সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলা নদী বিধৌত বাংলার প্রাকৃতিক বৈভবে গল্পগুলোর সমৃদ্ধ অবয়ব যেভাবে নির্মাণ করা হয়েছে তার সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত হয়েছে প্রতিদিনের অতি সাধারণ জীবনপ্রবাহও। যেখানে নির্মোহ আবেগে গ্রাম বাংলার নিরেট বাস্তবতা অতি সূক্ষ্মভাবে পাঠকদের নজর কাড়ে। গ্রামনির্ভর বাংলার পল্লী প্রকৃতি, অর্থনৈতিক টানাপোড়েন, সম্পর্কের অন্তর্দ্বন্দ্ব থেকে শুরু করে রক্ষণশীল সমাজের নানামাত্রিক অপসংস্কারের সঙ্গে দৈনন্দিন জীবনের আনন্দ-বিষাদ ও গল্পের গতিময়তাকে পরিশীলিত করেছে। ‘ভাঙ্গন’ গল্প দিয়ে বইটি শুরু করা হয়েছে। নদীস্নাত বাংলার উন্মত্ত, বেপরোয়া নদী মেঘনা। যার অবারিত স্রোতধারায় চারপাশের কিনারে যে ভাঙ্গনের খেলা শুরু হয় তা তীরবর্তী মানুষের বাঁচার লড়াইকে নিয়তই জিইয়ে রাখে। নদী তার নিজস্ব নিয়মে এক কূল ভাঙ্গে আরেক কূল গড়ে। এ ভাঙ্গা-গড়ার চৌহদ্দিতে আটকে পড়া মানুষগুলোর জান-মাল প্রতিনিয়তই সম্মুখ সমরে পতিত হয়। নদীমাতৃক বাংলার এই এক চিরায়িত অমোঘ নিয়তি যা গল্পকারকে আপন ভূমির রূঢ় প্রকৃতির প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করে নান্দনিক বোধ জাগিয়ে তোলে। ‘অচেনা মানুষ আপন মানুষ’ গল্পে আছে রেল স্টেশনের প্লাটফর্মে রাতযাপন করা অসংখ্য অসহায় মানুষের জীবনপ্রবাহ। সাধারণ মানুষের প্রতিদিনের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঘটনাকে গল্পের উপজীব্য করে সৃষ্টি জগত নির্মাণ করা খুব একটা সহজ ব্যাপার নয়। শৈল্পিকবোধে সে সব ঘটনাকে পাঠকের সামনে তুলে ধরার যে সৃষ্টিকর্ম তা প্রশংসার দাবি রাখে। প্রতিদিনের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, ভালবাসা-বিচ্ছেদ গল্পের গতিপথ তৈরিতে যে অনবদ্য ভূমিকা রাখে তাতে লেখকের নিজস্ব সৃজন ক্ষমতা বুঝতে পাঠকের অসুবিধা হয় না। প্রতিটি গল্পে আছে বাংলার শ্যামল প্রকৃতির অনন্য রূপ, ব্যক্তি জীবনের ঘাত- প্রতিঘাতসহ সামাজিক ব্যবস্থারও এক স্পষ্ট, স্বচ্ছ, রূঢ় প্রতিবেদন। গল্পগুলো পড়লে বোঝা যায় গ্রামীণ আবহে গল্পকারের স্বাচ্ছন্দ্যতা, নদী আর নারীর প্রতি এক অকৃত্রিম সহমর্মিতা সর্বোপরি নিত্য জীবন প্রবাহের উল্লেখযোগ্য রসদভা-ারের প্রতি লেখকের দায়। এসব মিলিয়েই কাদের পলাশের গল্পসমূহের গতিপ্রকৃতি, বিষয়বস্তু, নির্মাণ শৈলীর নিরবচ্ছিন্ন ধারা সবশেষে গন্তব্যে পৌঁছানো। ‘ত্রিকালদর্শী’ গল্পটি অন্য আঙ্গিকে, ভিন্ন মাত্রায়। সেটাও বাংলার এক অজ পাড়া গাঁ দোয়ালিয়া। গল্পকার নিজেই বললেন এক ভিন্ন তাৎপর্যে গল্পটি একটু আলাদা। ত্রিকালদর্শী ১৩৬ বছর বয়সী আম্বিয়া খাতুন বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের বাসিন্দা হওয়ায় অনাদরে, অবহেলায় এককোনে পড়ে আছেন। আরও উন্নত দেশ হলে তার নাম ওয়েবসাইটে চলে যেত। এখানে তথ্যপ্রযুক্তির বিকাশমান ধারাকেও পাঠকের সামনে হাজির করা হয়। প্রতিটি দেশে এমন ধরনের কিছু আলাদা বৈশিষ্ট্যের মানুষ থাকে যারা প্রযুক্তিবিদ্যার অভাবে জনসম্মুখে আসতে পারে না। এ রকম একটি বার্তা সামনে নিয়ে এসে গল্পকার বিজ্ঞান চেতনার প্রতি পাঠকের দৃষ্টি নিবদ্ধ করলেন। গ্রাম বাংলা আর আধুনিক প্রযুক্তির সুষ্ঠু অভিযোজনে দেশের সার্বিক উন্নয়ন যেমন হবে একইভাবে চিন্তা-চেতনা আর জ্ঞানভা-ারের উৎকর্ষও সেভাবে বেড়েই যাবে। সব মিলিয়ে বইটি সুখপাঠ্য এবং সচেতন পাঠককে প্রলুব্ধ করার মতো। তবে বাক্য গঠনে মাঝে মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে। সেদিকে লক্ষ্য রাখাও বাঞ্ছনীয়। গ্রন্থটির বহুল প্রচার কামনা করছি।
×