ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

গান কবিতা গীতিনাট্যে দেশপ্রেম - তৌফিক অপু

প্রকাশিত: ০৬:১৫, ২২ ডিসেম্বর ২০১৭

গান কবিতা গীতিনাট্যে দেশপ্রেম  - তৌফিক অপু

এই খানে ছিল কালো গ্রামখানি, আম কাঁঠালের ছায়া টানিয়া আনিত শীতল বাতাস কত যেন করি মায়া। তাহারি তলায় ঘরগুলো ভরে মমতা মুরতী হয়ে ছিল যে তাহারা ভাই-বোন আর বউ ছেলে-মেয়ে লয়ে। সুখের স্বপন জড়ায়ে ঘুড়ায়ে ছিল যে তাদের বেড়ে, আকাশ হইতে আসিত আশীষ দেবের ভবন ছেড়ে... কিসে কি হইল পশ্চিম হইতে নরধাতকেরা আসি সারা গাঁও ভরি আগুনে জ্বালায়ে হাসিল অট্টহাসি। মার কোল থেকে শিশুরে কাড়িয়া কাটিল যে খান খান পিতার সামনে শিশুরে কাটিল করিল রক্ত স্নান। কবিতাটি পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের লেখা। সেই দেশ ভাগ থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত অনাচারের কথা ফুটে উঠেছে কবিতাটিতে কবিতাটিতেও স্পষ্টভাবেই জালিমদের কথা উঠে এসেছে। সরাসারি প্রতিবাদ ছিল পাকিস্তানীদের বিপক্ষে। অনেক অবাক হয়েছিল এ ধরনের কবিতাটি পড়ে.. নরহন্তারা আজিকে হয়েছে শ্রেষ্ঠ ইমানদার লুণ্ঠনকারী জালিম নিয়েছে দেশের শাসন ভার নগরের পর নগর পুড়িছে বাজার বিপণি আর, দগ্ধপল্লী রয়ে রয়ে করে অগ্নির উদ্ধার। পল্লীর এমন মাটির কবির কাছ থেকে এভাবে বিদ্রোহী সুর বাজবে অনেকেই তা ভাবেনি। কবির এ প্রসঙ্গগুলো টানার কারণ হচ্ছে কবির হাতে সোদা মাটির গন্ধ যেমন থাকবে তেমন থাকবে গর্জে ওঠার হাতিয়ার। মুক্তিযুদ্ধের ভয়াবহতা, যোদ্ধাদের সাহসিকতা, হানাদার- রাজাকারদের বর্বরতা, শহীদের আত্মত্যাগ সবকিছুই যেন উঠে এসেছে যুদ্ধ পরবর্তী গান, কবিতা, গল্প-উপন্যাস কিংবা গীতিনৃত্য নাট্যে। সে ধারবাহিকতায় কবি জসীমউদ্দীন নিটোল গাঁয়ে কী ভয়াবহতা সৃষ্টি হয়েছিল তার বর্ণনা তুলে ধরেছেন। প্রতিবাদ করেছেন নরহন্তাদের বিরুদ্ধে। যা বর্তমান প্রজন্মকেও নাড়া দিচ্ছে। এসব কবিতার মাধ্যমে অবগত হচ্ছে কিভাবে দেশ স্বাধীন হয়েছিল, কিভাবে ছোট্ট একটি দেশ গেঁথেছিল বিজয়ের জয়মালা। সে সময়ের জনপ্রিয় কবি সাহিত্যিকদের কথা মালায় যে দেশ প্রেম ফুটে উঠেছে তারই ঘ্রাণ যেন নিচ্ছে তরুণপ্রজন্ম। বর্তমান সময়ে লেখা মুক্তিযুদ্ধের বর্ণনার চেয়ে বেশি প্রাধান্য পাচ্ছে সে সময়ে রচিত হওয়া গান, কাব্য কিংবা গীতিনাট্যে। কালের এ প্রবাহমানতায় সংস্কৃতি কর্মীদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। প্রতি নিয়ত ঝড়ঝঞ্ঝা উপেক্ষা করে শরীরে ও কণ্ঠে ধারণ করে গেয়ে গেছে বিজয়ের জয়গান। প্রেরণা যখন যশোর রোড মৌসুমী ভৌমিকের যশোর রোড গানটি কম বেশি সবারই জানা। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের শেষের দিকে মার্কিন কবি লেখক এ্যালেন গিন্সবার্গ কলকাতায় এসেছিলেন মুক্তিযুদ্ধের বর্ণনা ও শরণার্থীর প্রকৃত অবস্থা জানতে। সে সময়ে পূর্ব বাংলা এবং পশ্চিম বাংলা যাতায়াতের অন্যতম স্থলপথ ছিল যশোর রোড। বৃষ্টিতে রাস্তাঘাট জলমগ্ন থাকায় বহু কষ্টে বনগাঁ হয়ে যশোর রোডে এসে পৌঁছান। সেখানে প্রত্যক্ষ করেন আশ্রয় শিবিরে থাকা শরণার্থীদের। হৃদয়বিদারক সেসব কাহিনী তিনি তুলে এনেছিলেন তার কবিতায়। Millions of babies watching the skies Bellies swollen, with big round eyes On Jessore Road—long bamboo huts Noplace to shit but sand channel ruts Millions of fathers in rain Millions of mothers in pain Millions of brothers in woe Millions of sisters nowhere to go One Million aunts are dying for bread One Million uncles lamenting the dead Grandfather millions homeless and sad Grandmother millions silently mad Millions of daughters walk in the mud Millions of children wash in the flood A Million girls vomit & groan Millions of families hopeless alone শত শত চোখ আকাশটা দেখে, শত শত মানুষের দল, যশোর রোডের দুধারে বসত বাঁশের ছাউনি কাদামাটি জল। কাদামাটি মাখা মানুষের দল, গাদাগাদি করে আকাশটা দেখে, আকাশে বসত মরা ঈশ্বর, নালিশ জানাবে ওরা বল কাকে। ঘরহীন ওরা ঘুম নেই চোখে, যুদ্ধে ছিন্ন ঘরবাড়ি দেশ, মাথার ভেতরে বোমারু বিমান, এই কালোরাত কবে হবে শেষ। শত শত মুখ হায় একাত্তর যশোর রোড যে কত কথা বলে, এত মরা মুখ আধমরা পায়ে পূর্ব বাংলা কলকাতা চলে। সময় চলেছে রাজপথ ধরে যশোর রোডেতে মানুষ মিছিল, সেপ্টেম্বর হায় একাত্তর, গরু গাড়ি কাদা রাস্তা পিছিল লক্ষ মানুষ ভাত চেয়ে মরে, লক্ষ মানুষ শোকে ভেসে যায়, ঘরহীন ভাসে শত শত লোক লক্ষ জননী পাগলের প্রায়। পরবর্তীতে তা গানের রূপে তা বহির্প্রকাশ করেন মৌসুমী ভৌমিক। পুরো গানজুড়ে ফুটে উঠেছে প্রাণ নিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে ছুটে চলা নিঃস্ব মানুষগুলোর কথা। গানটি যেন মুক্তিযুদ্ধের এক প্রামাণ্য দলিল হিসেবে এখনও শোভা পায়। সে গানটিই আবার বর্তমান সময়ে এসে ধরা দিয়েছে গীতিনাট্য হিসেবে। একটি বাঁধনহারা গল্প এ বছরের ১৬ ডিসেম্বর সেক্টর কমান্ডার ফোরাম আয়োজিত বিজয় দিবস উৎসবে মঞ্চায়ন করা হয় যশোর রোড গীতিনাট্যটি। উপস্থিত সবার মধ্যে আলোড়ন সৃষ্টিকরে। যশোর রোড গানটির সঙ্গে পরিবেশিত হয় গীতিনাট্যটি, চোখের সামনে ভেসে উঠল সে সময়ের অবর্নীয় কষ্টের চিত্র। উপস্থিত দর্শকদের চোখের পানি কখন যে গাল বেয়ে মাটিতে পড়েছে তা হয়ত খেয়ালই করেনি কেউ। মুখ দিয়ে কথা না বলে শুধু মাত্র অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের পটচিত্র যে এত সুন্দর করে ফুটিয়ে তোলা যায় তা না দেখলে কেউ বিশ্বাস করবে না। গীতিনাট্যটি পরিবেশন করে নরসিংদীর দল বাঁধনহারা। গীতিনাট্যটি এবং বাঁধনহারার গল্প খুঁজতে গিয়ে জানা গেল আরও কিছু ভাল লাগার তথ্য। পুরো সংগঠনটি সুবিধা বঞ্চিত শিশুদের নিয়ে গড়া। ২০১২ সালে সে সময়ের নরসিংদী জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে প্রতিভাবান পথ শিশু বা সুবিধা বঞ্চিত শিশুদের অন্বেষণের মাধ্যমে বাঁধনহারার কার্যক্রম শুরু হয়। সাড়াও মিলে ভাল। প্রায় ৩০০ শিশুদের মাঝ থেকে বেছে নেয়া হয় ৭০ থেকে ৭৫ জনের একটি দল। এরপর শুরু তাদের অভিনয়ে শিক্ষাদান। প্রথমেই কঠিন একটি চ্যালেঞ্জ তার উতরাতে সক্ষম হয়। অর্থাৎ কোন মঞ্চ নাটকের জন্য প্রশিক্ষণ নয় একেবারেই গীতি নৃত্যনাট্যের জন্য তৈরি হওয়া। এবং সবার দৃষ্টি কাড়তেও তারা সক্ষম হয় এ যশোর রোড নামক গীতি নৃত্যনাট্য দিয়ে। এ প্রসঙ্গে বাঁধনহারার মুখ্য প্রশিক্ষক কামরুজ্জামান তাপু জানান, সুবিধা বঞ্চিত শিশুদের মধ্যে সংস্কৃতি ও দেশপ্রেম চেতনা জাগ্রত করতেই মূলত এ সংগঠনটি কাজ করে যাচ্ছে। আগে এই পথ শিশুরাই দেখা গেছে নানা রকম অনিয়ম ও বিশৃঙ্খলায় নিজেকে সম্পৃক্ত রাখত। কিন্তু এখন দৃশ্যপট অনেকটাই ভিন্ন। মন দিয়ে তারা পড়া লেখা করছে, পাশাপাশি সংস্কৃতি চর্চা তাদেরকে আলোর পথে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছে। তারা দেশ ও দেশপ্রেম সম্পর্কে জানতে পেরেছে। সত্যিকার অর্থে শুদ্ধ সংস্কৃতি চর্চা একজন মানুষকে মেধা ও মননে পরিপূর্ণ করে তুলতে বাঁধনহারা যেন সেটাই প্রমাণ করিয়ে দেখিয়েছে। ওরা এখন নিজেরাই উদ্যোগী হয়ে দেশপ্রেম ভিত্তিক নাটক, নৃত্যনাট্য মঞ্চায়নে ব্যস্ত। নৃত্যনাট্য যখন দেশপ্রেমের কথা বলে নাচ যে শুধু গান কিংবা বাজনার তালে মঞ্চস্থ করার বিষয় নয় তা প্রথম দেখা যায় ১৯৪৮ সালে। সামাজিক নৃত্যনাট্য ১৯৪৮ সালে রবিশঙ্কর চট্টোপাধ্যায় ঢাকার রূপমহল সিনেমা হলে ইন্দ্রসভা নামে একটি নৃত্যনাট্য মঞ্চস্থ করেন। এর বিষয়বস্তু ছিল হিন্দু পৌরাণিক দেবতা ইন্দ্রের রাজসভার কাহিনী। সদ্য স্বাধীন মুসলিম প্রধান দেশে এটাই ছিল প্রথম নৃত্যনাট্য। পরে ১৯৫২ সালে উপমহাদেশের প্রখ্যাত নৃত্যশিল্পী বুলবুল চৌধুরী ১৯৪৩ সালের মন্বন্তরের পটভূমিকায় ‘যেন ভুলে না যাই’ নৃত্যনাট্যটি মঞ্চস্থ করে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের মন জয় করেন। এরপর পারস্য কাহিনী অবলম্বনে হাফিজের স্বপ্ন ও ইরানের পান্থশালা শিরোনামে দুটি নৃত্যনাট্য মঞ্চস্থ করেন। ১৯৫৪ সালে এই মহান শিল্পীর মৃত্যুর পর ১৯৫৫ সালে তারই নামানুসারে ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত হয় বুলবুল ললিতকলা একাডেমি। এই একাডেমির প্রযোজনায় পল্লী­কবি জসীমউদ্দীনের অমর কাব্য নক্সী কাঁথার মাঠ নৃত্যনাট্যে রূপান্তরত হয় এবং জি.এ মান্নানের পরিচালনায় ১৯৫৮ সালে এটি মঞ্চস্থ হয়। এ নৃত্যনাট্যের নায়ক-নায়িকা রূপাই ও সাজুর বিয়োগান্ত প্রেমের কাহিনীতে নানা বিষয় উপস্থাপিত হয়েছে। রাজনৈতিক ও গণনৃত্যনাট্য ১৯৬৫ সালে পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধের পটভূমিকায় জি.এ মান্নান ‘কাশ্মীর’ শিরোনামে একটি নৃত্যনাট্য মঞ্চস্থ করেন। পরে ১৯৬৬ সাল থেকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিম-ল পুনরায় উত্তপ্ত হতে শুরু করে। এভাবে বারবার রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলার কারণে বাঙালী সংস্কৃতির অগ্রযাত্রা অনেকটাই ব্যাহত হয়। তা সত্ত্বেও নৃত্যশিল্পীরা তাদের সৃজনশীল প্রতিভাগুণে নতুন নতুন বাস্তবধর্মী নৃত্যনাট্য রচনা করেছেন, যাতে বাংলার মানুষের জীবন ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট প্রতিফলিত হয়েছে। এসব নৃত্যনাট্যে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, স্বৈরাচারী শাসকের বিরুদ্ধে গণআন্দোলন ইত্যাদির কথা রয়েছে। এ সময় সাম্রাজ্যবাদ, আধিপত্যবাদ, জোতদার, মজুতদার ও শোষণের বিরুদ্ধে অসংখ্য নৃত্যনাট্য রচিত হয়েছে। সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ড. এনামুল হক রচিত এবং রাহিজা খানম ঝুনু ও বাবুরাম সিং পরিচালিত রাজপথ জনপথ, উত্তরণের দেশে; হাবিবুল চৌধুরী পরিচালিত প্রতিরোধে বহ্নিমান এবং আমানুল হকের রচনা ও পরিচালনায় জ্বলছে আগুন ক্ষেতে খামারে, হরতাল, ওরা কাজ করে ও দিগন্তে নতুন সূর্য। এগুলো সবই বাংলাদেশের স্বাধীনতা পূর্বকালে রচিত ও মঞ্চায়িত হয়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর নৃত্যশিল্পীরা নতুন উদ্দীপনায় নৃত্যচর্চায় মনোনিবেশ করেন এবং তাদের সৃজনশীল প্রতিভাগুণে নতুন নতুন নৃত্যনাট্য রচিত হয়। সঙ্গত কারণেই সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গটি প্রাধান্য পায়। নৃত্যনাট্যের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। তখন মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক প্রথম নৃত্যনাট্য বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ‘জুলিও কুরি শান্তি পদক’ প্রাপ্তির সম্মানে আয়োজিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে আমানুল হকের পরিচালনায় মঞ্চস্থ হয়। এর কিছুদিন পর একই চিত্রে নবারুণ শিরোনামে আরেকটি নৃত্যনাট্য যৌথভাবে পরিচালনা করেন জি.এ মান্নান, গওহর জামিল ও আলতামাস আহমেদ। মঞ্চনৃত্যনাট্য ছাড়াও বাংলাদেশ টেলিভিশনেও একাধিক নৃত্যনাট্য পরিবেশিত হয়েছে। সেগুলোর মধ্যে রয়েছে নজরুলের কাজরী, রবীন্দ্রনাথের কাব্য অবলম্বনে শাহজাহানের স্বপ্ন, জসীমউদ্দীনের মধুমালতী, জাগরণমূলক সূর্য তোরণ, অরুণাচলের পথে, সার্কভুক্ত সাতটি দেশের প্রতীকে সাতটি তারার দেশ, আরব্য উপন্যাসের কাহিনী অবলম্বনে আলীবাবা ও চল্লিশ চোর, গ্রাম্য পটভূমিতে বাঁশরী ও কিষাণীর স্বপ্ন, খরার ওপর ভিত্তি করে মেঘ রাজা মেঘ দে, মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিকায় ওরা এ মাটির সন্তান ইত্যাদি। নৃত্যনাট্যগুলো পরিচালনা করেছেন যথাক্রমে জিনাত বরকতউল্লাহ, মোস্তফা মনোয়ার, জি.এ মান্নান, রাহিজা খানম ঝুনু, বরকতউল্লাহ, গোলাম মোস্তফা খান এবং আমানুল হক। একটা বিষয় বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে, দেশে যখনই কোন সঙ্কট এসেছে রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, প্রাকৃতিক কিংবা সাংস্কৃতিক, শিল্পীরা তাৎক্ষণিকভাবে সেসব বিষয়ের ওপর নৃত্যনাট্য রচনা করেছেন। নানা রকম উপকরণ ও টেকনিকের সাহায্যে সৃষ্টি করেছেন মানসম্পন্ন নৃত্যনাট্য, যা কেবল মানুষকে আনন্দ দিতে নয় বরং প্রেরণাও জুগিয়েছে। উদ্বুদ্ধ করেছে দেশপ্রেমে। সংস্কৃতি কর্মীরা যেন প্রতিবারেই একেক জন দেশ যোদ্ধা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। মঞ্চনাটক গুলো যেন একখ- মানচিত্র বিশ্বায়নের সূচনা তখনও শুরু হয়নি। তবে থেমে থাকেনি সংস্কৃতি চর্চা এবং এর বিকাশ। টেলিভিশন, ইউটিউব কিংবা ফেসবুক না থাকলেও, সামনা সামনি মানুষ কে জাগ্রত করার অনেক উপায় ছিল। তার মধ্যে মঞ্চ নাটক অন্যতম। মঞ্চের সামনে বসে থাকা দর্শকগুলো নাটক দেখত আর ভাবত এ বুঝি দেশেরই একটি খ-িত অংশ। মানুষের মনে বিনোদন সঞ্চার থেকে শুরু করে সময়ে সময়ে দেশের হয়ে প্রতিবাদ করাও যেন মঞ্চ নাটকের বিশেষ বৈশিষ্ট। নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণা জোগান দেয়া কিংবা দেশপ্রেমে জাগ্রত করার কাজ সুনিপুণভাবে করে গেছে মঞ্চ নাটকগুলো। এখনও যেসব নাটক দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করে কিংবা মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট তুলে আনে সেসব নাটকের মধ্যে, জয়জয়ন্তী, যুদ্ধ এবং যুদ্ধ, পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়, একাত্তরের পালা, মুখোশ, কিংশুক, যে মরুতে, বিবিসাব, সময়ের প্রয়োজনে, খারন্নি, বলদ, নূরুলদীনের সারাজীবন, কোর্ট মার্শাল, সাত ঘাটের কানাকড়ি অন্যতম। এখনও মঞ্চকর্মীরা দেশের পতাকা তুলে ধরতে, দেশপ্রেমে তরুণ প্রজন্মকে উদ্বুদ্ধ করতে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। গান ও কবিতা যেন নয় ওসব দেশেরই কথা আমাদের বাঙালী সত্ত্বায় বড় একটা অংশজুড়ে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধ। যে যুদ্ধে মিলেছে নিজেদের আত্মপরিচয়। আর অনেক আত্নদানের মধ্য দিয়েই মিলেছে এ অর্জন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে বড় একটি অংশজুড়ে ছিল মুক্তিযুদ্ধের গান ও কবিতা। যা সে সময়ে যোদ্ধাদের প্রেরণা যুগিয়েছে। যুদ্ধ জয়ের অন্যতম দাবিদার এ সকল প্রেরণাদায়ক গান ও কবিতা। সে সকল গান ও কবিতা এখন পরিবেশন করা হচ্ছে নতুন প্রজন্মের সামনে। গান ও কবিতার আবহমানতায় দেশের প্রতি যেন মাথা নত হয়ে যায়। বার বার কুর্নিশ জানাতে ইচ্ছে হয়। একাত্তর সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ নামে বিশ্বের মানচিত্রে এক নতুন রাষ্ট্রের উদয় হলো। মুক্তিযুদ্ধ কবি মানসে প্রচন্ড- উত্তেজনা সৃষ্টি করেছিল। তার খানিকটা ধরা পড়ে প্রখ্যাত কবি শামসুর রাহমানের ‘ টেলেমেকাস’ নামক কবিতায়। হোমারের মহাকাব্য ওডিসির কাহিনী কবিতাটির প্রেরণা। অডিসিউস যখন দেবতার অভিশাপে সমুদ্রে দিকভ্রষ্ট তখন বিভিন্ন দেশের রাজা অডিসিউসের পত্নী পেনেলোপকে বিবাহ করে ইথাকা দখল করতে চেয়েছিল। তাদের থামানোর জন্য পেনেলোপ একটি কৌশল অবলম্বন করেন। তিনি একটি কাপড় বুনছিলেন, বলেন, এটি বোনা শেষ হলে স্বয়ম্বরা হবেন। কিন্তু দিনের বেলায় তিনি যা বুনতেন রাতের বেলায় তা খুলে দিতেন। সুতরাং বোনা আর শেষ হয় না। অন্যদিকে তার পুত্র টেলেমেকাস পিতার প্রত্যাবর্তনের জন্য অধীর আগ্রহে বসে আছেন। এই কাহিনী শামসুর রাহমান কীভাবে তার কবিতায় ব্যবহার করেছেন অত্যন্ত দক্ষ হাতে। তিনি ঢাকাকে ইথাকা আর নিজেকে টেলেমেকাস রূপে দেখেছেন। আর পশ্চিম পাকিস্তানি যেন আগ্রাসী বিদেশী রাজ্য। তিনি চাইছেন পিতা অডিসিউসকে, অর্থাৎ ঢাকার পরিত্রাতাকে ... ইথাকায় রাখলে পা দেখতে পাবে রয়েছি দাঁড়িয়ে দরোজা আগলে, পিতা, অধীর তোমারই প্রতীক্ষায়। এখনো কি ঝঞ্ঝাহত জাহাজের মাস্ত্তল তোমার বন্দরে যাবে না দেখা? অস্ত্রাগারে নেবে না আয়ুধ আবার অভিজ্ঞ হাতে? তুলবে না ধনুকে এ টঙ্কার?’ এমন কবিতা কার মনে না শিহরণ জাগায়। মনে করিয়ে দেয় দেশরক্ষার পিতার অবদানকে। স্বাধীনতা তুমি কবিতাটি স্বাধীনাতার রস আস্বাদন করার সুযোগ দেয় আজও। আর গানে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র যা দিয়েছে তা আজও কানে বাজে। মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি.. গানটি এখনও শিহরণ জাগায়। কিংবা সবকটা জানালা খুলে দাও না..শুনলে শহীদের আত্ন ত্যাগের কথা মনে আসে। এত অসংখ্য গান কবিতা রয়েছে দেশকে উৎসর্গ করে তা একটি লেখায় শেষ করার নয়। দেশের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ জাগাতে এ গান কবিতা যেন বুলেটের মতো কাজ করে। কবি কিংবা কণ্ঠ যোদ্ধারা আজও তাদের যুদ্ধ থামায়নি। গেয়ে যাচ্ছে দেশের জয়গান। ফেসবুক-ইউটিউবও ধারণ করছে দেশপ্রেম বর্তমান প্রজন্ম যেন বুঁদ হয়ে আছে ফেসবুক কিংবা ইউটিউবে। যে কারণে বর্তমান সময়ে গান কবিতা কিংবা নাটক সবকিছুই আবর্তিত হচ্ছে ফেসবুককে কেন্দ্র করে। থেমে নেই অনলাইন যুদ্ধ। সংস্কৃতি কর্মীরা অনলাইন কেও দেশ প্রেমে জাগ্রত হওয়ার হাতিয়ার হিসেবে নিয়েছে। এবং তারা সফল। দেশ প্রেমে উদ্বুদ্ধ এবং সংস্কৃতির সঙ্গে সম্পৃক্ততা একজন মানুষ পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে সহায়তা করে। গান, নৃত্যনাট্য, কবিতা, পুথি কিংবা নাটক যাই বলা হোক না কেন সবকিছুই যেন সময়ের কথা বলে, দেশের কথা বলে সর্বোপরী দেশপ্রেমের কথা বলে। আবহমান কাল ধরে সংস্কৃতিক অঙ্গন যেন নীরবেই যুদ্ধ করে চলছে অপসংস্কৃতির বিপক্ষে, অবক্ষয়ের বিপক্ষে। এটা পরীক্ষিত সংস্কৃতি অঙ্গন যেভাবে দেশ প্রেম, কৃষ্টি কালচার কিংবা ঐতিহ্য যেভাবে ধরে রেখেছে তা অনেকেই হয়ত পারেনি। তাই সর্বত্রই প্রয়োজন সুস্থ সংস্কৃতির চর্চা।
×