ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

স্বাধীন বাংলা বেতারের কণ্ঠসৈনিক শীলা মোমেন

প্রকাশিত: ০৬:০৮, ২২ ডিসেম্বর ২০১৭

স্বাধীন বাংলা বেতারের কণ্ঠসৈনিক শীলা মোমেন

১৯৭১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি (স্নাতক) বিভাগের ছাত্রী শীলা মোমেন ক্যাম্পাসের রোকেয়া হলের চৌহদ্দীতে বসে শুনেছিলেন ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধুর জোরালো কণ্ঠের দীপ্ত আওয়াজ। যা দেশমাতৃকার শৃঙ্খল মোচন থেকে শুরু করে অধিকার আদায়ের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হওয়ার এক যুগান্তকারী দীপ্ত প্রত্যয়। যে আদর্শিক বোধে ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলা বেতারে জাতির চরম দুঃসময়ে কণ্ঠে সংগ্রামী চেতনা ধারণ করে মুক্তিযুদ্ধে নিজের অংশীদারিত্বকে নিরন্তর করতে পিছপা হননি। স্বাধীনতার সূর্যোদয়ের আগ অবধি যেখান থেকে অন্যদিকে ফিরে তাকানোর অবকাশই কখনও পাননি। যে লড়াকু গতিময়তায় ক্লান্তি আর অবসাদের কোন সুযোগই হয়নি। সেই সব সংগ্রামী স্মৃতিচারণ আজও তাকে বলিষ্ঠ প্রত্যয়ে সম্ভাবনাময় বাংলাদেশ গড়ার দীপ্ত শপথে উদ্বুদ্ধ করে। মুক্তিযুদ্ধের সংগ্রামী অভিযাত্রায় নিজের কণ্ঠকে উজাড় করে শীলা মোমেন যে লড়াকু যোদ্ধার কাতারে অভিষিক্ত হন সেখানে তিনি একজন যথার্থ মুক্তির সৈনিক বললে বোধহয় বেশি বলা হবে না। তার সঙ্গে কথা বলেছেন -নাজনীন বেগম চট্টগ্রামের এক আলোকিত পরিবারের কন্যা শীলা দাশ শৈশব, কৈশোর পার করেন শিক্ষা এবং সাংস্কৃতিক পরিম-লের এক বিশুদ্ধ আবহে। পিতা এ্যাডভোকেট চিত্তরঞ্জন দাশ চট্টগ্রামের একজন স্বনামধন্য আইনবিদ। মা পুতুল রানী দাশ স্নেহশীল মাতৃমহিমার অনির্বাণ দীপ্তি। যে কারণে শীলার জীবন গড়ার প্রয়োজনীয় সময়টুকু নির্মল সাহচর্যে ভরে ওঠে। বাল্যকাল থেকে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রম নিয়েই শুধু জীবনের লক্ষ্যকে স্থির করেননি বরং সঙ্গীত সাধনায় নান্দনিক বোধকেও প্রতিনিয়ত সজাগ রেখেছেন। তাই স্কুল-কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্ঞানচর্চার অনুষঙ্গ হিসেবে সঙ্গীত জীবনকেও বিবেচনায় এনেছেন। শুদ্ধ সঙ্গীত চর্চায় উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত থেকে শুরু করে প্রাচীন বাংলার গানের ধারাকে যেভাবে লালন করেছেন একইভাবে রবীন্দ্রনাথের গানে ও নিজেকে নিবেদিত শিল্পী হিসেবে গড়ে তোলেন। তাঁর সঙ্গে কথা বলে জানা যায় উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতে তালিম নিতে গিয়ে গুরু হিসেবে যাঁকে পেয়েছিলেন তিনি ভারতের আগ্রা ঘরানার গায়ক, সঙ্গীত রিসার্চ একাডেমির প্রাক্তন পরিচালক প-িত বিজয় কিচলু। আর রবীন্দ্র সঙ্গীতের শিক্ষা গুরু হিসেবে রবীন্দ্রনাথের সাক্ষাত শিষ্য শৈলজারঞ্জন মজুমদারের কাছে গান শেখার অভিজ্ঞতা আজও শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন। এছাড়াও আছেন রবীন্দ্রসঙ্গীত শিক্ষক ও গবেষক সুভাষ চৌধুরী, শান্তি নিকেতনের সঙ্গীত ভবনের শিক্ষক নীলিমা সেন যাঁদের অকৃত্রিম সান্নিধ্য আর তালিম কখনও ভুলবার নয়। আর বাংলাদেশের প্রখ্যাত রবীন্দ্র সঙ্গীতজ্ঞ, ওয়াহিদুল হকের সার্বক্ষণিক ছায়া তো ছিলই। সেই ধারাবাহিকতায় আজও তিনি সঙ্গীতের নিবেদিত সাধক। বেতার এবং টেলিভিশনের নিয়মিত কণ্ঠশিল্পীও তিনি। যে অবিচলিত সাহস আর দীপ্ত মনোবলে স্বাধীনতার সংগ্রামী অভিযাত্রায় কণ্ঠকে শাণিত করেছিলেন সেই চেতনায় আজও আলোড়িত হন। এই বোধে অপরাজনীতি, পেশীশক্তি, ধর্মীয় উন্মাদনা কিংবা শুদ্ধ বাঙালী সংস্কতির ওপর হরেক রকম আগ্রাসনে উদ্বেগ-আশঙ্কা হলেও বিশ্বাস করেন ঐতিহ্যিক বাংলার চিরায়ত সম্ভার নষ্ট করার অধিকার কিংবা ক্ষমতা কারও নেই। সাহসী এবং প্রতিকূল সময়ের যথার্থ কা-ারী শীলা মোমেন মুক্তি সংগ্রামের শ্বাপদসঙ্কুল পথ পরিক্রমায় বহু আন্দোলন আর লড়াইয়ের সহযাত্রী। চট্টগ্রামের সরকারী খাস্তগীর উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় থেকে এসএসসি এবং চট্টগ্রাম সরকারী কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে ভর্তি হন। ফলে ’৬৮-এর আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা এবং ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান তাঁর ছাত্র জীবনের সংগ্রামী উন্মাদনার বিশেষ কাল পর্ব। যা তার আদর্শিক চেতনার সঙ্গে অধিকার আদায়ের লড়াই ও এক অবিচ্ছিন্ন ধারায় তাঁকে তৈরি করতে থাকে। সময়ের দাবি মেটাতে গিয়ে কঠিন প্রত্যয়ে নিজের চেতনাকে সেভাবে শাণিতও করেছেন সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে। সেই লক্ষ্যমাত্রায় ’৭০ সালের নির্বাচন এবং ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের রক্তাক্ত আর অগ্নিঝরা বলয়ে নিজেকে সম্পৃক্ত করতে মোটেও ভাবতে হয়নি। ’৭০এর নির্বাচন সারা বাংলা বঙ্গবন্ধুর দৃঢ় নেতৃত্বে যেভাবে একতাবদ্ধ হয় তা প্রতিটি দেশপ্রেমিক বাঙালীর স্বাধীনতার চেতনাকে নানামাত্রিকে উদ্বুদ্ধ করে। আর ’৭১ এর বিভীষিকাময় দুঃসময় এখনও স্মৃতির মিনারে জ্বলজ্বল করছে। মাতৃভূমির শৃঙ্খল মোছার দীপ্ত অঙ্গীকারে নিজ দেশের সীমানা পেরিয়ে আগরতলা দিয়ে কলকাতায় অনুপ্রবেশ আজও জীবনের দুঃখ বেদনায় ভারাক্রান্ত এক দুঃসহ স্মৃতি। ততদিনে পাকিস্তানী সামরিক জান্তা চট্টগ্রাম শহর এবং গ্রামের পৈত্রিক নিবাস লুটতরাজ এবং অগ্নিসংযোগ করে বিপর্যস্ত অবস্থায় নিয়ে যায়। বাংলাদেশের এমন সঙ্কটাপন্ন অবস্থা পরবর্তীতে কলাকাতায় গিয়ে শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেয়া থেকে শুরু করে মুক্তি সংগ্রামী শিল্পী সংস্থার সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত করা সত্যিই এক সংগ্রামী অভিঘাত। স্মৃতিময় এসব দিনগুলো আজও মুক্তি সংগ্রামের বলিষ্ঠ প্রত্যয় হিসেবে চেতনায়-মননে একাত্ম হয়ে আছে। ১৯৭১ সালে মুক্তি সংগ্রামী শিল্পী সংস্থার সদস্য হিসেবে ভারতের বিভিন্ন শরণার্থী শিবির, মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং ক্যাম্প এবং স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে গান পরিবেশন করা শুধু স্মরণীয়ই নয় তার চেয়েও বেশি লড়াকু পরিস্থিতিতে দীপ্ত চেতনায় কণ্ঠে সুর ও বাণীর ঝংকারে মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষ অংশ নেয়ার এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতাও। আজও মন থেকে সেই স্মৃতি মুছে যায়নি যেদিন প্রথম জাতীয়ও সংগ্রামী সঙ্গীতের মাধ্যমে লাল সবুজের পতাকাকে তুলে ধরা হয়েছিল। ১৯৭১ সালে ৬ ডিসেম্বর প্রথম কলকাতায় বাংলাদেশ হাইকমিশনের সামনে এই ঐতিহাসিক আর ঐতিহ্যিক মুহূর্তটি তাদেরকে আনন্দাবেগে পরিপূর্ণ করেছিল। বিজয় নিশানাকে স্বাগত জানানোর পরবর্তী স্থান ছিল বাংলাদেশের যশোর জেলায় যেখানে হানাদারমুক্ত স্বাধীনতার পতাকা উড়ানো হয়। এই পতাকা উত্তোলনেও মুক্তি সংগ্রামী শিল্পী সংস্থার কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছিল ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসীসহ আরও অনেক দেশপ্রেমের উদাত্ত আবাহন সঙ্গীত। শীলা মোমেন মনে করেন সময়ের স্রোতধারায় সেই দুর্লভ মুহূর্তগুলো আজও তাঁকে আবিষ্ট করে, ফিরে যান সেই সব প্রয়োজনীয় কালপর্বে যা এখনও গৌরবের স্বর্ণ শিখরে। এক সময় লাল সবুজের সেই পতাকা স্থায়ীভাবে আসন গাড়ে ১৬ ডিসেম্বর রাজধানী ঢাকায়। পরাধীনতার হাত থেকে দেশকে শৃঙ্খলমুক্ত করার দৃপ্ত শপথে যে কণ্ঠ সঙ্গীতের ঝংকারে অনবদ্য হয়ে উঠেছিল আজও তার নিরন্তর ধারা বয়ে চলেছে বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথের বাণী আর সুরে এখনও বিভোর হন, মুগ্ধতার আবেশে রবীন্দ্রনাথে নিবেদিত হয়ে নিজেকে সম্পূর্ণরূপে উজাড় করে দেন। শুধু রবীন্দ্র সঙ্গীতেই নয় আবহমান বাংলার চিরায়ত গানের ভা-ারও তাঁর কণ্ঠে নিবেদনের স্তুতিতে অতুলনীয় হয়ে ওঠে।
×