ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

বিজয় মাসে নতুন প্রজন্মকে নিয়ে দর্শনার্থীদের ভিড়

জাতীয় জাদুঘরের নতুন আকর্ষণ স্বাধীন বাংলা বেতারের গ্যালারি

প্রকাশিত: ০৫:১৯, ২২ ডিসেম্বর ২০১৭

জাতীয় জাদুঘরের নতুন আকর্ষণ স্বাধীন বাংলা বেতারের গ্যালারি

সোহেল তানভীর ॥ মুন্নি, শরিফুল, নাজমা, হানিফসহ পাঁচ-ছয় জনের একটি ছোট্ট দল। দাঁড়িয়ে আছেন বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের ভেতরে একটি বেতার যন্ত্রের সামনে। বেতারে চলছে বিপ্লবী ও দেশাত্মবোধক গান। কানপেতে তারা বেতারের সেই ধ্বনিগুলো শুনছেন। হঠাৎ বেতার যন্ত্রে ভেসে আসে- ‘জয় বাংলা, বাংলার জয়, হবে হবে, হবে নিশ্চয়, কোটি প্রাণ একসাথে, জেগেছে অন্ধরাতে, নতুন সূর্য ওঠার এই তো সময়।’ দশ বছরের মেয়ে মিমিকে ডেকে মা মুন্নি বললেন, মনোযোগ দিয়ে শুন। মুক্তিযুদ্ধের সময় এই দেশাত্মবোধক সংগ্রামী গানগুলো শুনে মুক্তিযোদ্ধারা অনুপ্রাণিত হয়েছিল। মিমি অবাক হয়ে শুনতে লাগলো স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ধ্বনিগুলো। রাজধানীর শাহবাগ জাতীয় জাদুঘরে ছোট-বড়, ছেলে-বুড়ো সব শ্রেণী পেশার মানুষ এখন ভিড় জমান স্বাধীন বাংলা বেতারের স্মৃতিচিহ্ন দেখার জন্য। ডিসেম্বর মাসের জন্য দর্শনার্থীদের আগমন অনেকটা বেশি বলে জানা গেছে। গত বছর স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র প্রদর্শনকক্ষ নামে নতুন একটি গ্যালারি সংযুক্ত করা হয়েছে। জাদুঘরের ৩৮ নম্বর গ্যালারি কক্ষকে ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের’ কক্ষে পরিণত করা হয়েছে। গ্যালারিটি অত্যন্ত আধুনিক করে প্রদর্শন করা হয়েছে। নাম দেয়া হয় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র প্রদর্শন। সহযোগিতায় ছিল চ্যানেল আই। জাদুঘরের ভবনের গ্যালারিতে রয়েছে হাজার হাজার নিদর্শন। কেবল বাংলাদেশেই নয়, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে এটি অন্যতম বৃহৎ জাদুঘর। নতুন প্রজন্মকে বাংলাদেশের ইতিহাস ও সভ্যতার প্রতিটি ধাপের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয় এই প্রতিষ্ঠান। এর আগে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের জন্য আলাদা কোন প্রদর্শন ছিল না। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের স্মৃতিগুলো অনেকদিন ছিল একটু বিক্ষিপ্ত। সেই স্মৃতিগুলোকে একত্রিত করে গত বছর একটি গ্যালারিতে সংরক্ষণ করা হয়েছে। নেপথ্যে থেকে মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকা রাখায় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের স্মৃতিগুলোকে আলাদা একটি গ্যালারিতে প্রদর্শন করা হয়েছে বলে জানান জাদুঘরের মহাপরিচালক ফয়জুল লতিফ চৌধুরী। তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে বিপ্লবী ও দেশাত্মবোধক গান রণাঙ্গনের যোদ্ধাদের উদ্দীপ্ত করত। সেই সূত্রে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের সঙ্গে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ইতিহাস অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। নেপথ্যে থেকে মুক্তিযুদ্ধের ভূমিকা রাখায় জাদুঘরের সঙ্গে সম্পৃক্ত করা হয় ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’কে। বিভিন্ন জায়গা থেকে এই স্মৃতিগুলোকে আমরা সংরক্ষণ করেছি। মানুষ নিয়মিত আসছে এবং অবাক হয়ে দেখছে। কক্ষটিতে প্রবেশ মুখে দেখা মিলবে কলকাতার ৫৭/৮ বালিগঞ্জের সেই ঐতিহাসিক ভবন, যেখান থেকে সম্প্রচার হতো স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান। বাঁপাশ থেকে ছোট্ট তিনটি ভিডিও স্ক্রিনে তুলে ধরা হচ্ছে কেন্দ্রের বিভিন্ন চিত্র। দেখা মিলবে বেতার কেন্দ্রের অন্যতম সংগঠক কামাল লোহানীর ছবি, বেতার কেন্দ্রে ব্যবহৃত যন্ত্র ‘জিপসি’ ও ‘বাঁশি’ এবং কেন্দ্রের কর্মীদের ব্যবহৃত চায়ের কাপ। পাশেই দেখা মিলবে একটি সাধারণ রেজিস্টার খাতা। ওই সময়কালে শিল্পীদের পারিশ্রমিকের হিসাব লিখে রাখা হতো এ খাতায়। এছাড়াও রয়েছে বেশ কিছু দলিল-দস্তাবেজ-পত্র। দ্বিতীয় কক্ষে রয়েছে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত কথিকা চরমপত্র, সংবাদ, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের গান শোনানোর ব্যবস্থা। একটি তাকে রাখা হয়েছে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র বই। আছে বেতার যন্ত্র। যাত্রাবাড়ী থেকে মুন্নি পরিবারের কয়েজনকে নিয়ে আসেন জাতীয় জাদুঘরে। তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, আমাদের স্বাধীনতা অত্যন্ত কষ্টের। সেই স্বাধীনতার স্মৃতিগুলো দেখতে আমি জাদুঘরে প্রায়ই আসি এবং অন্যদের আসার জন্য উৎসাহিত করি। কারণ এখানে আসলে দেশের ইতিহাস ঐতিহ্য সম্পর্কে অনেক কিছু জানা ও শেখা হয়। তিনি বলেন, এবার আমার বাচ্চাকে নিয়ে এসেছি সে যেন দেশের ইতিহাস জানতে পারে। দেশের ইতিহাস জানলে ভবিষ্যতে সে ভুল পথে পা বাড়াবে না। শরিফুল ইসলাম বলেন, মুক্তিযুদ্ধ আমাদের চেতনার সঙ্গে মিশে আছে। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি আমাদের সামনে এগিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা যোগায়। মুক্তিযুদ্ধের সময় অসামান্য অবদান রেখেছিল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র। আলাদা গ্যালারিতে স্থান দেয়ায় মাধ্যমে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রকে প্রাপ্ত মর্যাদা দেয়া হয়েছে। এই স্মৃতিগুলো যুগ যুগ ধরে আমাদের জন্য নিদর্শন হয়ে থাকবে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশনাগুলো তখন স্বাধীন বাংলা বেতারের বজ্রকণ্ঠ অনুষ্ঠানে নিয়মিত শোনানো হতো। তাতে মুক্তিযোদ্ধারা অনুপ্রাণিত হয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তো। স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের জয়ের বীরত্বের খবরগুলো আসত। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রেরণা দিতে সমবেত গান ও নাটক পরিচালিত হতো। ১৯১৩ সালের ৭ আগস্ট ‘ঢাকা জাদুঘর’ নামে যাত্রা শুরু করেছিল জাতীয় জাদুঘর। স্বাধীনতার পর ১৯৮৩ সালে একে ‘বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর’ নামে অভিহিত করা হয়।
×