ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

জঙ্গীবাদ মোকাবেলায় ঢাকার পরামর্শ চাইছে ৫ দেশ

প্রকাশিত: ০৫:১৬, ২২ ডিসেম্বর ২০১৭

জঙ্গীবাদ মোকাবেলায় ঢাকার পরামর্শ চাইছে ৫ দেশ

গাফফার খান চৌধুরী ॥ জঙ্গীবাদ মোকাবেলায় বাংলাদেশের পরামর্শ নিচ্ছে বিভিন্ন দেশ। দেশগুলোতে জঙ্গীবাদ মাথাচাড়া ওঠার চরম ঝুঁকি রয়েছে। এসব দেশের মধ্যে রয়েছে জাপান, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর ও ফিলিপিন্স। আর ভারতের সঙ্গে যোগাযোগ আরও বেড়েছে। এক দেশের জঙ্গী অন্যদেশে গ্রেফতারের পর তাদের জিজ্ঞাসাবাদ ও তথ্য আদান-প্রদান প্রক্রিয়া আরও সহজ হচ্ছে। পরামর্শ নেয়া দেশগুলোর মধ্যে জাপান জঙ্গীবাদ মোকাবেলায় যেকোন মূল্যে বাংলাদেশের পরামর্শ পেতে প্রস্তুত। গুলশানের হলি আর্টিজানে হামলায় সাত জাপানী নিহত হওয়ার পর দেশটি জঙ্গীবাদ মোকাবেলায় জিরো টলারেন্স নীতি ঘোষণা করে। হলি আর্টিজানের ঘটনার পর স্বল্প সময়ের মধ্যে জঙ্গীবাদ মোকাবেলায় ব্যাপক সাফল্য দেখানোয় জাপান সবচেয়ে খুশি বাংলাদেশের ওপর। জাপান নির্ভয়ে তাদের নাগরিকদের বাংলাদেশে বসবাস ও যাতায়াত করার কথা বলেছে। প্রযুক্তির মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া জঙ্গীবাদকে প্রযুক্তি দিয়েই মোকাবেলা করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। পুলিশ সদর দফতরের ইন্টেলিজেন্স এ্যান্ড স্পেশাল এ্যাফেয়ার্স বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, জঙ্গীবাদের ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর ওপর বিশেষ জরিপ চালিয়েছে জাতিসংঘ। জঙ্গীবাদের ঝুঁকি কমাতে জাতিসংঘের তরফ থেকে পরামর্শ দেয়া হয়েছে। অন্যথায় জঙ্গীবাদের ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোতে অর্থনৈতিক মন্দা, অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়া, বিনিয়োগের পরিবেশ বিনষ্ট হওয়া, বিদেশী প্রকল্প বন্ধ হয়ে যাওয়া, দাঙ্গা হাঙ্গামাসহ নানা ধরনের সমস্যার সৃষ্টি হবে। যা দেশটির ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলবে। জঙ্গীবাদ মোকাবেলায় করণীয় সম্পর্কে একটি বিশেষ মতবিনিময় সভার আয়োজন করে জাতিসংঘ ও জাপান সরকার। গত ১১-১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত জাপানে ওই সভা হয়। সভায় জঙ্গীবাদের ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর মধ্যে জাপান, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ফিলিপিন্স ও সিঙ্গাপুর সরকারের উচ্চপর্যায়ের একটি করে প্রতিনিধি দল উপস্থিত ছিল। সভায় জঙ্গীবাদ মোকাবেলায় বাংলাদেশকে রোলমডেল হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। বলা হয়, হলি আর্টিজানের মতো ঘটনার পর বাংলাদেশ স্বল্প সময়ে জঙ্গীবাদ মোকাবেলায় আশাতীত সাফল্য দেখিয়েছে। এমনকি জঙ্গীবাদ মোকাবেলায় বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা নিজেদের জীবন পর্যন্ত উৎসর্গ করতে দ্বিধা করেন না। তার উদাহরণও দেয়া হয় সভায়। কোন দেশের পক্ষে স্বল্প সময়ের মধ্যে এমন সাফল্য দেখানো প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। অবিশ্বাস্য। এজন্য বাংলাদেশ জঙ্গীবাদ মোকাবেলায় কোন পদ্ধতিতে কাজ করে তা উপস্থাপন করতে বলা হয়। বাংলাদেশের সাত সদস্যের প্রতিনিধি দলের নেতৃত্বে দেন অতিরিক্ত সচিব শাহ ইমদাদুল দস্তগীর। সভায় জঙ্গীবাদ মোকাবেলায় বাংলাদেশের পদ্ধতি উপস্থাপন করেন পুলিশ সদর দফতরের ইন্টেলিজেন্স এ্যান্ড স্পেশাল এ্যাফেয়ার্সের উপ-মহাপরিদর্শক মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান। তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, অংশ নেয়া দেশগুলো সরকারীভাবে না হলেও বেসরকারীভাবে জঙ্গীবাদের চরম ঝুঁকিতে থাকার কথা স্বীকার করেছে। আলোচনায় জানা গেল, সবচেয়ে বেশি উদ্বিগ্ন জাপান। হলি আর্টিজানে জঙ্গী হামলায় সাত জাপানীর মৃত্যুর পর দেশটি বাংলাদেশে জঙ্গীবাদ আরও ব্যাপকভাবে মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে বলে ধারণা করেছিল। এজন্য তারা বাংলাদেশে থাকা তাদের নাগরিকদের বাড়তি সতর্কতার পাশাপাশি দেশত্যাগসহ নানা বিষয়ে পরামর্শ দিয়েছিল। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে দ্রুততার সঙ্গে জঙ্গীবাদ নির্মূল করার আশ্বাস দিলেও জাপানের কাছ থেকে কোন সদুত্তর মিলছিল না। বাংলাদেশের উন্নয়ন কর্মকা-ের সঙ্গে যুক্ত থাকা অনেক জাপানী ভয়ে দেশত্যাগ করেন। এতে বাংলাদেশের উন্নয়ন কর্মকা- ব্যাহত হয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে শুধু জাপানী নয়, অন্যান্য বিদেশীদেরও সেই ভয় কেটে গেছে। জাপানীরা আবার বাংলাদেশে ফিরে এসেছেন। জাপানও তাদের নাগরিকদের নির্ভয়ে বাংলাদেশে যাতায়াত ও অবস্থান করার কথা জানিয়েছে। এই কর্মকর্তা বলছেন, সভায় সার্বিক আলোচনায় হালের জঙ্গীবাদ প্রযুক্তির মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ছে বলে অংশ নেয়া দেশগুলো একমত হয়। এজন্য প্রযুক্তির মাধ্যমেই জঙ্গীবাদ মোকাবেলা করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। কোন কোন খাতকে দ্রুততার সঙ্গে প্রযুক্তির আওতায় আনতে হবে তার ফিরিস্তি তুলে ধরা হয়। জঙ্গীবাদ মোকাবেলা করতে হলে দেশের মানুষসহ তাদের কর্মকা-ের প্রতি ক্ষেত্রকে একটি পূর্ণাঙ্গ ডেটাবেজের আওতায় আনতে হবে। এরমধ্যে সঠিক জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি করা জরুরী। অবৈধ মোবাইল ফোনের ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। এছাড়া কারাগার, মামলার নথিপত্র প্রযুক্তির আওতায় আনতে হবে। জঙ্গীদের পৃথক ডেটাবেজ থাকবে। জঙ্গীবাদে অর্থায়নকারী প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা। কোন ব্যক্তি জঙ্গীবাদে অর্থায়ন করলে তাকে শাস্তির আওতায় আনতে হবে। আর বিদেশ থেকে জঙ্গীবাদে অর্থায়নের জন্য ব্যাংকিং খাত ও হুন্ডি ব্যবসার কঠোর নজরদারিসহ অনেক প্রযুক্তিগত বিষয়ের কথা বলা হয়েছে। বাংলাদেশে জঙ্গীবাদে স্বল্প সময়ের মধ্যে সাফল্য পাওয়ার বিষয়ে সভায় জানানো হয়, বাংলাদেশের মানুষ জঙ্গীবাদ পছন্দ করেন না। কেউ যাতে জঙ্গীবাদ প্রশ্রয় না দেন সেজন্য সামাজিক সচেতনতা তৈরি করতে হবে। সবচেয়ে বেশি তৎপর থাকতে হবে দেশবাসী, গোয়েন্দা সংস্থা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে। রাষ্ট্রকে জঙ্গীবাদের ক্ষেত্রে জিরো টলারেন্স নীতি দেখাতে হবে। এক্ষেত্রে কোন দল, মত দেখা যাবে না। তাহলেই জঙ্গীবাদ দেশ থেকে নির্মূল করা সম্ভব। বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার তৎপরতার মুখে জঙ্গীবাদ নিমর্ূূলের পথে রয়েছে। তিনি আরও জানান, এক দেশের জঙ্গী আরেক দেশে গ্রেফতার হলে, তার সম্পর্কে দ্রুততার সঙ্গে তথ্য আদান প্রদানের সিদ্ধান্ত হয়েছে। এমনকি ভাষাগত কারণসহ নানা হিসেব নিকেশ অনুযায়ী প্রয়োজনে জিজ্ঞাসাবাদেরও সুযোগ থাকছে। জাপানসহ অংশ নেয়া দেশগুলো বাংলাদেশের জঙ্গীবাদ নির্মূলে নিয়মিত পরামর্শ নিচ্ছে। কি ধরনের পরামর্শ দেয়া হচ্ছে, তা কৌশলগত কারণে তিনি প্রকাশ করতে রাজি হননি। জঙ্গীবাদ নির্মূলে প্রতিটি দেশ বিশাল অঙ্কের টাকার বাজেট রাখছে। প্রযুক্তি ও সামাজিকভাবে জঙ্গীবাদ নির্মূল করার সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত হয়েছে। এজন্য এক দেশ অন্য দেশকে সব ধরনের সহায়তা দিতে অঙ্গীকার করেছে। সিআইডির সংঘবদ্ধ অপরাধ তদন্ত বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, মানিলন্ডরিং, সন্ত্রাস ও জঙ্গী অর্থায়নের বিষয়ে জাতিসংঘের এফএটিএফ (ফিন্যান্সিয়াল এ্যাকশন টাস্কফোর্স) ইতোমধ্যেই জঙ্গীবাদের ঝুঁকিতে থাকা বেশ কয়েকটি দেশের সঙ্গে বৈঠক করেছে। এফএটিএফ ছাড়াও জাতিসংঘের এপিজি (এশিয়ান প্যাসিফিক গ্রুপ) নামে একটি পৃথক ইউনিটও এ বিষয়ে কাজ করছে বাংলাদেশের সঙ্গে। জাতিসংঘের এই দুটি সংস্থা ছাড়াও বাংলাদেশ ব্যাংক ও সিআইডি পুলিশ সিরিয়ায় নিহত বাংলাদেশী আইএস জঙ্গী সাইফুল ইসলাম সুজনের অর্থ পাচার ও জঙ্গী অর্থায়নের আন্তর্জািতক নেটওয়ার্কের বিষয়ে এফবিআইয়ের দেয়া তথ্য মোতাবেক তদন্ত করছে। যুক্তরাষ্ট্র সেনাবাহিনীর তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫ সালের ১০ ডিসেম্বর সিরিয়ায় আইএসের কথিত রাজধানী রাকার কাছে ড্রোন হামলায় নিহত হয় সুজন। যুক্তরাজ্যে কম্পিউটার প্রকৌশলে পড়াশোনা করা সুজন আইএসের কম্পিউটার অপারেশন বিভাগের প্রধান ছিল বলে মার্কিন তদন্তকারীদের দাবি। সুজনের স্ত্রী ও বোন এখনও নিখোঁজ। ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার ও কাউন্টার টেরোরিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম জানান, এ্যাপ ও ওয়েবসাইট নির্মাতা প্রতিষ্ঠান আইব্যাকস টেকনোলজিসের মূল কার্যক্রম চলত যুক্তরাজ্যের কার্ডিফ থেকে। বাংলাদেশ ছাড়াও ডেনমার্ক, অস্ট্রেলিয়া, জর্দান, তুরস্ক ও যুক্তরাষ্ট্রে এ প্রতিষ্ঠানের ব্যবসা ছিল। ওই ব্যবসার আড়ালে সুজন অর্থ পাচারে যুক্ত ছিল বলে তদন্তকারীদের দাবি। আইব্যাকসের মাধ্যমে সুজন কয়েক লাখ পাউন্ড ঢাকা হয়ে সিরিয়ায় পাঠিয়েছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইম বিভাগের বিশেষ পুলিশ সুপার মোল্লা নজরুল ইসলাম তুরস্কের সঙ্গে যোগাযোগের সূত্র ধরে হবিগঞ্জ থেকে জঙ্গী অর্থায়নে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেফতার করা হয় মোস্তাক আহম্মেদ খাঁকে (২৭)। সে এক সময় ছাত্রশিবিরের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিল। পরবর্তীতে তুরস্কের একটি মাদ্রাসায় প্রায় ছয় বছর পড়াশুনাকালে পুরোপুরি জঙ্গীবাদে জড়িয়ে পড়ে। তুরস্কের বিভিন্ন জঙ্গী সংগঠনের হয়ে কাজ করে দেশে ফেরে। নিজেই এনজিও খুলে বিদেশ থেকে অর্থ সংগ্রহ করে জঙ্গী কর্মকা- চালানোর কাজে ব্যয় করত।
×