ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মিয়ানমারে ১০ গণকবরের সন্ধান নিয়ে সেনা তদন্ত শুরু

প্রকাশিত: ০৫:১৫, ২২ ডিসেম্বর ২০১৭

মিয়ানমারে ১০  গণকবরের  সন্ধান নিয়ে  সেনা তদন্ত  শুরু

মোয়াজ্জেমুল হক/এইচএম এরশাদ ॥ মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের নিধনযজ্ঞ চালানোর পর এ পর্যন্ত ১০ গণকবরের সন্ধান লাভের ঘটনাটি বিশ্বজুড়ে তোলপাড় সৃষ্টি করেছে। এছাড়া ওই রাজ্য থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গার সংখ্যা ১০ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। জাতিসংঘসহ এর আওতাধীন বিভিন্ন মানবাধিকার ও সাহায্য সংস্থা রোহিঙ্গাদের নিধনযজ্ঞের ঘটনাটি নিয়ে নিয়মিতভাবে মনিটরিং করে চলেছে এবং মিয়ানমারের প্রতি দফায় দফায় বিভিন্ন আহ্বান জানিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু মিয়ানমার সরকার এগোচ্ছে অত্যন্ত ধীরগতিতে। গত মঙ্গলবার মিয়ানমার প্রতিনিধি দল ঢাকায় আসার পর দু’দেশের পক্ষে ৩০ সদস্যের একটি জয়েন্ট ওয়ার্কিং দল গঠন করা হয়েছে। এ জয়েন্ট ওয়ার্কিং দল মাঠপর্যায়ে কখন কাজে নামবে তা এখনও অঘোষিত। রাখাইন রাজ্যের পরিস্থিতি নিয়ে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক বিশেষ দূত ইয়াং হি লি-কে আগামী মাসের প্রথম সপ্তাহে সে দেশে প্রবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে আউং সান সুচি সরকার। শুধু তাই নয়, হাই কমিশন কার্যালয়ের এক বিবৃতিতে জানানো হয়েছে, জাতিসংঘের বিশেষ এই দূতকে তার মেয়াদকালে কোনভাবেই আর মিয়ানমারে প্রবেশের সুযোগ দেয়া হবে না এবং কোন সহযোগিতাও পাবেন না বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছে মিয়ানমার সরকার। ইয়াং হি লি ইতোপূর্বে মিয়ানমার সফর করেছেন। বাংলাদেশও সফর করেছেন। বাংলাদেশে তাকে রোহিঙ্গা আশ্রয় শিবির পরিদর্শনের সুযোগ দেয়া হলেও মিয়ানমার সরকার তাকে রাখাইন রাজ্যে যেতে দেয়নি। এ ঘটনাটি ছিল গত বছরের আগস্ট মাসের আগে। ওই মাসের শুরু থেকে রাখাইন রাজ্যে সেনা মোতায়েন হয়। পরিস্থিতি উত্তপ্ত হতে থাকে। এ অবস্থায় ইয়াং হি লি জুলাই মাসে মিয়ানমার সফরে যান। পরিদর্শন করতে চেয়েছিলেন রাখাইন রাজ্য। কিন্তু নিরাপত্তার অজুহাত দেখিয়ে তাকে সেখানে যেতে দেয়া হয়নি। শুধু তাই নয়, তার ইয়াঙ্গুন সফরটি ছিল কঠোর নিরাপত্তাধীন। আগামী জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে তার মিয়ানমার সফরের কর্মসূচী ঘোষণা হলে মিয়ানমার এবার বেঁকে বসেছে। শুধু রাখাইন নয়, তাকে মিয়ানমারেই ঢুকতে দেয়া হবে না বলে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেয়া হয়েছে। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, জাতিসংঘ মহাসচিব আন্থনিও গুতেরেজের মতো ইয়াং হি লিও রোহিঙ্গা দমন নিপীড়নের বিরুদ্ধে সোচ্চার ভূমিকা পালন করে আসছেন। এর পাশাপাশি ইউএনএইচসিআরও অনুরূপ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। এদিকে, কক্সবাজারের টেকনাফ উখিয়া অঞ্চলে নতুন পুরাতন মিলে রোহিঙ্গার সংখ্যা প্রায় সাড়ে ১২ লাখে পৌঁছেছে। সীমান্তের ওপারের সূত্রগুলো জানায়, মংডু শহরে সর্বোচ্চ ২৫ হাজার রোহিঙ্গার বসবাস রয়েছে। অপরদিকে, মংডুর শহরতলী অঞ্চল, সিটওয়ে এবং রাচিদংয়ে সর্বোচ্চ রয়েছে দুই লাখ। আর উত্তপ্ত মংডুর দংখালিতে ১৫ সহ¯্রাধিক রোহিঙ্গা স্থায়ী বসতি গেঁড়েছে। সুযোগ পেলে এদের মধ্য থেকে কেউ কেউ বাংলাদেশে চলে আসার সুযোগ খুঁজছে। কিন্তু বাংলাদেশ সীমান্ত রক্ষীবাহিনী আগের তুলনায় টহল জোরদার করার কারণে গত কয়েকদিন ধরে প্রকাশ্যে রোহিঙ্গা আগমন দৃশ্যমান হচ্ছে না। তবে ফাঁকফোকরে রাতের অন্ধকারে কেউ কেউ চলে আসার তথ্য মিলছে, যা স্থানীয় সূত্রগুলো নিশ্চিত করছে। বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ৮ লাখ ৬৪ হাজার রোহিঙ্গাকে বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে নিবন্ধনের আওতায় আনা হয়েছে আশ্রয় শিবিরগুলোতে। এছাড়া রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সদস্যদের মধ্যে এ পর্যন্ত ১০৭ এইচআইভি রোগী শনাক্ত হয়েছে। ডিপথেরিয়া আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা সহস্রাধিক। রোহিঙ্গা এইডস আক্রান্ত রোগী মারা গেছে একজন। আর ডিপথেরিয়ায় মারা গেছে ৮ শিশু। রোহিঙ্গা আশ্রয় কেন্দ্রে আশ্রিতরা আট ব্লকে বিভক্ত হয়ে বসবাস করছে। ত্রাণ পেলে ফিরে যাবে রোহিঙ্গারা ॥ স্বদেশে গিয়ে সেখানে যদি ত্রাণসামগ্রী পাওয়া যায়, তাহলে বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের অনেকে মিয়ানমারে ফেরত যেতে রাজি বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে। যদিও প্রত্যাবাসন প্রশ্নে রোহিঙ্গাদের পক্ষ থেকে শর্ত জুড়ে দেয়া হয়েছে। এর আগে মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়া প্রশ্নে কড়া শর্ত আরোপ করে রেখেছে। বালুখালী, পালংখালী ও কুতুপালং ক্যাম্পের নজির হোছন, আলী আকবর, রহিম উল্লাহ, নুর আঙ্কিজ, হুরে জান্নাত, নুর ফাতেমা, আমির হামজা, নুরুল বশর ও মোহামদুল্লাহসহ বহু রোহিঙ্গার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা বর্তমানে বাংলাদেশে আশ্রয় পেয়ে ভাল অবস্থানে রয়েছে। আশ্রয়ের পাশাপাশি ত্রাণ সহায়তারও কোন ঘাটতি নেই। পুনরায় মিয়ানমারে গেলে নাগরিকত্বসহ জাতিসংঘ যদি ত্রাণের ব্যবস্থা করে দিতে পারে তাহলে তারা নিজ দেশে ফিরে যেতে রাজি। রোহিঙ্গাদের হাতে হাতে মোবাইল ॥ উখিয়া-টেকনাফের বারো ব্লকে আশ্রিত হয়ে থাকা রোহিঙ্গাদের প্রায় সকলের হাতে হাতে মোবাইলের ছড়াছড়ি রয়েছে। মূলত মোবাইলে ওপারে বসবাসরতদের সঙ্গে যেমন যোগাযোগ রক্ষা করে থাকে, অনুরূপভাবে বাংলাদেশে আশ্রয় পাওয়ার পর ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকাদের সঙ্গেও নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করে থাকে। শুধু তাই নয়, বহু আগে বিদেশে চলে যাওয়া রোহিঙ্গাদের সঙ্গেও এদের সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রয়েছে। মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গার বসবাস রয়েছে। ভারতেও রয়েছে ৪০ হাজার। আর বাংলাদেশে দশকের পর দশক জুড়ে আসতে আসতে এ সংখ্যা ২০ লাখের কাছাকাছি পৌঁছেছে। যদিও রোহিঙ্গাদের মোবাইল ব্যবহারে অঘোষিতভাবে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। কিন্তু এরা বিভিন্নভাবে সিম কার্ড যোগাড় করে মোবাইল ব্যবহার করে আসছে। এতে করে নিমিষেই তারা এপার এবং ওপারের সব তথ্য পেয়ে যায়। এছাড়া রোহিঙ্গা নেতাদের হাতে রয়েছে একাধিক মোবাইল। রোহিঙ্গারা মোবাইল ব্যবহারের সুবিধা পাওয়ার কারণে সুবিধা-অসুবিধা দুটিই রয়েছে বলে প্রশাসনের কর্মকর্তারা মনে করছেন। কিন্তু এরা এদেশে স্থায়ীভাবে গেঁড়ে বসা রোহিঙ্গাদের নাম ব্যবহার করে বা কিছু কিছু অসাধু সিম ব্যবসায়ী অধিক মুনাফায় এদেরকে ক্রমাগত হারে মোবাইল নেটওয়ার্কের সুবিধায় নিয়ে আসছে। ইয়াং হি লির সফরের ওপর নিষেধাজ্ঞা ॥ জাতিসংঘ মানবাধিকার বিষয়ক বিশেষ দূত ইয়াং হি লির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে সুচি সরকার। এ বিশেষ দূত তার মেয়াদকালীন সময়ে আগামীতে মিয়ানমারে প্রবেশ করতে পারবেন না। মিয়ানমারের মানবাধিকার লঙ্ঘন বিষয়ে এই দূত আগামী জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে মিয়ানমার সফরে যাওয়ার কর্মসূচী ছিল। এ পর্যন্ত ১০ গণকবর ॥ গত ২৫ আগস্ট রাতে রাখাইন রাজ্যে সামরিক অভিযান শুরুর পর এ পর্যন্ত দশটি গণকবরের সন্ধান পাওয়া গেছে। যেখানে রয়েছে হাজার হাজার রোহিঙ্গার কঙ্কাল। বেসরকারী পরিসংখ্যান অনুযায়ী রাখাইন রাজ্যে সেনা অভিযানের পর প্রায় ৬ হাজার রোহিঙ্গা প্রাণ হারিয়েছে বলে তথ্য রয়েছে। গণকবর সন্ধান আবিষ্কৃত হওয়ার পর গত বুধবার মিয়ানমার সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তার নেতৃত্বে যে তদন্ত কমিটি করে দেয়া হয়েছে সে কমিটি কাজ শুরু করে দিয়েছে। গত বুধবার তারা নেপিদো থেকে রাখাইন রাজ্যে পৌঁছেন। তদন্ত দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন সেনাবাহিনীর লে. জেনারেল অ উইন।
×