ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

সাজ্জাদ কাদির

বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসঙ্গীত উৎসব

প্রকাশিত: ০৩:৪৬, ২২ ডিসেম্বর ২০১৭

বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসঙ্গীত উৎসব

অবশেষে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ‘বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসঙ্গীত উৎসব-২০১৭’। শাস্ত্রীয় এই সঙ্গীতকে সাধারণ মানুষ ও তরুণদের কাছাকাছি নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে পাঁচ বছর যাবত বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসঙ্গীত উৎসব অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। কিন্তু এবার প্রথম এই ধারাবাহিক উৎসব বাতিল করা হয়েছিল। ২৩-২৭ নবেম্বর এ উৎসব হওয়ার কথা ছিল। এ পর্যন্ত উপমহাদেশীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের রথী-মহারথীরা নিয়মিতই এতে অংশ নিয়েছেন। বাংলাদেশ ছাড়াও বিদেশের দর্শকের কাছেও আয়োজনটি সমাদৃত হয়েছে। এবারের উৎসবে দুই শতাধিক শিল্পী-কলাকুশলীর অংশ নেয়ার কথা। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের দিকপাল সুর সম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ, সুর সাধক আয়েত আলী খাঁ, আলী আকবর খাঁ, সঙ্গীত গুরু রবী শংকর, উদয় শংকর, বেলায়েত খানসহ অনেকেরই নাম বলা যাবে যারা এক সময় এই বাংলাদেশেরই মানুষ ছিলেন। যারা শুধু ভারতে নয়, সারা বিশ্বে উচ্চাঙ্গসঙ্গীতকে জনপ্রিয় করেছেন তারা সকলেই বাঙালী; বাংলাদেশের মানুষ। কেউ ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কেউ ময়মনসিংহ, কেউবা কুমিল্লা, মুন্সীগঞ্জে বড় হয়েছেন। বলা যায় আমাদের দেশেই তো উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের মূল শেকড় ছিল। একটি প্রজন্ম পেরিয়ে গেছে মাত্র। এখন যে প্রজন্ম বেড়ে উঠছে তাদের এই শেকড়ের সন্ধান দিতে হবে। এই ভাবনা থেকে উচ্চাঙ্গসঙ্গীত উৎসবের যাত্রা শুরু করে দেশের প্রথিতযশা সাংস্কৃতিক সংগঠক; পৃষ্ঠপোষক সংগঠন বেঙ্গল ফাউন্ডেশন। গত পাঁচ বছর যে চিত্র ছিল সেটি হচ্ছে- গভীর রাতে মানুষ গান শুনতে যেত। মঞ্চে হয়ত কোন বংশীবাদক বাঁশি বাজাচ্ছেন। দর্শক সারিতে বসা শত শত মানুষ। পিনপতন নীরবতা। সত্যি এ এক অসাধারণ দৃশ্য। দারুণ এক অনুভূতি। সবকিছু দেখে আনন্দে মন ভরে উঠত। গর্বভরে বলতে ইচ্ছে হয়- এই তো আমাদের গানের দেশ। বিগত ৫ বারের উৎসবে তিন বার সারাদেশে হরতাল ছিল। তবুও শ্রোতা-দর্শকের ভিড় কমেনি। শুধু দেশে অবস্থানকারী দর্শকই নয় প্রবাসে বসবাসকারী বহু পরিবার এই উৎসবকে কেন্দ্র করে দেশে বেড়াতে আসতেন। এটাকে কি বলবেন? সঙ্গীতের প্রতি ভালবাসা নিশ্চয়ই? শুনেছি স্বাধীনতা-পূর্ব সময়ে এদেশে এ ধরনের আয়োজন হতো, সেখানে বড় বড় সঙ্গীতশিল্পী আসতেন। স্বাধীনতার ৪ দশক পেরিয়ে গেলেও এ ধরনের আয়োজন হয়নি। সম্প্রতি এটাই ছিল একমাত্র আন্তর্জাতিক মানের ধ্রুপদি সঙ্গীত উৎসব। ধ্রুপদি সঙ্গীতের প্রতি ভালবাসা তৈরি করতে এটা বিরাট ভূমিকা রাখছিল। এ ধরনের একটা সম্মিলন মাঝে মাঝে হওয়াটা খুব জরুরী। বাঙালীর কাছে একদা ধ্রুপদি সঙ্গীত জনপ্রিয় ছিল না। এদেশে একসময় মেহেদী হাসান, ওস্তাদ আমানত আলী খান গজল পরিবেশন করে গজল গান খুব জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পাশাপাশি উচ্চাঙ্গ এবং জনপ্রিয় গান সমানতালে চলে। পার্থক্য একটাই। ডিসকো বা জনপ্রিয় গানে দর্শক উন্মাতাল। আর ধ্রুপদি গানে পিনপতন নীরবতা। এ দেশে ধ্রুপদি সঙ্গীতের প্রতি দর্শক-শ্রোতাকে আকৃষ্ট করতে এই উৎসব ছিল উৎকৃষ্ট। দর্শক-শ্রোতার কান আর চোখ তৈরির এক মহাউৎসবে পরিণত হয়েছিল এই আয়োজন। আমাদের সংস্কৃতি টিকিয়ে রাখার মতো পৃষ্ঠপোষকের বড়ই অভাব এদেশে। বাধা দেয়ার মতো গোষ্ঠীর অভাব নেই। এখানে একটি কথা বলতেই হয় যে সংগঠনটি এই উৎসবটির আয়োজক তারা এদেশের সুস্থ ধারার সংস্কৃতির সবচেয়ে বড় এবং অন্যতম প্রধান পৃষ্ঠপোষক। আমি নিজে একসময় গ্রুপ থিয়েটারের সঙ্গে যুক্ত থাকার সুবাদে দেখেছি এই সংগঠনটির পৃষ্ঠপোষকতায়, অর্থায়নে এদেশে মঞ্চ নাটকের একটি জোয়ার তৈরি হয়েছিল। বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের মাধ্যমে সারাদেশে মঞ্চ নাটকের উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছিল সংগঠনটি। বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের অর্থে দেশব্যাপী বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের নিয়মিত কর্মশালা হতো। ২০০৯ সাল থেকে এই অনুদান বন্ধ হয়ে যায়। শুধু কর্মশালাই নয়, প্রায় ১০ বছর বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের মাধ্যমে মঞ্চ নাটকের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে সহযোগিতা ছাড়াও বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের অনুদানেই বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের প্রতিবছর নাট্যোৎসব অনুষ্ঠিত হয়েছে। স্বাধীনতার পরে এদেশে বহু কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান ফুলে-ফেঁপে উঠেছে। কিছু বিচ্ছিন ঘটনা বাদ দিলে এই বেঙ্গলের বাইরে আর একটি প্রতিষ্ঠানের নাম কী আমরা বলতে পারব যে এদেশে সুস্থ ধারার সংস্কৃতি চর্চায় পৃষ্ঠপোষকতা করেছে বা করছে? ১৯৯০ সালে বেঙ্গল ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা লাভ করে। বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্যে রয়েছে বেঙ্গল গ্যালারি অব ফাইন আর্টস, এস এম সুলতান বেঙ্গল আর্ট কলেজ, সফিউদ্দিন বেঙ্গল প্রিন্ট মেকিং স্টুডিও, বেঙ্গল পরম্পরা সঙ্গীতালয়, বেঙ্গল পাবলিকেশনস্, জ্ঞানতাপস আবদুর রাজ্জাক বিদ্যাপীঠ এবং ইনস্টিটিউট ফর আর্কিটেকচার, ল্যান্ডস্কেপস এ্যান্ড সেটেলমেন্টস। বেঙ্গল ফাউন্ডেশন কর্তৃক প্রকাশিত নানা পত্র-পত্রিকার মধ্যে রয়েছে ‘কালি ও কলম’ যা ঢাকা এবং কলকাতা থেকে একযোগে প্রকাশিত হয়। আগামী ২৬ ডিসেম্বর থেকে রাজধানীর ধানমণ্ডি আবাহনী মাঠে শুরু হচ্ছে ৫ দিনের বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসঙ্গীত উৎসব। ছোট আয়োজন হলেও অন্তত ধারাবাহিকতা বজায় থাকছে। এবারের সঙ্গীত উৎসবে উপমহাদেশের যেসব শিল্পীর আসার কথা ছিল সবাই আসতে হয়তো পারছেন না। তবে এদের মধ্যে ৮০ শতাংশই এই উৎসবে যোগ দিবেন। এখন সরকারের উচিত হবে আয়োজনটি যাতে সফলভাবে সম্পন্ন হতে পারে এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করা। লেখক : সাংস্কৃতিক কর্মী [email protected]
×